বর্তমান সামাজিক ব্যাধিগুলোর অন্যতম হচ্ছে জুয়া। একটা সময় গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন বাঁশঝাড়ে জুয়াড়িদের দেখা মিলত। লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে মানুষ এসব অসামাজিক কাজে জড়িত হতো। কিন্তু সময় যত এগোচ্ছে জুয়াড়িদের দৌরাত্ম্য ততই বেড়ে যাচ্ছে। নতুন নামে অপরাধের ভিন্ন রূপ নিয়ে জুয়ার অভিনব সব পদ্ধতির আবিষ্কার হচ্ছে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, বিভিন্ন অলিগলিতে, শহরে কিংবা গ্রামে নামে-বেনামে জুয়ার রমরমা ব্যবসায় চলছে। কৃষক, তরুণ, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে মরণনেশা জুয়ায়। এসব আসরে উড়ছে লাখ লাখ টাকা। বর্তমানে জুয়াবাজির জন্য বিভিন্ন রকমের আসর বসে বিভিন্ন স্থানে। কোথাও হাউজি আবার কোথাও সবুজ টেবিল নামে। ফুটবল ও অন্যান্য খেলাধুলার প্রতিযোগিতায়ও বাজি ধরা হয়।
জুয়ার আর্থিক ও পারিবারিক ক্ষতি : জুয়ার খপ্পরে পড়ে নি¤œ আয়ের মানুষ আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। জুয়ার নেশায় পড়ে একজন বিত্তশালী মানুষ মুহূর্তেই ধনসম্পদ হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। গেম থিওরির সফল ব্যবহারের কারণে কোনো জুয়াড়ির পক্ষেই ক্রমাগত জিতে যাওয়া সম্ভব নয়। এরকম ক্ষেত্রে কিংবা ক্রমাগত হার স্বীকার করে দেউলিয়া হলে মানুষ হতাশায় পড়ে।
ক্রমেই সে বিষণœতায় ভোগে এবং শান্তির পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে। আবার কেউ কেউ তো আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নেয়।
জুয়ার সামাজিক ক্ষতি : জুয়া সমাজে অনাচার অস্থিরতা সৃষ্টি করে। জুয়ার প্রভাবে সমাজে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। জুয়ার কারণে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল সমাজ ক্রমেই বিশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। অনেকসময় দেখা যায়, জুয়াকে কেন্দ্র করে সমাজে মারামারি আর হতাহতের ঘটনাও ঘটে। জুয়া খেলতে গিয়ে পরস্পর মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়ে বহু দিনের সম্পর্কে ভাটা পড়ে।
জুয়ার রাষ্ট্রীয় ক্ষতি : জুয়ার মাধ্যমে একই স্থানে অল্প সময়ের মধ্যে এত টাকার লেনদেনের কারণে দেশে অপরাধ বেড়ে যেতে পারে। নানা রকমের প্রতারণা, আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংয়ের উদ্ভব, বিভিন্ন রকমের অরাজকতার সৃষ্টি হতে পারে। জুয়া বিত্তবানদের আরো বিত্তশালী হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে, যা সম্পদে বৈষম্য আছে এমন একটি দৈশে বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।
জুয়ার ধর্মীয় ক্ষতি : জুয়া মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, নীতিনৈতিকতা কেড়ে নেয়। ফলে তারা আল্লাহকে ভুলে এই শয়তানি মরীচিকায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দেয়। জুয়া মানব-সভ্যতার চরম শত্রু। এটি জীবন ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে। দুনিয়া ও আখিরাত উভয়টিকে বরবাদ করে। স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা বিরত হবে না?’ (সূরা মায়েদা : ৯০-৯১)
নবী করিম সা:-ও জুয়া থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। ভয় দেখিয়েছেন জুয়ার শাস্তির কথা বর্ণনা করে। আবদল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মদ, জুয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন।’ (বায়হাকি-৪৫০৩, মিশকাত-৪৩০৪) অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে- আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়ায় অংশগ্রহণকারী, খোঁটাদাতা ও মদ্যপায়ী জান্নাতে যাবে না।’ (দারেমি-৩৬৫৩, মিশকাত-৩৪৮৬)
এসব খেলায় আসক্ত হওয়ার কারণ : বস্তুত মানুষের যখন আখিরাত ও অনন্ত জীবনের ব্যাপারে উদাসীনতা সৃষ্টি হয়, দুনিয়ার দু’দিনের জীবন ছাড়া আর সবকিছুই তার কাছে ফিকে মনে হয়, এ জগতের বাইরে কল্পনা-ঊর্ধ্ব আরেকটি জগৎ আছে, সময় ও সীমাহীন আরেকটি জীবন আছে বলে যার জানা নেই, সে কী আর করতে পারে, বরং কী না করতে পারে!
ষাট-সত্তর বছরই তো তার পুঁজি, তার আশা-আকাক্সক্ষার শেষ সীমা, তার জ্ঞান ও চিন্তার শেষ সীমানা। কিসের আশায় কিসের ভরসায় বর্তমানের ভোগ-উপভোগ, স্বাদ আহ্লাদ ও আনন্দ ফুর্তির কোনো সুযোগ হাতছাড়া করবে সে? কোন জীবনের জন্য, কোন আনন্দের জন্য, কোন প্রাপ্তি ও তৃপ্তির জন্য ত্যাগ ও আত্মত্যাগ ক্ষুধা ও তৃষ্ণা এবং সাধনা এবং সংযমের জীবন অবলম্বন করবে সে? এটিই হচ্ছে জীবন সম্পর্কে আজকের সভ্য মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। তাই তো জুয়ার আড্ডায়, মদের বারে, আল্লাহর দেয়া জীবনটাকে হেসেখেলে নষ্ট করে দিচ্ছে।
মুক্তির উপায় কোন পথে : আমরা যদি সামাজিক ব্যাধিগুলো থেকে মুক্তি পেতে চাই, আবার আমাদের ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে। ঈমানি পরিবেশে, ঈমানি তারবিয়াত গ্রহণ করতে হবে।
মনস্তত্ত্ব ও নৈতিকতার ইতিহাস মানুষের মধ্যে মানবিক বিচ্যুতি ও নৈতিক স্খলনের পথে যতগুলো প্রতিরোধকের সাথে পরিচিত হয়েছে তন্মধ্যে ঈমানই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও শক্তিশালী প্রতিরোধক। আমরাও যদি ঈমান অর্জন করতে পারি, গুনাহের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ফিরে আসতে সচেষ্ট থাকি, তাহলে ইনশা আল্লাহ শুধু জুয়া নয়, সব অনাচার থেকেই আমরা মুক্তি পাবো। লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক