রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩০ অপরাহ্ন

ইমাম খোমেইনী (রহ.): এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী নেতা

সাইয়্যেদ রেযা মীর মোহাম্মদী
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩

৪ জুন এমন এক মহান ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং ইরানে ইসলামী বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করে ইতিহাস সৃষ্টিকারীতে পরিণত হয়েছেন। এই মহান ব্যক্তিত্ব ও অনন্য রাজনৈতিক নেতা হলেন ইমাম খোমেইনী (রহ.), যিনি আন্দোলন শুরু করতেই সারা বিশ্বের দৃষ্টি চলে গিয়েছিল তার দিকে এবং বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোর শীর্ষ খবরে স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।
যদিও এই মহান ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক নেতা ১৯৮৯ সালের ৪ জুন এই নশ্বর জীবনকে বিদায় জানিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন, কিন্তু তার নাম ও স্মৃতি আজও এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে অনুপ্রেরণা হয়ে। আজ এই মহান ব্যক্তির মৃত্যুর ৩৪ বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু তার নাম ও স্মৃতি সামান্যতমও ম্লান হয়ে যায়নি এবং খোমেইনী (রহ.) শব্দটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী হিসেবেই বিদ্যমান রয়েছে। তার আদর্শের সন্তান ও সৈনিকরা তার দেখানো পথকেই অব্যাহত রেখেছে।
ইমাম খোমেইনী (রহ.) এর ব্যক্তিত্ব ও তার পরিচয় নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন যে, এই ব্যক্তি একাকী কীভাবে এমন অভ্যুত্থান ঘটালেন। অথচ, তার না ছিল কোনো রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, আর না ছিল কোনো আর্থিক শক্তি ও সামর্থ্য। তারপরও তিনি কীভাবে একটি বিস্ময়কর কাজ সম্পন্ন করলেন, একটি বৃহৎ বিপ্লবের সূচনা করে তার বিজয় ছিনিয়ে আনলেন।
এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, ইমাম খোমেইনী (রহ.) তার শক্তিকে খোদার শক্তির সাথে সংযুক্ত করেছিলেন এবং সৃষ্টিকর্তার অসীম শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপনের ফলে সৃষ্টিকর্তাও তার হাত ধরেছিলেন এবং একটি জাতিকে তার পিছনে দাঁড় করিয়েছিলেন, যাতে তার হাতেই এই মহান বিপ্লব সংঘটিত হয়।
ইমাম খোমেইনী (রহ.) এই মহান বিপ্লব সংঘটিত করার মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করেন এবং একটি বিদ্যাপীঠ ও আলোর দিশারী হয়ে তিনি ইতিহাস জুড়ে বিশ্বের সত্য সন্ধানকারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। ইতিহাসে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নামের অমরত্ব এবং তার পথের স্থায়িত্ব তার ব্যক্তিত্ব এবং আল্লাহ্র প্রতি তার ঈমান ও অগাধ বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত। খোদার রঙ ধারণ করা এবং আল্লাহ্র জন্য সবকিছু করাই ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নামের মহত্ত্বের রহস্য।
তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি রাজনীতিকে ধর্মের সাথে সংমিশ্রিত করেছিলেন এবং তার রাজনৈতিক আচরণের পাশাপাশি ব্যক্তিগত আচার-আচরণে তিনি ধর্ম ও ইসলামী নীতি-নৈতিকতাকে তার কাজের ভিত্তি বানিয়েছিলেন। সমসাময়িক যুগে যদি এমন একজন ব্যক্তির উদাহরণ দেওয়া যায়, যার মধ্যে একজন পরিপূর্ণ মানুষের সমস্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ইমাম খোমেইনী (রহ.)।
তিনি নবী বা মা‘সুম ইমাম ছিলেন না। কিন্তু নবী ও মা‘সুম ইমামের মতোই জীবনযাপন করেছেন এবং কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী একজন নেতা হিসেবে তার মিশন পূরণ করেছেন। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনিই কাছ থেকে তার কথা ও আচার-আচরণ প্রত্যক্ষ করতেন, আল্লাহ্র প্রেরিত নবী এবং নিষ্পাপ ইমামদের স্মরণে পড়ে যেতেন। এই মহান ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী মানুষটি তার অন্তর ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে নবী (সা.) ও মা‘সুম ইমামদের অত্যন্ত কাছাকাছি ছিলেন। সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত, কিছুই এবং কেউ তার জন্য কর্মের মানদ- ছিল না এবং তিনি দুনিয়ার কোনো শক্তি ও সরকারকে ভয় পেতেন না। যে মানুষটি আত্মবিশ্বাসের সাথে এবং সাহস ও নির্ভীকতার শিখরে উঠে বিশ্বের পরাশক্তিকে বলে যে, তুমি কোনো ভুল করতে পারবে না এবং তিনি তার এই কথাকে কাজেও প্রমাণ করে দেখান যে, তিনি একজন অনন্য নেতা এবং তার মহত্ত্ব কারও সাথে তুলনা করা যায় না।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মহান কাজ, অর্থাৎ ইরানের ইসলামী বিপ্লব ছিল তার ব্যক্তিত্বের আধ্যাত্মিক মহিমা ও মহত্ত্বের কাছে ঋণী, ইতিহাসে যার মতো এবং যার কর্মের মতো নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তিনি এমন পরিস্থিতিতে জয়লাভ করেছিলেন এবং দেশি-বিদেশি উভয় ফ্রন্টকেই পরাজিত করেছিলেন, যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উভয় পরাশক্তি তার সামনে বিদেশি ফ্রন্ট হিসেবে দাঁড়িয়েছিল এবং পাহলভি সরকার তার সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে ইরানের অভ্যন্তরে তার সাথে লড়াই করেছিল। মানব ইতিহাসে কোনো বিপ্লবে এমন অবস্থা দেখা যায়নি এবং কোনো নেতাই এত বড় ও মহৎ কাজ করতে পারেননি।
ইমাম খোমেইনীর ব্যক্তিত্বের দিকগুলো নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়টির প্রতি জোর দেওয়া প্রয়োজন, তিনি শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না এবং একজন একমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং প্রকৃত অর্থে একজন কামিল মানুষ। রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ ও সাহসী নেতা। কোনো পরাশক্তিই তাকে বশ্যতা স্বীকার করাতে ও ভয় দেখাতে পারেনি এবং নিজেদের ইচ্ছাকে তার উপর চাপিয়ে দিতে পারেনি। সামাজিক দিক থেকেও তার ব্যাপক প্রভাব ও পূর্ণ গ্রহণযোগ্যতা ছিল এবং তার শক্তিশালী ও বিশেষ আকর্ষণক্ষমতা সমাজের সকল স্তরকে আকৃষ্ট করেছিল এমনভাবে যে, তার এক বাক্যে সকলে দৃশ্যপটে উপস্থিত হয়ে তার নির্দেশ পালন করতেন। বিশ্বাসের দিক থেকে তিনি একজন একত্ববাদী এবং আল্লাহ্বিশ্বাসী নেতা ছিলেন এবং তিনি খোদায়ী সাহায্যের প্রতিশ্রুতির প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন এবং আল্লাহ্ ছাড়া তিনি আর কিছুকেই কার্যকর বলে মনে করতেন না। নৈতিকতার দিক থেকে তিনি ইসলাম ও মানবিক নৈতিকতাকে সম্পূর্ণরূপে মেনে চলতেন এবং কোনো অবস্থাতেই তিনি নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করেননি।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন দয়ালু ও সহানুভূতিশীল এবং অতুলনীয় সরল, ক্ষমাশীল ও সহনশীল পিতা ও স্বামী। উপাসনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভীতি ও ভয়ের অধিকারী ব্যক্তি, রাত জেগে তিনি আল্লাহ্র এবাদতে মশগুল থাকতেন। জ্ঞানগত দিক থেকে তিনি একজন তুলনাহীন মুজতাহিদ ও ফকিহ্ এবং ইসলামী বিশ্বের শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে সেরা শিক্ষাগুরু হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন।
তার অস্তিত্বে এতসব বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ এই মহান মানুষটিকে এমন এক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল যে তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লের মতো একটি মহান বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করার সক্ষমতা রাখতেন এবং তার এই অনন্য ভূমিকা সমসাময়িক ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়। ইমাম খোমেইনী (রহ.) এর আন্দোলন ও বিপ্লবের ফলে ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং ইসলামী বিশ্বের মুসলমানরা ফিরে পায় তাদের সম্মান ও মর্যাদা। এর ফলে প্রকৃত ইসলামের ভিত্তিতে ইসলামী বিপ্লবের ডকট্রিন হিসেবে বিশ্বে একটি নতুন ডকট্রিনের উদ্ভব ঘটে, যা অমুসলিমদের জন্যও ছিল নতুন। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের দুইটি ডকট্রিন এবং চিন্তাধারার পাশাপাশি এই মতামতও তাদেরকে আকৃষ্ট করেছিল।
ইমাম খোমেইনী (রহ.) সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত লেখনি থেকে বলা যায়, একজন নিখুঁত ও মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইমাম খোমেইনী (রহ.) একটি বৃহৎ বিপ্লব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক ও ইতিহাস বিশ্লষকদের সেই পুরানো প্রশ্ন ‘ইতিহাস কারা সৃষ্টি করে’Ñ এর জবাব দিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে ইতিহাস ওইসব নেতাই সৃষ্টি করেন, যারা শুধুমাত্র আল্লাহ্র উপর পূর্ণ আস্থা ও ভরসা করেন এবং জনগণকে সুসংগঠিত করার ক্ষমতা রাখেন। তারা নিজেকে এবং জনগণকে মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে এমন এক শক্তি তৈরি করেন, যা বস্তুগত বিচারে অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু তারা তা সম্ভব করেন এবং ইতিহাস নির্মাতা হয়ে ওঠেন। লেখক: কালচারাল কাউন্সেলর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com