সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৭ অপরাহ্ন

ঢাকার পানি সঙ্কট

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩

পানির অপর নাম জীবন। পানির অভাবে জীবন মরুময়। পৃথিবীর ৫ ভাগের ৩ ভাগই পানি। মানব শরীরের ৭০ শতাংশই পানি। জীবনের অস্তিত্বের সূচনা পানি থেকে। মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি সমস্ত প্রাণীকে সৃষ্টি করেছি পানি থেকে।’ (২১ : ৩০) এবং ‘আল্লাহ প্রতিটি প্রাণীকে তৈরি করেছেন পানি থেকে।’ (২৪ : ৪৫) সূরা ফুরকানে বলা হয়েছে- ‘তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে’। এভাবেই পানির গুরুত্ব পরম করুণাময় স্রষ্টার কাছ থেকে বর্ণিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে খাওয়ার জন্য, অজু, গোসল, কাপড় কাচা, রান্না, প্রাত্যহিক প্রাকৃতিক প্রয়োজনে পানি মুখ্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন নির্মাণকাজ যেখানে রয়েছে পানির মুখ্য ভূমিকা। কৃষি কাজ, মাছচাষ, বনায়ন, ধোয়ামোছা পানি ছাড়া চিন্তাই করা যায় না। প্রতিটি জনপদে বিশেষ করে শহুরে জনপদে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজন শহরের আয়তনের মোট ১৫ শতাংশ জলাধার। প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা এবং বৃষ্টিপাতের জন্য প্রয়োজন আনুপাতিক পানির সহজলভ্যতা।
২০১৯ সালে ইধহমষধফবংয ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ চষধহহবৎং (ইওচ) পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর প্রাকৃতিক জলাধারের মোট আয়তন ৪.৩৮ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে যা ছিল ১৪.২৫ শতাংশ, ২০০৯ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৫.৭৩ শতাংশে। ২০১৯ সালের ৪.৩৮ শতাংশের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ২০১৯ থেকে আজ পর্যন্ত গত চার বছরে তা আরো কমেছে নিঃসন্দেহে। এই হিসাবে ঢাকা শহর গত ২০ বছরে ৭০ শতাংশ স্থলভাগের উপরস্থিত পানি হারিয়েছে। সরকার ২০০০ সালে মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে জলাধার সংরক্ষণ আইন প্রবর্তন করে। ২০১০ সালে সংশোধন করে এতে শাস্তির বিধান রাখা হয়। জলাধার ভরাট করলে ন্যূনতম পাঁচ বছরের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয় এতে। আজ পর্যন্ত এই আইনে কাউকে সাজা দেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। পক্ষান্তরে ঢাকা শহর তার জলাধারগুলো হারিয়েছে নগরায়ণের যূপকাষ্ঠে। ধোলাইখাল এখন ইতিহাস। একই কথা প্রযোজ্য মতিঝিল এলাকার ঝিলগুলোর ক্ষেত্রেও। পান্থপথ গিলে খেয়েছে এর দুই পাশের বিশাল জলাধারকে। বেগুনবাড়ি খালের স্থানও ইতিহাসে। সবচেয়ে নির্মম রসিকতা হয়েছে বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগের ক্ষেত্রে। সরু হতে হতে দখলদারিত্বের পাল্লায় কোথাও কোথাও সরু খালে পরিণত হয়েছে। পুরান ঢাকার খালগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন স্বাভাবিক পানি প্রবাহকে বন্ধ করে জলাভূমি ভরাট করছে গাবতলীতে; গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়বে বলে। হারিয়ে গেছে বিমানবন্দর রেল সড়কের বনানী বিমান বন্দর অংশের খাল। বিমানবন্দর সম্প্রসারণের জন্য বলাকা ভবনের পেছনের পুকুর ভরাট হয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়েছে পরিকল্পিত বনাঞ্চল। আশুলিয়া, আমিনবাজার, পূর্বাচল, উত্তরা ১০নং সেক্টরের পুলিশ আবাসন এলাকা, আসিয়ান সিটি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ৩০০ ফুট চওড়া সড়ক, সবই একসময়ের জলাধার। কুড়িল ফ্লাইওভারের জন্য হারিয়ে গেছে এলাকার জলাভূমি। এসব এলাকা বিভিন্ন সরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকা অবস্থায় এগুলোকে ভরাট করে প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগই। এভাবে রক্ষকরাই ভক্ষক হয়ে জলাধারগুলোকে ভরাট করেছে। রাজউক, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, পুলিশ- কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি; একমাত্র ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র ছাড়া। জলধার ভরাটের পরিণতি ঢাকাবাসী এবার প্রত্যক্ষ করেছেন পুরান ঢাকার দু’টি মর্মান্তিক অগ্নিকা-ের মধ্য দিয়ে। আগুন নেভানোর পানির দু®প্রাপ্যতা আগুনের সর্ব ধ্বংসী লেলিহান শিখাকে যেন আরো উসকে দিয়েছিল। মুহূর্তেই হাজার হাজার লোকের পরিশ্রমের ফসল, স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল তাদের অসহায় দৃষ্টির সামনে। পৃথিবীর প্রতিটি বড় বড় শহরে জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য রয়েছে বিকল্প ব্যবস্থা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো ফায়ার হাইড্রেন্ট; যা ঢাকা মহানগরীর মতো একটি বর্ধিষ্ণু নগরের নগর পরিকল্পনার আছে কি না সন্দেহ।
আরো একটি দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, প্রতি বছর ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গড়ে দুই-তিন মিটার নেমে যাচ্ছে। গত ৪০ বছরে পানির স্তর নেমেছে ৫০ মিটার। বর্তমানে জায়গা ভেদে ঢাকা শহরে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩৮ থেকে ৮২ মিটার। ফলে অনেক জায়গায় পানির সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। পানি সরবরাহের জন্য যদি এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার বাড়তেই থাকে তাহলে এক সময়ে ঢাকা শহর ধসে যেতে পারে যে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে নিউইয়র্ক সিটি। সেখানে বহুতল ভবনের আধিক্যে শহরটি দেবে যাওয়ার সমস্যার মুখোমুখি। ঢাকা মহানগরে সমস্য দ্বিমুখী। প্রথমত, পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, বহুতল ভবনের আধিক্য। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বেশ কিছু পানি শোধনাগার স্থাপন করা দরকার যেন নদীর পানি পরিশোধনের মাধ্যমে সরবরাহ করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের ব্যবহৃত পানি পরিশোধন করে সেচের কাজে শৌচাগারে বা রাস্তায় পানি দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। লেখক নিজেই প-িচেরিতে এ ধরনের এক বিশাল ব্যবস্থাপনা দেখে এসেছেন। বিভিন্ন স্থাপনার পানির কল ম্যাগনেটিক করা বাধ্যতামূলক করা দরকার যেন প্রয়োজনের বাইরে কোনো পানি ব্যবহৃত না হয়। শুধু এই প্রক্রিয়ায় ১৫-২০ শতাংশ পানির চাহিদা মেটানো যেতে পারে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ব্যবহার আরো একটি বিকল্প ব্যবস্থা। তবে এতে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাতের দরকার ঢাকায় গত কয়েক বছর ধরে সমপরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে না। জলাধার সংরক্ষণ আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারি দফতর এবং ক্ষমতাশালী, দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আইনের আওতায় আনা দরকার। দখল হয়ে যাওয়া খাল ও পুকুরগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে উদ্ধার এবং সংস্কার করে প্রাকৃতিক রূপে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে সবুজের বাতাবরণ তৈরি করা দরকার এলাকাভিত্তিক। প্রয়োজনে সবুজায়ন প্রক্রিয়ার জন্য কাউন্সিলরদের মধ্যে সবুজ পদক প্রদানের নিয়ম চালু করা যেতে পারে। দিন দিন বাড়ছে ঢাকা মহানগরীর আয়তন, বাড়ছে নগরবাসীর সংখ্যা, বাড়ছে পানির চাহিদা। এ ক্ষেত্রে চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করা, পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার নীতিমালা তৈরি অত্যন্ত জরুরি। এটি শুধু ঢাকা মহানগরের জন্য নয়, সারা দেশের জন্য করা প্রয়োজন। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com