ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ক্রান্তিকালীন চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন। ইউক্রেনে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মুখ সমর চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক রেষারেষিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থায় যে প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে, তার পুরোটাই আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর গভীর রেখাপাত করছে। বিশেষত পাকিস্তানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা নানামুখী অনিশ্চয়তা ও বৈপরীত্যে ভরপুর। সেই দেশভাগের পর থেকেই এখানে রাজনৈতিক জমিদার ও সামরিক আমলাতন্ত্রের মধ্যকার বোঝাপড়া ও দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতের ইতিহাস একে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এনটিটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে তুখোর মেধাবি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিক ও স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারি নেতা কায়েদে আযম মুহম্মদ আলি জিন্নাহর মৃত্যুর পর শাসক শ্রেণীর বোঝাপড়ায় চরম ঘাটতি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে তাদের অনীহা, সমন্বয়হীনতা এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক কুপমুন্ডুকতা দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের সম্ভাবনাকে অনেকটাই নস্যাৎ করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের জাত্যাভিমান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁধাগ্রস্ত করার পরিনতিতে বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন, রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল অনিবার্য বাস্তবতা। তবে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় আগ্রাসি ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্প্রদায়িক ভারতের অব্যাহত হুমকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে একাধিক যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় মুসলিম বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র পারমানবিক শক্তি হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনাকেই প্রমান করেছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সমন্বয়হীনতা, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সামনে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবমর্যাদায় আঘাত হেনেছে। এতকিছুর পরও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের জনগণ তার অবস্থান টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে অটুট রয়েছে। দেশের জনগণ এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতার দ্বৈরথ স্বাধীনতাত্তোর পাকিস্তানকে গত ৭ দশকে কোনো নির্বাচিত সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে দেয়নি। সেনাবাহিনীর নেপথ্য ভ’মিকা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বার বার টালমাটাল করে তুলেছে, সেই টালমাটাল অবস্থার ক্রান্তিকালে দেশের জনগণকে একেকজন দেশনায়কের পেছনে আত্মত্যাগী সৈনিকের ভ’মিকায় দাঁড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা পাকিস্তানের সাথে একটি আপসহীন বৈরিতা জিইয়ে রাখার সাথে সে দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে কটাক্ষ করার পাশাপাশি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করেছেন। অর্থনৈতিক বিচারে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের ভাল অবস্থানের কথা পাকিস্তানি শাসকরাও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের এই অর্জনের কৃতিত্ব এ দেশের লাখ লাখ কৃষক, এক কোটির বেশি প্রবাসী রেমিটেন্স যোদ্ধা এবং গার্মেন্ট শিল্পের হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ও লাখ লাখ শ্রমিকের।
পাকিস্তানের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে প্রায় অর্ধেক সময়ই হয় সেনানায়কদের দ্বারা অথবা সেনাসমর্থিত সরকারের দ্বারা শাসিত হয়েছে। একই সময়ে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সক্ষম হওয়া ভারতের কৃতিত্ব ভারতকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। তবে একবিংশ শতকের শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে শুরু হওয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক যুদ্ধে রাশিয়ার সাথে পুরনো সম্পর্কের অঘোষিত বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নতুন অংশীদারিত্বের সম্পর্ক ভারতকে বেপরোয়া আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের সাথে জায়নবাদী ইসরাইল বর্ণবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোঝাপড়া ভারতে চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদের উত্থান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। ভারতের গণতন্ত্র এখন পশ্চিমে তো বটেই, ভারতের বিরোধীদলগুলোর কাছেও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মোদির উপাধি নিয়ে সমালোচনা করায় তার বিরুদ্ধে করা কয়েক বছর আগের একটি মামলায় রাহুলকে ২ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেয় সুরাটের একটি আদালত। আইন-আদালতকে ব্যবহার করে সরকারের প্রতিপক্ষ দলের নেতাকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিতাড়িত করার এমন উদ্যোগ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বেমানান ও অশোভন। তবে অদম্য মনোবল নিয়ে দৃঢ়চেতা রাহুল গান্ধী মোদি সরকারের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির এজেন্ডার বিপরীতে ইতিবাচক রাজনীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে সারা ভারতে ঘুরে বেড়ানোর যে কর্মসূচি পালন করেছেন, তা ভারতের সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করেছে বলেই মনে হয়। রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রার পর হিমাচল ও কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি’র ভরাডুবি ঘটেছে। রাহুলগান্ধীর ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে সমুহ বিপদ আঁচ করেই আদালতের মাধ্যমে তাকে আটকে দেয়ার যে পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল, তা বিজেপির জন্য বুমেরাং হয়েছে। হিমাচল ও কর্ণাটকের নির্বাচনে বিজেপিকে ভোটারদের প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে তা প্রমানিত হয়েছে। গত বছর ভারত জোড়ো যাত্রার সময় রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, আমি প্রতিরোধ্য, অজেয়। ভারত জোড়ো যাত্রার সময় তিনি ঘৃনার বদলে ভালবাসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে দক্ষিণ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য কর্ণাটকে বিজেপিকে হটিয়ে কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হওয়ার পর তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘দক্ষিণ ভারতে ঘৃণার বাজার বন্ধ হয়ে গেল, খুলে গেল ভালবাসার দোকান।’ ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে ঘৃণা ছড়িয়ে জাতিকে বিভাজিত করার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস, ক্রমাগত বৈষম্য বাড়িয়ে তোলা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, এবং একদলীয় আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেভাবে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার ইতিহাস বিভিন্ন দেশে প্রায় অভিন্ন্।
পঁচাত্তর বছরেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে না পারা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমুহের জন্য লজ্জাজনক বিষয়। তবে সেখানকার নির্বাচনে সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রভাব সত্ত্বেও জনগণের রায়ের প্রতিফলনকে অদৃশ্য হাতে উল্টে ফেলা যায়নি। এমনকি অখ- পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দিতে টালবাহানা করলেও ক্ষমতাবলে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাঁগ্রস্ত বা ফলাফল উল্টে দেয়ার প্রয়াস দেখা যায়নি। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বার বার নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে গণরায়কে বদলে দেয়ার মধ্য দিয়ে এ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতাকে জনগণের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের আগে আদালতের উপর প্রভাব সৃষ্টি করে, পুলিশ বাহিনী, র্যাব, দুর্নীতি দমন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, নির্বাচন কমিশন ও সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডা ম্যাকানিজম ব্যবহার করে বিরোধিদলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখা এবং নির্বাচনের সময় প্রার্থীসহ বিরোধীদলের লাখ লাখ কর্মীকে হামলা, মামল ও আক্রান্ত করেই অপপ্রয়াস শেষ হয়নি, সারাদেশের সব ভোটকেন্দ্রে সরকারী দলের অনুগত শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তাদের ভোটকেন্দ্রের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া, অত:পর ভোটকেন্দ্র থেকে বিরোধীদলের পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার মাধ্যমে একতরফা নির্বাচনের নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। নবম, দশম ও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর আঘাত করা হয়েছে। মুফতে ক্ষমতার বিনিময়ে দেশের রাজনীতি, জাতীয় স্বার্থ ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে আধিপত্যবাদী শক্তির কুশীলবদের কাছে গোপন নিলাম ও সমঝোতার বিষয়ে পরিনত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সাধারণত যাদের দিকে আঙ্গুল তুলে থাকি, এবার তাদেরকেই আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের গণতান্ত্রিক রোডম্যাপ, স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা ও গণরায়ের প্রতিফলনের নিশ্চয়তা নিয়ে বেশি সোচ্চার ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তি ও উন্নয়ন অংশীদারদের সাথে অনভিপ্রেত বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। আমাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার দেশের মানুষের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। নির্বাচনে গণরায়ের প্রতিফলন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বাঁধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই বিরোধীদলের অনেক নেতাকর্মী গুম-খুন করা হয়েছে। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা, গায়েবি মামলা, বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা লাখ লাখ মানুষকে বছরের পর বছর ধরে সন্ত্রস্ত করে রাখা হয়েছে। যেকোনা মানদ-ে এসব হচ্ছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাব ও পুলিশের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানিয়ে তা তুলে নিতে সরকারের পক্ষ থেকে দেনদবারও কম হয়নি।
গুম-খুনের মত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুষ্ঠু তদন্ত, বিচার এবং এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর আইনগত প্রক্রিয়া ও বাস্তবায়ন দেখাতে বলেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমন ছিল নাইন-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল পলিটিক্যাল এজেন্ডা। বাংলাদেশে কথিত জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে র্যাবের প্রশংসনীয় ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো হদিস না পাওয়ার ঘটনাগুলোকে র্যাবের সন্ত্রাস বিরোধী তৎপরতার সাথে মেলানো যায়না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাব-পুলিশের কতিপয় সদস্যের উপর নিষেধাজ্ঞার দায় পুরো বাহিনী বা সরকারের উপর বর্তায় না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বাহিনী ও সরকার দায় এড়াতে পারে। সেখানে নিষেধাজ্ঞার জবাবে পাল্টা নিষেধাজ্ঞার নিস্ফল আস্ফালন দেখানো হচ্ছে কেন? ভারত এবং চীনের সাথে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য বৈষম্য বিদ্যমান। সেখানে গার্মেন্ট পণ্যের ক্রেতা হিসেবে, উন্নয়ন অংশীদার কিংবা প্রবাসী কর্মীদের রেমিটেন্স যোগানদাতা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের ইকোনমিক সারপ্লাস রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যের এই আনুকূল্য বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক বড় ভিত্তি। বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বা কোনো বাহিনীর কিছু সদস্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে আমদানি বা কেনাকাটা বন্ধ করে দিলে তারা যদি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয় তাহলে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একজন সাধারণ মানুষও তা বুঝতে সক্ষম।
উইকিপিডিয়ার পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ১৪ মে তারিখে বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময় ধরে নারী সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উঠে আসে। ২০১৪ সালে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এবং ভোটারদের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ১৫৪টি আসনে আওয়ামী জোটের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নিশ্চিত করা হয়েছিল। সব বিরোধীদলের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সবার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে যথাশীঘ্র একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাব্যতার কথা বলেছিলেন। দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও রাজনৈতিক আলোচনা বা সমঝোতার উদ্যোগের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছিল। তবে একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার পেছনে ভারতের মদত অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় মোর্চা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করে তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেই নির্বাচন সাম্প্রতিক বিশ্বের জাতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার কাহিনী নির্বাচনের দিন বিবিসিতে প্রচারিত হয়।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সাবেক জাপানি রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, তিনি বিশ্বের আর কোথাও কখনো এমন জাতীয় নির্বাচনের কথা শোনেননি। দেশে দেশে নির্বাচিত সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতার প্রমান বহন করে। কিন্তু জনগণের ভোটাধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করে বিরোধীদল নির্মূলের মাধ্যমে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার প্রক্রিয়া গণতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে এবং ভারতে পাকিস্তানের গণতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র নিয়ে একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বিশ্লেষককে বেশ মাথা ঘামাতে দেখি। তবে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক প্রবণতার মধ্যে উগ্রসাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদী উত্থানের প্রবণতা এখনো অনুপস্থিত।
রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর বিতর্কিত ভূমিকা এবং পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সাহসী বক্তব্য রেখে সংসদে আস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করার পর সে দেশের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে যে ভূমিকায় দেখা গেছে, তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে সে দেশের পুলিশ বাহিনী আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ জনতার উপর গুলি চালায়নি। এমনকি সেনানিবাসে হামলা চালানোর পরও সেনাবাহিনী অ্যাকশনে যায়নি। আদালতের নির্দেশে কারামুক্ত হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহেরিকে ইনসাফ পার্টির নেতা ইমরান খান দেশবাসি ও তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আজাদী (স্বাধীনতা) সহজে আসেনা। একে ছিনিয়ে নিতে হয়। এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।’ অন্যদিকে, ভারতের তরুণ কংগ্রেস নেতা ঘৃণার বাজার বন্ধ করে ভালবাসার দোকান খোলার আহ্বান জানিয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যের ডাকে সাড়া জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের উপর। এ ক্ষেত্রে হারানো ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে দেশের জনগণকেই মূল ভূমিকা নিতে হবে। ক্ষমতাসীনদের অধীনে আরেকটা একতরফা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মত বড় ধরণের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।(দৈনিক ইনকিলাবের সৌজন্যে) নধৎরথুধসধষ@ুধযড়ড়.পড়স