৯ মে ইমরান খান গ্রেফতার হওয়ার পর আদালতের মাধ্যমের মুক্তি পেলেও তার দলের প্রায় সব সিনিয়র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ গ্রেফতারের সর্বশেষ সংযোজন পিটিআই-এর প্রেসিডেন্ট পারভেজ এলাহি। ১ জুন লাহোরে পারভেজ এলাহির বাসভবনের বাইরে থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে পাকিস্তানের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ‘অ্যান্টি করাপশন অ্যাস্টাব্লিশমেন্ট’। পাকিস্তানের গুজরাট জেলার জন্য বরাদ্দকৃত উন্নয়ন তহবিল থেকে ৭ কোটি রুপি আত্মসাতের এক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর এসব নেতা সেনাবাহিনীর ভয়ে এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন যে, নিজেদের সেনা কর্তৃপক্ষের একজন ঘোরতর সমর্থক হিসাবে পরিচয় দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পারভেজ এলাহির আগে যারাই গ্রেফতার হয়েছেন, তারা প্রায় সবাই বিবৃতির মাধ্যমে ইমরান গ্রেফতার হওয়ার পরের সহিংস ঘটনায় নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। পারভেজ এলাহির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। গ্রেফতার হওয়ার পরদিন নিজেকে তিনি নির্দোষ ও পাকিস্তান সেনাসমর্থক বলে দাবি করেন। গ্রেফতারের পর অনেক নেতাই মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বেরও হয়ে আসেন। মুক্ত হওয়ার পরই তারা ইমরানের সঙ্গ ত্যাগ করার ঘোষণা দিয়ে বিবৃতি দেন। এর মধ্যে আছেন ইমরান সরকারের সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও পিটিআই-এর মুখপত্র ফাওয়াদ চৌধুরী, শিরিন মাজারি, ইমরান ইসমাইল, আমির কিয়ানি এবং মেহমুদ মৌলবির মতো সিনিয়র নেতারা। জানা যায়, এসব সিনিয়র নেতা সেনাবাহিনীর চাপে ইমরানের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এখন তারা ইমরান খানকে নিজ দল পিটিআই থেকে সরিয়ে দিতে তৎপরতা শুরু করেছেন।
পার্টির সিনিয়র নেতাদের পিটিআই ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ইমরান তার নিজের ও দলের জনপ্রিয়তার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, তার আর তাদের প্রয়োজন নেই। তিনি আস্থার সঙ্গে বলেন, দেশে পিটিআই-এর বৃহত্তম ভোটব্যাংক রয়েছে। অতএব কে দল ছেড়ে চলে গেল এবং কে এসে যোগ দিল, এসবে কিছু যায়-আসে না। ইমরান বেশ আশাবাদী আসন্ন নির্বাচনে তার দল জয়লাভ করবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনীর ভয়ে রাজনৈতিক নেতারা যে যাই বলুক না কেন, গ্রেফতারের পর দেশের নাগরিকদের ভেতর ইমরানের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেছে; বিশেষ করে তরুণ সমাজের ভেতর। তাদের মধ্যে যারা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাদের ভেতর ইমরানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় এবং কোনো মহলের হস্তক্ষেপ না থাকে, তাহলে ইমরানের পিটিআই-এর জয়লাভের সম্ভাবনা বেশি বলে দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ঠিক এখানেই সেনাবাহিনীর আপত্তি। ৯ মে ইমরান গ্রেফতার হওয়ার পর যে হারে চারদিকে জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে; বিশেষ করে সেনাছাউনি ও সেনা আবাসিক ভবনে যেভাবে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, তাতে পিটিআই-এর প্রতি, বিশেষ করে ইমরানের প্রতি সেনা কর্তৃপক্ষ তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। যদিও গ্রেফতার হওয়ার পর ইমরানের পক্ষে সম্ভব ছিল না দলের সমর্থকদের নির্দেশনা দেওয়ার। তখন দলের সিনিয়র নেতারাই দল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন। কাজেই তখন যা কিছু ঘটেছে তা ইমরানের অনুপস্থিতিতেই ঘটেছে। সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে সেনাছাউনি হামলায় ইমরানকে প্ররোচনাকারী হিসাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। দোষ যদি কাউকে দিতেই হয়, তাহলে সেসময় দলের সিনিয়র নেতাদেরই দিতে হয়। কিন্তু সেনা কর্তৃপক্ষ পুরো পরিস্থিতিকে এভাবে বিবেচনা করতে নারাজ। তারা মনে করেন, ইমরান গ্রেফতার হওয়ার আগে সেনাপ্রধানসহ সেনাবাহিনী সম্পর্কে যে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে তার দলের কর্মীরা প্ররোচিত হয়েছে এবং তার গ্রেফতারের পর তারা সেনাছাউনির ওপর চড়াও হয়েছে। কাজেই এসব অঘটনের জন্য কাউকে দোষী করতে হলে ইমরানকেই করতে হয়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে খ্যাপিয়ে তোলার জন্য ইমরানই দায়ী। ইমরান অবশ্য সে দেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল, সে প্রসঙ্গও তুলে আনেন। তিনি সেসময়ে পাকিস্তানকে দুভাগ করার জন্য সেনাবাহিনীর ভূমিকাকেই দায়ী করেন। তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে আরও বলেছেন, সে সময় বঙ্গবন্ধুকে যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হতো, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ হতো না এবং বাংলাদেশ স্বাধীনও হতো না। রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তো হয়ইনি বরং উলটো সমগ্র বাঙালি জাতির ওপর জুলুম চালানো হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজনীতিতে আজও সেই নগ্ন হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে।
সেনাবাহিনী এটি বুঝেছে যে, ইমরান যদি দলের নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে আগামী নির্বাচনে তাকে ও তার দলকে ঠেকানো যাবে না। সিনিয়র নেতারা দলে না থাকলেও ইমরান যে কোনোভাবেই হোক দলকে গুছিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করে ফেলবেন। কাজেই, যে করেই হোক তাকে দলের নেতৃত্ব থেকে সরাতে হবে। সে প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে দলত্যাগী নেতা ও কর্মীদের সংগঠিত করে দলের নেতৃত্বের পরিবর্তন করতে চাচ্ছে সেনাবাহিনী। অর্থাৎ ইমরানকে সরিয়ে অন্য কাউকে বসাতে চাচ্ছে। এ ধরনের পরিকল্পনার পেছনে সরকারি জোটের যে সমর্থন আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বিরাজমান পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে সরকারি জোটও চাচ্ছে পিটিআই ভেঙে যাক অথবা দলের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে রাজনীতিতে ইমরানকে আরও বেশি দুর্বল কর ফেলা হোক। এ তৎপরতা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এর নেতৃত্বে রয়েছেন ফাওয়াদ চৌধুরী। ৩১ মে আদিয়ালা কারাগারে বন্দি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পিটিআই-এর ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদ কোরেশির সঙ্গে বৈঠক করেছেন ফাওয়াদ চৌধুরী। বৈঠকে ফাওয়াদ কোরেশিকে ইমরানের সঙ্গ ত্যাগ করে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে অনুরোধ করেন। ইমরানের সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি হননি কোরেশি। একথা নিশ্চিত করেছেন কোরেশির ছেলে। তিনি জানিয়েছেন, ‘শাহ কোরেশি একটি আদর্শের নাম। তিনি রাজনীতি করেন নীতি এবং আদর্শের জন্য। তার রাজনীতি কোনো পদ বা লোভের জন্য নয়। শাহ কোরেশি দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট, আমরা ইমরান খান ও পিটিআই-এর আদর্শের সঙ্গে আছি।’
এ প্রসঙ্গে ইমরান খান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ক্ষমতাসীনরা পিটিআইকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তিনি তার দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার এবং তাদের সেনা-আইনে বিচারের নিন্দা করেন। তিনি এ বলেন, দেশে এখন ‘সেমি মার্শাল ল’ চলছে। বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক আদালতে বিচারের নিন্দা করে বলেন, সেনাবাহিনী ও শাহবাজ শরিফের এ পদক্ষেপ নওয়াজ শরিফের লন্ডন পরিকল্পনারই অংশ। এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি, ৯ মে ইমরানকে গ্রেফতারের পর দেশজুড়ে সহিংসতা চালায় ইমরানের সমর্থকরা। ওসব ঘটনায় ইমরানের বহু সমর্থককে গ্রেফতারের পর সামরিক আদালতে বিচারের জন্য সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ১ জুনও পাঁচজনকে সেনাদের হাতে তুলে দেয় মুলতান পুলিশ। ইমরান সমর্থকদের সামরিক আদালতে বিচার করার পেছনে বিশেষ একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। এ বিচারব্যবস্থা সাধারণ মানুষের জন্য সতর্কবার্তা হিসাবে কাজ করবে। সামরিক আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনী সম্ভবত এ বার্তাই দিতে চাচ্ছে যে, পাকিস্তানে রাজনীতি করতে হলে সেনাবাহিনীকে তোয়াক্কা করেই করতে হবে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবকে কেউ খর্ব করার চেষ্টা করলে তাকেও একই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। সেনাবাহিনী ইমরানের সমর্থকদের বিচার করেই বসে থাকবে না। আগামী নির্বাচনে ইমরান যেন কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতায় আসতে না পারেন সে ব্যবস্থাও করবে। যদিও ক্ষমতাসীন জোট পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির সঙ্গে আগে থেকেই সেনাবাহিনীর সুসম্পর্ক না থাকলেও, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব বজায় রাখার স্বার্থে বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইমরান কী করবেন? তার সামনে কী কী অপশন খোলা আছে? শতাধিক মামলা মাথায় নিয়ে তিনি কি পারবেন ক্ষমতাসীন জোট ও সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করতে? তিনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ক্ষমতাসীন জোটের সঙ্গে আলোচনায় বসার অনুরোধও জানিয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন জোট তার সে অনুরোধ রক্ষা করেনি। ইমরান সেনাবাহিনীর সঙ্গেও আলোচনার আশা ব্যক্ত করেছিলেন। সে বিষয়েও কোনো অগ্রগতি হতে দেখা যায়নি। এদিকে পাঞ্জাব প্রদেশের সাবেক ২৬ জন এমপিএ পিটিআই ত্যাগ করেছেন। যদিও ইমরান অভিযোগ করেছেন, তার দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জোরপূর্বক দলত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। দলত্যাগ করা এ নেতারা এখন পাকিস্তান মুসলিম লীগ কায়দে (পিএমএল-কিউ) দলে ভিড়তে চাচ্ছেন। তারা আগামী নির্বাচনে পিএমএল-কিউ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার আবেদনও জানিয়েছেন। পিএমএল-কিউ তাদের গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে। দলত্যাগী এ ২৬ জন সাবেক এমপিএ সবাই দক্ষিণ পাঞ্জাবের রাজনীতিক। জানা গেছে, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ পিটিআই থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভাগিয়ে নেওয়ার কাজগুলোর সার্বিক সমন্বয় করছে।
এমন পরিস্থিতি নিশ্চিতভাবেই ইমরানের জন্য সুখকর নয়। তার হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক এখন কারাগারে বন্দি। দলের নেতৃত্ব থেকে দেড় ডজনেরও বেশি নেতা ইতোমধ্যে দলত্যাগ করেছেন। গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি। কোরেশিসহ যেসব নেতা শেষ পর্যন্ত দলত্যাগ করবেন না, তাদেরও সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে বলে অনুমান করা যাচ্ছে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে ইমরানকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তিনি তার রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে আলোচনা যে করবেন সে সুযোগও নেই। তাকে সবার কাছ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করেই রাখা হয়েছে। এমন গভীর সংকটের মধ্যেও ইমরান হাল ছাড়েননি। ক্রিকেটে তিনি যেভাবে দেশের জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, ঠিক তেমনই তিনি তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে এ সংকটকালে দলকে নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছেন। সম্প্রতি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান বলেছেন, এটি আমার জন্য বড় সংকট বলে আপনি মনে করতে পারেন, কিন্তু আমি তা মনে করি না। তিনি দল গোছানোর পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘প্রথমত যারা চলে গেছেন, শূন্য হওয়া সেসব পদ পূরণ করব তরুণ ও নতুন নেতাকর্মী দিয়ে। কিন্তু আমি জানি, তারাও গ্রেফতার হবে। এসব সরকারের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। এসব পুরোনো কৌশল। আমি শুধু পরিস্থিতি দেখছি। অপেক্ষা করুন এবং দেখুন। তারা হয়তো আমাকেও জেলে ঢোকাবে। কিন্তু এসব মেনেও নেব না এবং নীরবও থাকব না।’ ইমরানের কথায় দৃঢ়তা প্রকাশ পেলেও পাকিস্তানের বাস্তবতা হলো সেনাবাহিনীকে চটিয়ে কেউ রক্ষা পায়নি। ইমরানও ব্যতিক্রম নন। ক্ষমতাসীন জোট ও সেনাবাহিনী পিটিআই ভাঙার কাজটি যদি ভালোভাবে শেষ করতে পারে, তাহলে ইমরানের জেলে যাওয়ার সময় হয়তো কিছুটা পেছাতে পারে। তা না হলে তিনিও যে কোনো সময় জেলে ঢুকতে পারেন; সে কথা ইমরান নিজেই বিবিসিকে বলেছেন। একেএম শামসুদ্দিন: অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা