রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
আমার কথা বলে চাঁদা-সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করলে পুলিশে দিন : আসিফ নজরুল তিস্তার পানি দ্রুত বাড়ছে আজ আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন মাহমুদুর রহমান ঢাকার খাল দিয়ে ব্লু নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করছে সরকার : পানিসম্পদ উপদেষ্টা শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দুত্ববাদ ও নাস্তিক্যবাদ বরদাস্ত করা হবে না : মামুনুল হক নৌকা থাকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন হতে পারে : উপদেষ্টা আদর্শিক ভিন্নতা থাকলেও সবাই একসঙ্গে জাতি গঠনে কাজ করবে: মঞ্জুরুল ইসলাম জাতিসংঘে ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা মাহমুদ আব্বাসের মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুরের দাফন ছাত্র-জনতার অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয় স্বৈরাচার থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছে

বরিশালে জীবনযুদ্ধে হার মানতে নারাজ ১৮ ইঞ্চির প্রতিবন্ধী শাহীন

বরিশাল ব্যুরো :
  • আপডেট সময় রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩

সবাই যখন স্বাভাবিক শরীরের উচ্চতা নিয়ে জীবনযাপন করছেন, সেখানে ১৮ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষ হয়ে জীবনযুদ্ধে হার মানতে নারাজ শাহীন ফকির। এক কথায় উচ্চতা শিশুর মতো হলেও, শারীরিক অবয়বে বয়সের ছাপ রয়েছে শাহীন ফকিরের। জীবনযুদ্ধে কারও বোঝা হতে চাননি কখনও, তাই স্বপ্নও দেখেন নিজের মতো করে। এ কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধিতাকে দমিয়ে নিজের ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই নিজেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করছেন ৩২ বছর বয়সী শাহীন। এমনকি জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও স্বপ্ন দেখতে ও তা পূরণ করতে কোনোদিন পিছপা হননি ত্রিশোর্ধ্ব শাহীন। শাহীনের প্রিয় ক্রিকেট টিম বাংলাদেশের অন্যতম খেলোয়াড় তামিম ইকবালের সঙ্গে দেখা ও কথা বলার স্বপ্ন ছিল তার। তাও পূরণ হয়েছে এ বছরের ১৭ মার্চ সিলেটে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজের সময়। দেখা করার পাশাপাশি তামিম দিয়েছেন নিজের সই করা বাংলাদেশের জার্সি, আর্থিক সহায়তা ও ম্যাচের পাঁচটি টিকিট। কথা দিয়েছেন অত্যাধুনিক হুইল চেয়ার দেওয়ার। পাশাপাশি যেকোনো বিষয়ে শাহীনের পাশে থাকার ও আশ্বাস দিয়েছেন তামিম। পাঁচ বছর আগে বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হায়াতসার গ্রামের ফুলতলা বাজারের পূর্বপাশে গড়ে তোলেন ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা দোকান। যে দোকানে মোবাইলব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি শিশুদের চকলেট, বিস্কুটসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। দোকানটির অবস্থান শাহীনের বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বে বরিশাল সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হায়াতসার গ্রামের ফুলতলা বাজারের আগে শাহীনের দোকান। পরিবারের শক্তি হয়ে ওঠা শাহীন ফকির বরিশালের মুলাদী উপজেলার চর কমিশনার এলাকার আবুল হাসেম ফকিরের ছেলে। বাবা-মা, দুই ভাই, চার বোন ও ভাবি-ভাতিজিকে নিয়ে যৌথ পরিবারে বাস করেন তিনি। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে এবং এক ভাই মালয়েশিয়া প্রবাসী। জন্মের পর পোলিও আক্রান্ত হয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বেড়ে ওঠা শাহীন চতুর্থ শ্রেণীর পর পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারেননি। তবে স্বাভাবিক মানুষদের মতো কাজকর্ম করে নিজের উপার্জনে জীবন কাটানোর লক্ষ্য ছিল শাহীনের। শাহীনের মা আলেয়া বেগম বলেন, বয়স যখন সাতদিন, তখন অনেক কান্নাকাটি শুরু করে সে। পরে তাকে স্থানীয় পল্লিচিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে বরিশালে নিয়ে গিয়ে বড় মাপের চিকিৎসক দেখাতে বলেন। কিন্তু তখনকার সময়ে যাতায়াত পথের দুর্গমতা এবং টাকার অভাবে বড় ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি শাহীনকে। আর এর কিছুদিন পর শাহীনের হাত-পা বেঁকে যেতে থাকল। পরে তারা বরিশালে নিয়ে জানতে পারেন শাহীন পোলিও আক্রান্ত হয়েছে। আলেয়া বেগম আরও জানান, গোসল, বাথরুমসহ নিত্যদিনের বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করতে শাহীনের অন্যের সহায়তার প্রয়োজন হয়, তারপরও বুঝতে শেখার পর থেকে শাহীন নিজে নিজে সবকিছু করার চেষ্টা করতেন। শাহীন কারো বোঝা না হয়ে নিজের আয়ে চলতে চায়, সেজন্যই দোকান দেওয়া। আর কষ্ট করে হলেও সে প্রতিদিন হুইলচেয়ারে করে অন্যের সহায়তায় দোকানে যাচ্ছেন। শাহীন বলেন, মায়ের কাছ থেকে শুনছি জন্মের সময় ভালোই ছিলাম, পোলিও আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে শারীরিক গঠন এমন হয়ে গেছে। ৩২ বছর আগের ঘটনা তখন তো গ্রামের মানুষ বুঝতেই পারতো না এটা পোলিও না অন্যকিছু। আর এরকম হবে সেটাও কেউ বুঝতে পারেনি। তিনি বলেন, ২০-২৫ বছর আগে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করি, তখন আমার কোনো হুইলচেয়ারই ছিল না, যে সেটাতে বসলে কেউ ঠেলে নিয়ে যাবে। সহপাঠীদের কোলে চরে মাসে দুই/চারদিন করে স্কুলে যেতাম আর পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিতাম। এভাবে স্কুলে যেতে যেতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছি। কেউ ভালো চোখেও দেখে কেউ খারাপ চোখেও দেখে এবং মন্দ কথাও বলে অনেকে, তবে তাতে কিছু মনে করেন না জানিয়ে শাহীন বলেন, আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন, সে এভাবে আমাকে বানিয়ে যদি খুশি থাকেন, তাহলে আমিও খুশি। ‘অনেক বছর আগে একজন পরিমাপ করেছিল, তার তথ্যানুযায়ী আমার উচ্চতা ১৮ ইঞ্চি এমন তথ্য জানিয়ে শাহীন বলেন, ২০১৮ সালে আমি যখন ব্যবসা করতে চাই, তখন আমার ভাইবোনসহ আত্মীয়-স্বজনরা মিলে ১৫ হাজার টাকা দেন। তা দিয়ে আমি বাসায় বসে ব্যবসা শুরু করি, তবে তাতে না পোষানো ওই দোকানটি নেই। বর্তমানে এ দোকান থেকে দৈনিক ২/৩শ টাকা আয় হচ্ছে। আর দোকান থেকে আয়ের টাকা নিজেই ব্যয় করছি, ইচ্ছে আছে ব্যবসা বাড়ানোর বড় দোকান দেওয়ার। পরিবারে একজন প্রতিবন্ধী লোক থাকলে তাকে নিয়ে সবার চিন্তা থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, আমি অন্যের সহযোগিতা ছাড়া কিছু করতে পারি না। দোকানে আসার জন্য আমার ভাগ্নে রয়েছে, নির্ধারিত সময়ে সে নিয়ে আসে এবং নিয়ে যায়। এছাড়া প্রয়োজন হলে এলাকার লোকজনও সাহায্য করেন। আর পরিবার থেকে কেউ বোঝা মনে করে বলে কেউ কোনোদিন বলেনি। ক্রিকেট খেলাকে অনেক ভালোবাসেন জানিয়ে শাহিন বলেন, শারীরিক গঠনের কারণে হয়ত ক্রিকেট খেলতে পারিনি, তবে বাংলাদেশের খেলা কখনও মিস করি না। বাসায় টেলিভিশন থাকার কারণে, দেশের খেলা শুরু হলে দোকান বন্ধ করে চলে যাই এবং খেলা দেখি। সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা পান জানিয়ে তিনি বলেন, কারও কাছে হাত পাতার ইচ্ছে, মন থেকে কেউ কিছু দিলে তাতে বাঁধও সাধি না। আমার প্রতি ভালোবাসা মানুষের থাকতেই পারে। আর সরকার যদি আমাকে সহায়তা দেয় তা নিতে রাজি আছি। এদিকে স্থানীয়রা বলছে, পরোপকারী হিসেবে স্থানীয়দের কাছে শাহীনের পরিচিতি রয়েছে। উপার্জন কম হলেও প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তাও করেন তিনি। পরোপকারী ও সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে সুনাম থাকা শাহীনের প্রশংসা করে স্থানীয় যুবক নুরুজ্জামান নাঈম বলেন, শাহীন ভাই কখনো কাউকে ঠকান না, কাউকে বিপদেও ফেলেন না। ফলে তাকে সবাই বিশ্বাস করেন। আর বিশ্বাস করে বিধায় গ্রামের যারা, নগদ, রকেট ও বিকাশে পাসওয়ার্ড মনে রাখতে পারে না, তারাও পাসওয়ার্ড শাহীন ভাইয়ের কাছে রাখে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com