ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠতো খোকা কেঁদে/ দু’হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেঁধে/দু’হাত আজো খোঁজে, ভুলে যায় যে একদম/আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম।
নচিকেতার গানেরই যেন বাস্তব প্রতিচ্ছবি মো. রফিকুল ইসলাম। বয়স ৬৭। পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। ঢাকার বড় বড় হাসপতালে কাজও করেছেন। সাংসারিক জীবনে চার ছেলে সন্তানের বাবা তিনি। দুই ছেলে চিকিৎসক এবং দুই ছেলে প্রকৌশলী। তারা সকলেই সপরিবারে থাকেন আমেরিকায়। গত চার বছর আগে সন্তানরা তার মাকেও নিয়ে চলে যায় আমেরিকা। এখন বাবা একা স্মৃতিকাতর হয়ে দিনযাপন করছেন বৃদ্ধাশ্রমে।
রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি আজিমপুর থাকতাম। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও। একসময় তার বহু বন্ধু স্বজন ছিলো। দুই ছেলেকে ঢাকায় পড়াশোনা করিয়েছি এবং দুই ছেলে পড়াশোনা করেছে আমেরিকায়। রফিকুল ইসলাম ব্রেইন স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকেও আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার কথা দিয়েছিলো ছেলেরা কিন্তু শেষ পযন্ত আর নেয়নি। ব্রেনে সমস্যা হওয়ার পর স্ত্রী এবং সন্তানরা রেখে চলে গেছে। ঠিকভাবে ছেলেদের নামও মনে করতে পারে না। বাবার এই করুণ সময়ে তাদের কোনো খোঁজ না পেয়ে হতাশায় কাঁদছেন তিনি।
রফিকুল ইসলাম আরো বলেন, আমার যতো উপর্জিত সম্পদ ও নগদ টাকা নিয়ে চলে গেছে তারা। সব নিয়ে যাক কোনো আপসোস নেই। কিন্তু এই বাবাটার তো খোঁজখবর রাখবে তারা। তাও রাখেনি। এতো কিছুর পরও বাবা হিসাবে আমি এখনো সবসময় চাই আমার ছেলেরা ভালো থাকুক। আমি চাই ওরা এসে আমাকে নিয়ে যাক। আমি যে ওদের বাবা এটা স্বীকৃতি দিক, বাবা হিসাবে এখন এটুকুই চাই। এই বৃদ্ধাশ্রমে নামাজ পড়ে, বই পড়ে এবং পত্রিকা পড়েই সময় কাটানোর চেষ্টা করি কিন্তু সময় কাটে না। মনে পড়ে স্ত্রী-সন্তানদের কথা।
রফিকুল ইসলামের মতো এমন ১১০ জন বাবার ঠাঁই এখন গাজীপুরের সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। গত শনিবার (১৭ জুন) সেখানে গিয়ে কথা হয় এ সকল বাবাদের সাথে। এসব বাবার জায়গা হয়নি তাদের সন্তানদের বাড়িতে। বাধ্য হয়েই অনেকে নিজে থেকে আবার কোনো কোনো সন্তান বোঝা মনে করে পিতাকে রেখে গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। এখন তাদের কাছে এই বৃদ্ধাশ্রমই হয়ে উঠেছে আপন ঠিকানা। বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় বসে পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিচারণ করে কাটিয়ে দেন সময়। কেউ কেউ অভিমানে মুখ খোলেন না। কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে যান এসব বাবারা।
গাজীপুর সদরের মণিপুর বিশিয়া এলাকার খতিব আবদুল জাহিদ ১৯৮৭ সালে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর এলাকায় ১২ কক্ষের একটি বাড়িতে কেন্দ্রটি স্থাপন করেন। ১৯৯৪ সালে কেন্দ্রটিকে মণিপুর বিশিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালে ২১ এপ্রিল শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মাদার তেরেসা কেন্দ্রটির সম্প্রসারিত অংশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় থেকেই কেন্দ্রটিতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলেছে সন্তানের কাছে আশ্রয় না পাওয়া এমন শতাধিক বৃদ্ধ বাবার। বর্তমানে এই কেন্দ্রে বৃদ্ধ পুরুষ রয়েছেন ১১০ ও নারী রয়েছেন ৯৭ জন।
বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কোন বাবারই সন্তানদের অভাব পূরণ করা যায়না, তবে আমরা চেষ্টা করি সর্বোচ্চ সন্তানের অভাব পূরণ করতে। এখানে যারা রয়েছেন- ভালো আছেন, আমাদের সবাইকে নিয়ে তারা ভালো থাকার চেষ্টা করেন। এ প্রবীণ নিবাসে ৬০ বছরের উপর বয়স হলেই যে কেউ বিনা খরচে থাকতে পারেন। এখানে থাকা অবস্থায় কেউ মারা গেলে আমরা পরিবারকে খবর দেই। কেউ নিয়ে যেতে চাইলে পাঠিয়ে দেই। আর না নিতে চাইলে এখানেই কবর দিয়ে দেওয়া হয়। তবে দুঃখ লাগে অনেকে মারা যাওয়ার পর পরিবারকে ফোন দিলে ধরেও না। ধরলেও মৃত্যুর সংবাদ শুনে ফোন বন্ধ করে দেয়।- রাইজিংবিডি.কম