প্রচ- তাপদাহে দেশের প্রতিটি জনপদ উত্তপ্ত চুল্লিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই দুঃসময়ে এ নিয়ে দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যতটা না উদ্বিগ্ন তার চেয়ে তারা হয়তো বা বেশি স্বস্তিতে আছেন। তাপদাহের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে সাময়িক সময়ের জন্য কিছুটা স্থিতি নেমে এসেছে বলে। এটি সত্য, সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ ও তাদের সহযোগীরা এখন এই গরমে বোধকরি কৌশলগত কারণেই কিছুটা স্থিত আছে। সম্ভবত কর্মীদের এই বিরূপ আবহাওয়ায় রাজধানীসহ অন্যত্র সব রাজপথে নামিয়ে অসুস্থ করে তুলতে চাচ্ছেন না তারা। এই স্থিততা অবশ্যই একেবারেই সাময়িক সময়ের জন্য বলে আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন। কিছু সময়ের মধ্যেই উদ্ভূত পরিস্থিতির ইতি ঘটতে পারে। তখন সাথে সাথে আবারো বিএনপি ও তার সহযোগীদের সরকার পতনের আন্দোলনে রাস্তায় তার শুধু গতি ছন্দ সবই ফিরে আসবে না, প্রচ- গতিবেগ নিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন জনপথে উপচে পড়বে, সন্দেহ নেই।
আসলে আমাদের এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় কিন্তু একান্ত রাজনৈতিক বিষয়কেন্দ্রিক নয়। নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে, সারা দেশের মানুষ যখন প্রচ- উত্তাপে হাঁসফাঁস করছিল, তখন কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ তাতে এতটুকু কাতর হয়নি বা সহমর্মিতার কোনো বাণী তাদের কাছ থেকে আসেনি। আর এ কথাও উচ্চারিত হয়নি যে এমন বিরূপতা প্রতিবিধানের জন্য কর্তৃপক্ষের সুনির্দিষ্ট একটি কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। তার কাজ যথারীতি এগিয়ে চলছে এবং তার আওতায় রয়েছে বিভিন্ন সব কর্মসূচি। তবে এমন কথা হয়তো এ জন্য বলা হয়নি, এ মুহূর্তে তাদের বলা-কওয়ার মতো কিছু নেই। তা ছাড়া অতীতেও বহুবারই এমন আশ্বাস প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও বাস্তবে তা ছিল নিছক প্রবোধ বচন। যেমন গত রমজানে বলা হয়েছিল, প্রয়োজনীয় সব খাদ্যসামগ্রী সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ মানুষ বাজারে গিয়ে দেখল, হালের প্রচ- তাপদাহের মতো সব পণ্যের মূল্য তেমনি অগ্নিমূল্য। এমন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ কিছু বলতে লজ্জাবোধ করছেন। শুধু রমজানেই কেন, নিকট ও দূর অতীতে এমন শত উদাহরণ রয়েছে; কর্তৃপক্ষের কথা ও কাজের মিল গরমিল দিবা ও রাতের মতোই। অর্থাৎ সব সময়ই প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা যেন কেবল ভেঙে ফেলার জন্য। আমরা শুনেছি, দেশে নাকি উন্নয়নের এক বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। তবে এমন কথাও সমাজে বহুল পরিচিত, প্রকৃত বন্ধুকে যেমন চেনা যায় দুঃসময়েই তার ভূমিকা বিচার করে। ঠিক আজকের এই তাপদাহজনিত দুঃসময়ে বোঝা গেছে, আমাদের সেই ‘বিস্ময়কর’ উন্নয়ন কতটা টেকসই ছিল। এই সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের অন্যতম প্রধান খবর ছিল রাজধানীসহ সারা দেশে বিদ্যুতের যত ভেলকিবাজি। অর্থাৎ বিদ্যুৎ এই যায় এই আসে। এসব থেকে বারবার শুধু এটুকু জানান দেয়, আমি এখন নেই, তবে আসব। এ নিয়ে এখন আর কথা বাড়াতে চাই না। সবাই জানেন, এই অসহনীয় তাপদাহ (যা সাহারা মরুভূমির সাথেই কেবল তুলনীয়) মূলত প্রাকৃতিক পরিবেশগত মারাত্মক এক বিপর্যয় যা একদিনে এভাবে হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এই বিপর্যয়কে ডেকে আনা হয়েছে। যেমন দিনকে দিন বন নিধন করা হয়েছে, জলাশয় ভরাট হচ্ছে, পাহাড় কাটা হয়েছে, যত্রতত্র ইটভাটা তৈরি করা হয়েছে। আর কর্তৃপক্ষ সব চোখের সামনে দেখেছে নীরবে নিশ্চুপে নিভৃতে। অথচ টুঁ শব্দটিও পর্যন্ত করেনি। এ জন্য যে, পাছে যদি কারো অবহেলা দুরাচারীরা সব জারিজুরি ফাঁস করে দেয়। হাজার হোক, সমাজে লজ্জা সম্মান বলে তো তাদের কিছু একটা আছে।
চতুর্পাশ থেকে একটি কথা বারবার শোনা যায়, সব অনিয়ম, অপকর্মের প্রতিবিধানের জন্য দেশে পর্যাপ্ত বিধি-বিধান, আইন-কানুন বর্তমান। কিন্তু তার কোনো অনুশীলন প্রয়োগ নেই, সর্বত্র এক অব্যবস্থা এখন ‘ব্যবস্থায়’ পরিণত হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অপরিসীম অবহেলার জন্য। দেশের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ হচ্ছে জাতীয় সংবিধান, সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে- (১৮(ক) অনুচ্ছেদ) ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রকৃতির সম্পদ জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি বন, বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ এই ভূখ-ের মালিক মোক্তার হিসেবে জনগণ, তারা এই অধিকার রাখেন, গত দেড় দশক থেকে যে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ক্ষমতায় আছেন তারা সংবিধানে (১৮ (ক) অনুচ্ছেদের আলোকে পরিবেশগত বিপর্যয় রুখতে কী করেছেন? কেন আজকের পরিবেশগত এমন দুর্ভোগে পড়ে কোটি কোটি মানুষের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে? এখানে কবি কেন নীরব? এমন মূক হয়ে থাকলে কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া হবে?
গত বছর বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গ্লাসগোতে, সেখানে বিশ্ব নেতৃবর্গ বিশ্বকে ধ্বংসের মুখ থেকে ফেরানোর জন্য যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই সিদ্ধান্ত ভাগাভাগি করে জাতিসঙ্ঘের সদস্য, সবগুলো দেশকে ভাগাভাগি করে নিয়ে তাদের হিস্যা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিক থেকে ঢাকা সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থানে থাকায় উৎকণ্ঠিত দেশবাসী তাদের জীবন-মরণের প্রশ্নে; এমন জিজ্ঞাসার জবাব অবশ্যই সবাই পেতে পারেন, সংবিধানসহ অন্যান্য যেসব নীতি রয়েছে তার আলোকে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছে এ মুহূর্তে এই ভূখ-ের ১৬ কোটির অধিক মানুষের জীবনের মূল্য তাদের কাছে কতটুকু! যে জন্য ব্যবস্থা হচ্ছে, শুধু কথায় নয় কাজে। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, যে বনভূমি দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে এবং প্রতিটি দেশের জন্য সেই বনভূমির আদর্শিক পরিমাণ হচ্ছে- সেই জনপদ যতটুকু ভূমির অধিকারী, সেই ভূ-ভাগের ২৫ শতাংশে থাকতে হবে বনভূমি। বহু দেশের অবস্থান প্রায় ঠিক সে রকমই। অথচ পরিবেশ নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করে, তাদের ধারণা, দেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ৭ থেকে ৮ শতাংশ। অবশ্য দেশের পরিবেশ-বিষয়ক মন্ত্রণালয় মনে করে, দেশের মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ হচ্ছে বনভূমি। অবশ্য মন্ত্রণালয় এ কথা স্বীকার করেছে, গত তিন বছরে দেশের বায়ুর মান খুব বেশি খারাপ হয়ে উঠেছে। স্মরণ রাখতে হবে, বাতাসের বিষবাষ্প শোধনের ক্ষেত্রে গাছগাছালির পত্রপল্লব সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। অথচ সারা দেশে এখন বৃক্ষনিধনের মহোৎসব চলছে।
এক সময় তথা গত শতাব্দীর নব্বই দশক পর্যন্ত রাজধানীতে সবুজের সমারোহ ছিল। এখন সে গাছপালা কেটে বিনাশ করে ইট-বালু সিমেন্টের পল্লী করা হচ্ছে। এটিকে কেউ কেউ তামাশা করে বলেন, নগর উন্নয়নের শোভাবর্ধনের প্রতিযোগিতা চলছে। নগরীতে নতুন আবাসন গড়ার প্রয়োজনকে কেউই অস্বীকার করবে না। কিন্তু এটিও তো ভাবতে হবে, এ নগরীর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের একটি ব্যবস্থা রাখতে হবে। এখন ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের বায়ুদূষণের অন্যতম রাজধানী। এখানে বর্জ্যরে দূষণ, শব্দের দূষণ, নির্মীয়মাণ ভবনগুলো ইট বালু সিমেন্টের কণা, ইটভাটার ধোঁয়া বায়ুতে মিশে বায়ুকে বিষবাষ্পে পরিণত করেছে। একমাত্র প্রচুর গাছপালার পত্রপল্লব সে দূষণের মাত্রা কিছুটা উপশম করতে পারত কিন্তু কোথায় সেই বৃক্ষরাজি? এ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যে রিপভ্যান উইংকেলের মতো ঘুমিয়ে আছে। অথচ এ দিকে বায়ুদূষণজনিত কারণে এই বহু মানুষ এখন স্বাস্থ্যজনিত চরম সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছেন।
দেশের প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীব-বৈচিত্র্যের সুরক্ষার ক্ষেত্রে জলাশয়ের ভূমিকা খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এক সময় এই গোটা ব-দ্বীপটিই ছিল একটি জলাশয়। এখন ক্রমে ক্রমে সেসব জলাশয় ভরাট করে পানিহীন মরু অঞ্চলের মতো করে ফেলা হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাশয় আইন-২০০০-এ বলা আছে- নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, দীঘি-নালা ঝরনা ও বন্যাপ্রবণ এলাকা পানি ধারণের এক প্রাকৃতিক জলাশয় বা জলাভূমি হিসেবে পরিগণিত করা হবে। এমনকি ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরকেও প্রাকৃতিক জলাধারে সংজ্ঞাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, এই জলাধারগুলো কোনোভাবেই ভরাট করা যাবে না। এসব ইতিবাচক কথা, সন্দেহ নেই। অথচ এসব বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে সারা দেশে প্রশাসনের সামনেই পুকুরসহ সব ধরনের জলাভূমি ভরাট করে ঘরবাড়ি, কল-কারখানাসহ নানা অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। এসব জলাভূমি ভরাট করে অবকাঠামোও গড়ে উঠছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় জলাশয় ভরাটের মারাত্মক চিত্র ফুটে উঠেছে। স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, ২০১০ সালে যখন ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) করা হয়, তখন মূল ঢাকা শহরে জলাভূমি ছিল ৯ হাজার ৫৫৬ একর। ২০১৯ সালে পরিধি কমে এসেছে ছয় হাজার ৭৩ একরে। এ থেকে বোঝা যায়, ৯ বছরে ভরাট হয়েছে মোট জলাভূমির ৩৬ শতাংশ। সেই প্রতিষ্ঠানের একই পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে। যখন এভাবে সব জলাশয় শেষ করা হচ্ছে তখন কি আর বলা সম্ভব, এই হর্তাকর্তাদের ভাবনায় প্রাকৃতিক-ভারসাম্য সুরক্ষার কোনো বোধ-বিবেচনা রয়েছে?
সবার জানা উচিত, আদালত কক্সবাজার জেলা সাতটি উপজেলার পাহাড়-টিলা, পাহাড়ি বন কাটা রোধে এবং সমুদ্রসৈকত সুরক্ষার বিষয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্টে। কিন্তু তারপরও তো সারা দেশের পাহাড়-টিলা কাটা তো থামছেই না, এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা তো খুব স্বাভাবিক; দেশে সংশ্লিষ্ট সব আইন-কানুন ও উচ্চ আদালতের সব নির্দেশনা উপেক্ষা করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী পাহাড়-টিলা কেটে বিনাশ করা হচ্ছে। সবার এখন এই প্রশ্ন, দেশের আইন-কানুন প্রাধান্য পাবে না তস্করদের মুষ্টিজোর প্রতিষ্ঠা পাবে? এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমন বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি। এসবের জবাব কোথায় পাওয়া যাবে! সে কর্তৃপক্ষকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? আমাদের একটি সংসদ রয়েছে, সেখানে কি এই জরুরি বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে? হফরমধহঃধনধনধৎ@মসধরষ.পড়স