রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১২:১৩ অপরাহ্ন

সিনেমা হলের নাম আছে অস্তিত্ব নেই রংপুরে দুটি সিনেমা হল ছাড়া বাকি সব বন্ধ

নুর হাসান চান রংপুর :
  • আপডেট সময় বুধবার, ১২ জুলাই, ২০২৩

রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ২০৫ বর্গ কিলোমিটার। প্রায় ১০ লক্ষ জনসংখ্যার বসবাস এই নগরীতে। বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সিটি প্রাচীনকাল থেকেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চার উর্বরভূমি হিসেবে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতবর্ষের এ বাংলার প্রথম সিনেমা হলটি ছিল এই নগরীতেই। হলের নাম ছিল রংপুর ড্রামাটিক হল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ভারত-পাকিস্তানের জন্ম হয়। রংপুর ড্রামাটিক হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মর্ডান হল। শহরের মাঝখানে এ সিনেমা হলটির অবস্থান থাকলেও চারপাশে ছিল যেন জঙ্গলে ভরা। সে সময় জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘নাগিন’ প্রদর্শনীর সময় হলের পর্দার সামনে জীবন্ত সাপ চলে এলে আতঙ্কিত দর্শকরা ভয়ে পালিয়ে যায়। সেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দর্শক মনে। বন্ধ হয়ে যায় হলটি। এর বেশ কয়েক বছর পর সেই মর্ডান হলটিকে সংস্কার করে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রসহ নাটক-থিয়েটারের জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। পরে এই হলটির নাম রাখা হয় টাউন হল। এখন সেখানে আর সিনেমা প্রদর্শিত হয় না। বর্তমানে এটি রংপুরের সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রাণ। এখানে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশসহ নিয়মিত বিভিন্ন সেমিনার হয়। টাউন হল ছাড়াও দুই দশক আগেও রংপুরে অন্তত ১২টি সিনেমা হল সচল ছিল। ওই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রের দাপট আর সিনেমা হলগুলোর জনপ্রিয়তা ও পরিচিতি ছিল ব্যাপক। বর্তমানে বেশির ভাগ হলের অস্তিত্ব না থাকলেও এখনো ‘লক্ষী হলের মোড়’, ‘ওরিয়েন্টাল মোড়’ ‘দরদী হলেল মোড়’ ‘নুরমহল (আকাশ) মোড়’ ‘বিডিআর হল মোড়’ ‘সেনা অডিটরিয়াম মোড়’ ও ‘শাপলা হল’ ‘চায়না হল’ ও ‘মিতালী হল’সহ বিভিন্ন হলের নামডাক বা খ্যাতি রংপুরে রয়েছে। কিন্তু গত দুই দশকে সিনেমা হল ব্যবসায় অকল্পনীয় ধস আর অশ্লীলতায় ভরা নি¤œমানের নকল চলচ্চিত্র নির্মাণে মুখ থুবড়ে পড়েছে সিনেমা হল। দর্শকরাও হয়েছে হল বিমুখ। একারণে হল মালিকরা ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। সিমেনা হলগুলো ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে তালা। জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে রংপুরের বেশির ভাগ সিনেমা হলই এখন শুধুই ইতিহাস। সচলের খাতায় এখন শুধুমাত্র শাপলা টকিজ ও আকেশ টকিজের নাম। বাকি সব বন্ধ হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অশ্লীলতায় ভরা নি¤œমানের ও নকল ছবি নির্মাণ সিনেমা হল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। তা ছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ বর্তমানে ভদ্রলোকের অনুকূলে নয়। বর্ধিত সিটি করপোরেশন এলাকাসহ রংপুর জেলার মধ্যে বর্তমানে শুধুমাত্র শাপলা টকিজ ও আকাশ টকিজে নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এখন এ দুটি সিনেমা হলের অধিকাংশ দর্শকই সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর। সঙ্গে রয়েছে নোংরা বিনোদনে অগ্রহী উঠতি বয়সের বখাটে যুবক ও যুবতীদের হিড়িক। তবে মাঝে মধ্যে এই হলে ভালোমানের দেশীয় বাংলা চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হয়। তখন অবশ্য সিনেমা পিপাসু সব বয়সী দর্শকের উপচে পড়া ভীড় চোখে পড়ে। যেমনটা দেখা যাচ্ছে এবারের ঈদে মুক্তি পাওয়া প্রিয়তমা ও লাল শাড়ি সিনেমা দুটি ঘিরে। এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে ১৯৭৮ সালে গড়ে ওঠা থাকা শাপলা টকিজ। এই হলটির মূল মালিক নজরুল ইসলাম মাসুমের মৃত্যুর পর তার ভাই মিন্টু মিয়া হলের দায়িত্ব নেন। কিন্তু হলের ব্যবসা ভালো না হওয়ায় শাপলা টকিজ ভাড়া দিয়ে দেয় কামাল হোসেন নামে ঢাকার চলচ্চিত্র প্রযোজকের কাছে। সেই শাপলা টকিজের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন শাহাবুদ্দিন নামে হল ব্যবস্থাপক। তিনি ব্যবসার মন্দাভাবে হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, আশা ছিল জেলার উন্নতমানের শাপলা সিনেমা হল ভালো চলবে। কিন্তু এর অবস্থা আরো খারাপ। এভাবে লোকসান হতে থাকলে হলটি চালানো আর সম্ভব হবে না। শাহাবুদ্দিন জানান, বর্তমানে তার শাপলা টকিজে যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে সিনেমা হল মালিকের ভাড়া দেওয়া, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ ও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই শাপলা হল ভাড়া নিয়ে ভর্তুকি দিচ্ছেন তার মালিক। তবে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু চলচ্চিত্রকে ঘিরে ভালো ব্যবসা হয়েছে এবং ঈদে এখনও সেই রেশ রয়েছে বলে জানান তিনি। আকাশ টকিজের জেনারেল ম্যানেজার রকিবুল আজাদ বলেছেন, করোনাকালীন প্রায় দুই বছর বন্ধ ছিল। তিন মাস আগে চালু হয়েছে। খুব একটা ভালো চলছে না। সরকারের অনুদান দেওয়ার কথা ছিল, সেটা এখনো আমরা পাইনি। অর্থাভাবে ঠিক মতো সংস্কার হচ্ছে না। এখন সিনেমা হলের বসার সিট, সাউন্ড সিস্টেম ও ডে?কো?রেশন খুব ভালো অবস্থায় নেই। এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, চায়না টকিজ, নুর মহল ও দরদী সিনেমা হল এখন গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেনা অডিটোরিয়াম বন্ধ করে দিয়ে সেখানে আর্মি মেডিক্যাল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলাসহ ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্মী সিনেমা হলের যন্ত্রপাতি অনেক আগেই লোপাট হয়ে গেছে। অবকাঠামোও প্রায় ধ্বংসের পথে। ওরিয়েন্টাল সিনেমা হলে ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক আগেই। দরদী হলটি ভেঙে সেখানে করা হয়েছে দোকানপাট। দর্শকদের অভিযোগ, ঘুরে ফিরে একই ধরনের নি¤œমানের সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ নকল ছবি নির্মাণ সিনেমা হল থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। তাছাড়া সিনেমা হলগুলোর পরিবেশ বর্তমানে ভদ্রলোকের অনুকূলে নয়। সিনেমা হলের দর্শক এখন সমাজের খেটে খাওয়া মানুষজন। সঙ্গে রয়েছে নোংরা বিনোদনে আগ্রহী উঠতি বয়সের বখাটে যুবকদের হিড়িক। নগরীর শাপলা চত্বর এলাকায় ব্যবসা করেন তসলিম মিয়া। যার বয়স এখন পয়ষট্টি বছরের কাছাকাছি। সেই তসলিম মিয়া সত্তরের দশকের স্মৃতিচারণ করে বলেন, রংপুরে আগে টাউন হল ও ওরিয়েন্টাল হল ছিলো। আর সিনেমার টিকিট তখন ছিল মহার্ঘ। টিকিট কাটতে গিয়ে কতবার মারামারিতে জড়িয়েছি। হাত কেটে গেছে, পরনের কাপড় ছিঁড়ে গেছে। তবুও প্রিয় নায়ক-নায়িকা রাজ্জাক, শাবানা, ববিতা, আলমগীর, ফারুক বা খান আতার ছবি না দেখে বাড়ি ফিরিনি। তাছাড়া তখনকার ছবিগুলো সামাজিক ও বাস্তবধর্মী। বর্তমানে সিনেমা হলে যাওয়া হয় কিনা এ প্রশ্নের জবাবে নাট্যশিল্পী মিজান তালুকদার বলেন, প্রায় ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে সিনেমা হলমুখো হইনি। কী দেখতে যাব? দেখার মতো সিনেমা কি এখন তৈরি হয়? নাকি সিনেমা হলে যাওয়ার পরিবেশ আছে? সবমিলিয়ে আগের মতো সিনেমা দেখার অনুভূতি ফিরে পাই না। একারণে সুযোগ পেলে সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে পুরোনো দিনের সিনেমা দেখার চেষ্টা করি। তিনি আক্ষেপ থেকে বলেন, রংপুরে একসময় সিনেমা হল মালিকদের একটি সংগঠন ছিল। এখন তা এখন অস্তিত্বহীন। কথা বলার জন্য সমিতির কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। এমন কি হল মালিকরাও দর্শকদের কাছাকাছি আসতে চায় না। ভালো সিনেমা আনার ব্যাপারে কথা বলতেও নারাজ তারা। এভাবে চলতে থাকলে সিনেমা যে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি বিকাশের মাধ্যম, তা তরুণ প্রজন্ম জানতে পারবে না। শাপলা টকিজে প্রিয়তমা সিনেমা দেখতে আসা দর্শকদের একজন নন্দ কিশোর। তার সাথে কথা হলে এই সিনেমানুরাগী এই তরুণ জানান, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এখন ঘরে বসেই টেলিভিশনের পর্দায় নয়তো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুবনবিখ্যাত কত সিনেমা দেখা যায়। এখন তো আগের মতো দর্শকের প্রত্যাশার সিনেমা তৈরি হয় না। বরং সিনেমার নামে বাংলাদেশে যা তৈরি হচ্ছে, তা রীতিমতো বিরক্তিকর। তারপরও বড় পর্দায় সিনেমা দেখার অনুভূতিটা অন্যরকম। অনেকদিন পর সিনেমা হলে এসেছি, যদিও প্রিয়তমা ভালো লাগে, তাহলে হলে ফিরে আসাটা সার্থক মনে হবে। খামারমোড় এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসান। দীর্ঘদিন ধরে বামধারার রাজনীতি করছেন তিনি। চলচ্চিত্রশিল্পকে বাঁচাতে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সবসময় সরব ভূমিকায় ছিলেন এই সংগঠক। কামরুল হাসান বলেন, সবশেষ ১৯৯৮ সালে সিনেমা হলে গিয়েছিলাম। এরপর আর যাওয়া হয়নি। কেন যাইনি এর উত্তর একটাই এখন সিনেমায় নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে সিনেমা দেখার মতো হলগুলোতে পরিবেশ নেই। আগের মতো খুব বেশি ভালো সিনেমা তৈরি হচ্ছে না। সিনেমা হল ও দেশীয় চলচ্চিত্র রক্ষায় সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের যত্মবান হওয়া দরকার বলে মনে করেন রংপুর বিভাগীয় লেখক পরিষদের সভাপতি ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব কাজী মোঃ জুননুন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, এক সময় নতুন কোন সিনেমা আসছে তা জানার জন্য দর্শকদের মাঝে ব্যাকুলতা ছিল। পাশাপাশি গ্রাম থেকে কোনো কাজে শহরে এলে মানুষ একটি সিনেমা দেখে যাওয়ার তাড়না বোধ করত। এখন সেই দিন নেই। নেই আগের মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনামুখী সিনেমাও। তিনি আরও বলেন, আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। সুস্থ চিন্তা-চেতনায় মানুষকে শাণিত করতে চলচ্চিত্রশিল্পকে রক্ষা করা দরকার। ফলে এ কাজে সরকার ও চলচ্চিত্র নির্মাণকারী উভয়কে যতœবান হতে হবে। আর এ দুটি বিষয় সমন্বিত হলে আমাদের চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব ফিরে না এলেও মানুষ সিনেমা হলমুখী হবে বলে আমি মনে করি।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com