বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৪:৩৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম ::
কালীগঞ্জে থামছে না কৃষি জমির মাটি কাটা কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় বাদাম চাষে আশার আলো দেখছেন কৃষকরা কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ সারেংকাঠী ও গুয়ারেখা ইউনিয়নে ঢল নেমেছে স্বচ্ছ মনের প্রার্থী আলহাজ্ব আঃ হকের পক্ষে শেরপুর পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র খোকনের দায়িত্ব গ্রহণ অধ্যক্ষ মুফতি মাওলানা বশির আহমদ উপজেলার পর এবার সিলেট বিভাগেরও শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসা প্রধান কালীগঞ্জের আল-জাছির হলেন দেশ সেরা কালিয়ায় মক্কীনগর কবরস্থানের উদ্বোধন ও দোয়া মাহফিল ঈশ্বরগঞ্জে প্রতীক পেয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীরা আরমান হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানবন্ধন

মুসলিম সভ্যতায় ভূগোলদৃষ্টি : স্বরূপ ও প্রভাব

মুসা আল হাফিজ
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৮ জুন, ২০২৩

‘দশম শতকের ইউরোপ আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার একটি মানচিত্র আঁকলে দেখা যাবে, মানুষের বসতিপূর্ণ যে অঞ্চল গ্রিকদের কাছে ‘ওইকডিমেন’ বলে পরিচিত, তা মুসলিম সভ্যতার অধীনে। বহু জাতি, বহু সম্প্রদায় ও বহুভাষী মানুষের সুবিশাল এই সাম্রাজ্যের পশ্চিম দিকে ছিল অ্যান্টি-এটলাস, আটলান্টিক উপকূলসহ আফ্রিকার পুরো উত্তর উপকূল। আরো দূরে অ্যাস্ট্রোবিয়া ছাড়া পুরো স্পেন, সিসিলি ও ক্রিট উপদ্বীপগুলো, সার্ডিনিয়া ও সাইপ্রাসও ছিল মুসলমানদের অব্যাহত অভিযানের আওতায়।
তেমনি অবস্থায় ছিল দক্ষিণ ইতালীয় উপকূল, যেখানে বারিসহ বহু শহর ছিল মুসলমানদের অধীনে, আমালফিসহ বহু শহর ছিল মুসলিম প্রভাবাধীন। মুসলমানদের স্থায়ী অধিকারে ছিল উত্তরের আর্মেনিয়া ও দক্ষিণপূর্ব ককেসাসসহ প্রাচীন সিরিয়া। আরো পূর্বে ইরাকসহ মেসোপটেমিয়া এবং তারপর আধুনিক পারস্য ও আফগানিস্তানের সব এলাকা। মুসলিম অধিকারে ছিল এসব দেশের উত্তর দিকের গোটা ট্রান্সঅক্সিয়ানা। পশ্চিমে খাওয়ারিজম ব-দ্বীপ অঞ্চল আর পূর্বে ফারগানার পার্বত্য উপত্যকা অঞ্চল ছিল মুসলিম অধীনে। ইতোমধ্যে অষ্টম শতকে সিন্ধু নদ অতিক্রম করে মুসলিম বিজয়। সিন্ধুদেশসহ এর ভাটি অঞ্চল আসে ইসলামের অধীনে।’
দশম শতকের মুসলিম বিশ্বের এমনই ছবি এঁকেছেন জে এইচ ক্রেমার্স। লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ও তুর্কি ভাষার প্রফেসর ক্রেমার্স প্রাচ্যবিদ হিসেবে বরেণ্য। টমাস ওয়াকার আর্নল্ড ও আলফ্রেড গিয়োম সম্পাদিত দ্য লিগ্যাসি অব ইসলাম গ্রন্থে প্রকাশিত ক্রেমার্সের ক্রুসেড শীর্ষক প্রবন্ধে দশম শতকের মুসলিম দুনিয়ার যে সীমা অঙ্কিত, তাতে মুসলিম দুনিয়ার বিস্তৃতির পুরো বাস্তবতা ধরা পড়েনি। এতে স্বাভাবিকভাবেই গরহাজির থেকেছে পরবর্তীতে মুসলিমশাসিত ভারত-বাংলাদেশ। এমনই গরহাজির ইউরেশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বহু অঞ্চল। যারা পরে মুসলিম সাম্র্রাজ্যের আওতায় এসেছে। তবুও এ একটি বিবরণ এবং এতে আমরা দেখতে পাচ্ছি তৎকালীন জ্ঞাত বিশ্বের প্রতিপত্তিশালী কেন্দ্রীয় শক্তিকে। যার ওপর নির্ভরশীল ইউরোপীয় বিশ্ব। ক্রেমার্স জানান, আমরা যদি ওই সময়কার খ্রিষ্টান ইউরোপীয় বিশ্বের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করি, তাহলে এই বিশ্ব বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের ওপর কতখানি নির্ভরশীল ছিল, তা সাথে সাথে উপলব্ধি করতে পারব। ওই সময় ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণে মুসলিম উপকূলগুলোর শাসকদের অধীনে একটি অপ্রতিরোধ্য প্রতিবন্ধকতা গড়ে ওঠে। উত্তর ককেসাস ও পূর্ব ইউরোপে যেসব অর্ধসভ্য জাতি বাস করত, তারা যতটা খ্রিষ্টান অধীনে ছিল, ঠিক ততটা মুসলিম প্রভাবাধীন ছিল।’
এ প্রভাব কি শুধু সাময়িক ব্যাপার? তার সুফল কীভাবে ভোগ করেছে ইউরোপ? কেমন ছিল এই প্রভাবের প্রতিফল? কতটা ছিল তার মাত্রা ও পরিমাণ? আন্দাজ পেতে আমরা কোনো মুসলিমের ভাষ্য আনছি না। আমরা শুনব ক্রেমার্সের কথা- ‘ইসলাম প্রায় সব দিক দিয়ে খ্রিষ্টান ইউরোপের সাংস্কৃতিক দিগন্তকে সীমাবদ্ধ করার পর প্রায় এক হাজার বছর অতিক্রান্ত। ইত্যবসরে ইউরোপ নৌপ্রদক্ষিণ করেছে এবং যে সব বাঁধা তাকে অজ্ঞাত বিশ্বের কথা বাদ দিলেও জ্ঞাত বিশ্বের দক্ষিণ ও পূর্ব অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেগুলোকে অতিক্রম করেছে। ইউরোপ এর অনেকখানি নিজস্ব শক্তি ও উদ্যোগেই করেছে। কিন্তু যারা একসময় বিশ্বের হর্তাকর্তা ছিলেন, তাদের দ্বারাও ইউরোপ অনেকখানি উপকৃত হয়েছে। তাই ভৌগোলিক জ্ঞান আবিষ্কার ও বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদেরকে তার সাংস্কৃতিক পূর্বপুরুষ হিসেবে দেখা ইউরোপের উচিত ছিল।’
এসব কর্মক্ষেত্রে আমাদের আধুনিক সভ্যতায় ইসলাম যে অবদান রেখেছে, তা আমাদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও নৌ-চলাচলের শব্দভা-ারে বহু মূল আরবি শব্দ থেকে বোঝা যায়। আমাদের প্রকৃত ভৌগোলিক জ্ঞান যে এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত, কেবল তার ঐতিহাসিক বিকাশ পর্যালোচনার মাধ্যমেই এ প্রভাবের গভীরতা প্রমাণ করা যায়।
কুরআন মাজিদ বারবার মুসলিমদের উদ্বুদ্ধ করেছে ভৌগোলিক অনুসন্ধানে। ভ্রমণ পর্যবেক্ষণ, বিশ্ববীক্ষণ ও প্রকৃতিচিন্তন কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছে। কুরআন আহ্বান জানিয়েছে, তারা কি পৃথিবীপৃষ্ঠে ভ্রমণ করেনি? অতঃপর দেখেনি তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণতি হয়েছিল?’ কুরআন দিয়েছে বহু শহরের বর্ণনা, সমুদ্র, চাঁদ, জোয়ার-ভাটা, নক্ষত্র, সূর্য, কক্ষপথ, মৎস্য, মণি-মুক্তা, পাহাড়, বৃক্ষ, মরুভূমি, প্রাণিজগৎ ইত্যাদির আশ্চর্য বর্ণনায় মুখরিত আল-কুরআন।
বারবার আহ্বান জানানো হয়েছে এসবের গবেষণায়। প্রকৃতির মুক্ত পাঠকে যুক্ত করে দেয়া হয় ইবাদতের সাথে। একে ঘোষণা করা হয় মহান পুণ্যের কাজ হিসেবে। অতীতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত অনুসন্ধান ও জনগোষ্ঠীগুলোর উত্থান-পতনের ভাষ্য দিয়েই থামেনি আল-কুরআন। তাদের অনুপুঙ্খ অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করেছে মুসলিমদের।
এ সবই দায়িত্বশীল যেকোনো মুসলিমকে ভূগোল ও ইতিহাসে উদ্বুদ্ধ ও যত্নবান করে। তাদেরকে ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি বিষয়ে করে তোলে আগ্রহী, ইতিহাসের প্রতিটি ধাপ উন্মোচনে করে তোলে কৌতূহলী। ফলে গ্রিকদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে যোগাযোগের বহু আগেই মুসলিমরা ভূগোল ও ইতিহাসচর্চা এবং গবেষণার গরিয়ান ঐতিহ্য রচনা করেন। গ্রিক বিজ্ঞান মুসলিমদের এ সবের ধারণা দিয়েছে বলে যে প্রচারণা, এর ভিত্তিহীনতা সুস্পষ্ট। পৃথিবী গোল হওয়া, দিন-রাতের বিবর্তন, পৃথিবীর ব্যাস, চন্দ্র-সূর্য থেকে তার দূরত্ব থেকে নিয়ে অসংখ্য ভৌগোলিক তত্ত্ব মুসলিমরা আবিষ্কার করেন, যা গ্রিকদের তত্ত্বের বিপরীত কিংবা গ্রিক, পারসিক ও রোমকদের কাছে যা ছিল অজানা। তবে ভূগোল বিদ্যায় গ্রিকরা যে ঐতিহ্য রেখে গিয়েছিলেন, একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন মুসলিমরা। তারা একে বৈজ্ঞানিক রূপ দেন এবং প্রকৃত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। ভূগোলবিদ্যার আদি প-িত ক্রাউডিয়াস টলেমিসহ আরো অনেকের রচনাবলি ধ্বংস ও বিস্মৃতির হাত থেকে উদ্ধার করেন মুসলিমরা। এগুলো সংগ্রহ, অনুবাদ, ব্যাখ্যা ও নবরূপে বিচার-বিশ্লেষণের কাজটি তারা করেন। ভূগোল জ্যোতির্বিদ্যাবিষয়ক গ্রিক প্রজ্ঞা এভাবেই নবজীবন পায়। নামাজ সময় নির্ধারণ, কিবলা নির্ধারণসহ বিবিধ ধর্মীয় প্রয়োজনে মুসলিমদের ভৌগোলিক জ্ঞানের আশ্রয় নেয়া জরুরি হয়ে পড়ে। তখন ঘড়ি ছিল না, দিক নির্ণয়ের যন্ত্র ছিল না, মুসলিমরা তাই আকাশে নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। দিক নির্ণয়ে ভৌগোলিক জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হতো। ‘প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে মুসলমানরা নিত্যনতুন গবেষণায় লিপ্ত হয়েছিল এবং নতুন নতুন সৃষ্টি সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছিল সভ্যতার অঙ্গন। দিক নির্ণয় যন্ত্র আবিষ্কার এমনই এক প্রয়োজন পূরণের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। অবশ্য ‘ম্যাগনেটিক নিডল’ সম্বন্ধে পূর্বজ্ঞান চীনাদের ছিল বলা হয়, তবে আরবরাই সর্বপ্রথম তাকে কৌটায় পুরে মরুভূমিতে যাতায়াত ও সমুদ্রে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এ ব্যাপারে প্রথম তথ্য পেশ করেন চীনের মি চু ইউ। ১১২০ শতকের পরে এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, বিদেশী নাবিকরাই সর্বপ্রথম ম্যাগনেটিক নিডলের ব্যবহার প্রচলন করেন। নবম শতাব্দীতে বিশেষ করে খলিফা আল-মামুনের সময় যখন বিশ্বের বৈজ্ঞানিক কাজগুলো বাগদাদে একত্র করা হলো এবং সেসবের অনুবাদ, বিচার-বিশ্লেষণ ও নবসৃষ্টির ধারা তৈরি হলো, তখন থেকে বিজ্ঞানের এক নবযুগের সূত্রপাত ঘটল। বিভিন্ন স্থানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের মানমন্দির নির্মিত হলো এবং গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আহ্বান জানানো হলো। আরবীয়রা শুধু প্রাচীন পুস্তকগুলোর অনুবাদগ্রন্থ ইউরোপকে দান করেনি; বরং তারা যা দান করেছিল, তা ছিল কয়েক সহস্র্র পর্যবেক্ষণকেন্দ্র ও গবেষণাগারের অনুধ্যান, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফসল। তারা দিয়েছিলেন প্রকৃতি জয়ের দৃষ্টি ও সূত্রাবলি। মুসলিম সভ্যতার প্রায় প্রত্যেক বিজ্ঞানীই গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্য-চন্দ্র থেকে নিয়ে পৃথিবীর মাটি, সাগর, বাতাস, আবহাওয়া, আকার-প্রকার, মাপজোক, জরিপ- কোনো কিছুই বাদ দেননি। মুসলমানরাই ভূগোলের গোলক ও মানচিত্র তৈরি করেন। বর্তমান ভূগোলের যতই উৎকর্ষ সাধিত হয়ে থাকে, এর বুনিয়াদ রচিত হয় কর্ডোভা-বাগদাদ-কনস্টান্টিনোপলে। মুসলিম সভ্যতায় প্রায় সর্বশ্রেণীর বিজ্ঞানীর প্রাণপণ সাধনাতেই আধুনিক ভূগোল শাস্ত্রের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে ভূগোল বিজ্ঞানের নির্ভুল প্রতিষ্ঠা ছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঠিক অবয়ব গড়ে উঠতে পারে না। এ জন্য মুসলিম বিজ্ঞানীরা ভূগোল বিজ্ঞানের ওপর জোর না দিয়ে পারেননি। কখনো মাটিকে বাদ দিয়ে আকাশে ওঠা যায় না। বনি মূসা ভ্রাতৃত্রয় পৃথিবীর মাটি, সাগর, আবহাওয়া ও আকাশতত্ত্ব গবেষণার জন্যই ভূমধ্যসাগরের তীরে তাদের গবেষণাগার স্থাপন করেছিলেন। শুধু তারাই নন, সমস্ত মুসলিম বিজ্ঞানীই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনে ভূগোল বিজ্ঞানের কমবেশি উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। যেমন অঙ্কশাস্ত্রকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের কোনো শাখার সাধনাই সম্ভব নয়, তেমনি ভূগোল শাস্ত্রকে বাদ দিলে জ্যোতির্বিজ্ঞান সাধনা সম্ভব হয় না। মুসলমানরা দেশ-মহাদেশ, সাগর-মহাসাগর, মাপ-জরিপ শেষ করে অবশেষে কাবা শরিফের দিক নির্ণয়ের ব্যাপারে তাদের বৈজ্ঞানিক অঙ্ক শক্তিকে ব্যবহার করেন। গ্রিকদের চেয়েও আরবদের ভূগোল বিজ্ঞান নিখুঁত ছিল। বিভিন্ন এলাকা আবিষ্কার ও উদ্ঘাটনে তাদের ভূমিকা ছিল অক্লান্ত। বহু দ্বীপ, জনপদ, দেশ ও অজানা অঞ্চল আবিষ্কৃত হয় তাদের দ্বারা। উচ্চকণ্ঠ দাবি তারা করতেন না কিন্তু তারা যে সব এলাকার যে বিবরণ রেখে যান, প্রমাণ হিসেবে তা প্রশস্ত। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকার অন্ধকার এলাকার কথা বলা যায়, ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের কথা বলা যায়, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের কথা বলা যায়, আরদ্বে মজহুলা তথা অজানা জগত বা আমেরিকার কথা বলা যায়। যেখানে তারা পা রেখেছিলেন কলম্বাসের বহু আগে।So, Who Did Discover America? শীর্ষক প্রবন্ধে ‘সেন্ট্রাল এশিয়া ককেসাস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ঐতিহাসিক এস ফ্রেডরিখ স্টার দেখিয়েছেন, ১৪৯৮ সালের অনেক আগেই আমেরিকা আবিষ্কার করেন আবু রাইহান আল বিরুনি। ৯৭৩ সালে আজকের মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে জন্ম তার। ফ্রেডরিখের দাবি, আবু রাইহানই এশিয়া-ইউরোপসহ পৃথিবীর অজানা ভূমি আবিষ্কারের প্রথম পথপ্রদর্শক। ১১ শতকে অজানা দেশ আবিষ্কারে অংশগ্রহণকারী আবু রাইহানের দৃষ্টি শুধু আমেরিকায় নয়; বরং পশ্চিম ইউরোপ থেকে শুরু করে পুরো আফ্রিকা, পূর্ব-এশিয়াসহ পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশের দিকে প্রসারিত ছিল। আবু রাইহান পৃথিবীর ঘূর্ণনের ব্যাপারে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তা আধুনিক তত্ত্বের সাথে প্রায় সম্পূর্ণ মিলে যায়। নিজ কক্ষে চলার পথে সূর্য ও পৃথিবীর সম্পর্ককে তিনি ব্যাখ্যা করেন নির্ভুলভাবে। তিনি পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি, নতুন পৃথিবী (নিউ ওয়ার্ল্ড) শব্দটির ধারণা দিয়েছেন। ফ্রেডরিখ দাবি করেন পৃথিবী ঘূর্ণনের এই তত্ত্ব ব্যাখ্যার সময় আবু রাইহানের বয়স ছিল ৭০ বছর। শারীরিক কারণেই হয়তো তিনি আমেরিকায় যেতে পারেননি কিন্তু মাপজোকের সব কিছুই করেছেন তিনি। ইউরোপীয়দের বহু আগে আরব ভূগোলবিদরা গিয়েছিলেন মালাক্কায়, ফিলিপিন্সে, আন্দামানে, সিংহলেও। বিবরণ তারা রেখে গেছেন এলাকাগুলোর। নমুনা হিসেবে আন্দামান, সিংহলের কথা শোনা যাক। বিশিষ্ট ভূগোলবিদ, আরব নাবিক সুলায়মান বিন আহমদ বিন সোলায়মান আল মাহরি (১৪৮০-১৫৫৪) আল মানাহিজুল ফাখির গ্রন্থে লিখেন, ‘সরণ দ্বীপসহ (সিংহল) বিভিন্ন দ্বীপে বিয়ের কনেকে দেনমোহর হিসেবে দিতে হয় শত্রুপক্ষের কোনো একজনের মাথা। একজন পুরুষ যত খুশি মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, যদি প্রত্যেকের জন্য একটি করে শত্রুর মাথা কেটে এনে দিতে পারে। দ্বীপগুলোতে হাতি পাওয়া যায়; আখও জন্মে। এখানকার অধিবাসীরা নরমাংস খায়।… এখানকার নারী-পুরুষ সবাই ল্যাংটা থাকে। মেয়েরা গাছের পাতা দিয়ে শরীর ঢেকে রাখে।’ ‘…একটি দ্বীপের নাম আন্দামান। এখানকার লোকদের গাত্রবর্ণ ঘোর কালো। এরা নরমাংস খায়।’ এতে বোঝা যায়, আজ থেকে প্রায় এক হাজার ১০০ বছর আগে সিংহল এবং আন্দামান- এই দু’টি দ্বীপ আরব নাবিকরাই প্রথম আবিষ্কার করেন। ভূগোল বিজ্ঞানে আরবরা যে পৃথিবী শ্রেষ্ঠ ছিল এবং গ্রিকদের চেয়েও যে শীর্ষস্তরে ছিল, এ সম্বন্ধে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য রয়েছে বিস্তর। ফ্রান্সের মসিয়ে লে-পেঁ তার ‘সিভিলাইজেশন অব অ্যারাবিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, টলেমি তার আবিষ্কৃত শহরগুলোর বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভুল করেছেন। যেমন- ভূমধ্যসাগরকে ৪০০ ফার্লং বলে ভুল বর্ণনা করেছেন। ভূগোলের ক্ষেত্রে আরবদের অগ্রগতি যদি গ্রিক অবদানের সাথে যথার্থভাবে তুলনা করা যায়, তাহলে সে তুলনা থেকে বোঝা যাবে, আরবদের গবেষণায় কেবল দ্রাঘিমাংশের ক্ষুদ্রতম বিষয়ে সামান্য হেরফের হয়; আর গ্রিকদের দ্রাঘিমাংশের হিসাব ছিল পুরোপুরি ভ্রান্তিজনক। যে সময় কোনো নির্ভরযোগ্য ঘড়ি ছিল না, সে সময় দ্রাঘিমাংশ সম্বন্ধে আদৌ কিছু জানা অত্যন্ত কঠিন ছিল; তাই আরবরা দ্রাঘিমাংশের হিসাবে কিছু ভুল করেছিল। কিন্তু কখনোই তাদের ভুল দুই ডিগ্রির বেশি হয়নি। গ্রিকদের ভুলের তুলনায় আরবদের ভুল অতি সামান্য। উদাহরণস্বরূপ টলেমি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে তানজার অক্ষাংশ দেখিয়েছেন ৫৩.৩০। কিন্তু সঠিক হিসাবে হলো ৩৫.৪১, টলেমির হিসাবের সাথে হেরফের হয় এক হাজার ৮০০ ডিগ্রির। তানজা থেকে ত্রিপলি পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের যে পরিমাপ আরবরা দেখিয়েছে, তাতে মাত্র ১০ ডিগ্রি হেরফের হয়। টলেমি তার মানচিত্রে ভূমধ্যসাগরকে ১৯০ ফার্লং বেশি লম্বা দেখিয়েছেন, যার ফলে ৪০০ ফার্লং হেরফের হয়েছে। অনুরূপ ইবনে খালদুন লোহিত সাগরের দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছেন এক হাজার ৪০০ মাইল। আধুনিক লোহিত সাগরের দৈর্ঘ্য হলো এক হাজার ৩০০ মাইল। এ থেকে বোঝা যায়, আরবদের পরিমাপ আধুনিক গবেষণার সাথে প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ। বস্তুত মুসলিমদের ভৌগোলিক ও সমুদ্রগবেষণা দুনিয়াকে নিয়ে আসে নতুন বাস্তবতায়। আগে যে পাচিলের আড়ালে আবদ্ধ ছিল ভৌগোলিক দৃষ্টি, সেখান থেকে মুসলিম সভ্যতা প্রকৃতি ও সমুদ্রজয়ের এমন এক প্রশস্ত পরিসর তৈরি করে, যার সুফল ভোগ করেছে ইউরোপ। স্পেন-পর্তুগাল, ইতালি ও ব্রিটেনের যে অভিযাত্রীরা প্রকৃতি জয়ের উদ্যমে ত্রয়োদশ শতক থেকে দুনিয়ার দিকে ছড়িয়ে পড়ছিলেন, তাদের শিক্ষক ও প্রেরণা ছিলেন পূর্ববর্তী মুসলিম অভিযাত্রী ও আবিষ্কর্তারা। বস্তুত এ অভিযাত্রার ধারায় পশ্চিমারা সভ্যতার নেতৃত্ব ও বিশ্বজোড়া আধিপত্যকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে যেতে বহু দূর এগিয়ে যায়।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com