শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ০১:২৪ পূর্বাহ্ন

চৌরঙ্গী

শংকর
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০২৩

(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
(পূর্ব প্রকাশের পর)
বায়রন মাথা নাড়লেন। এখনও নেই। একটু থেমে আবার বললেন, কলকাতা একটা আজব শহর, মিস্টার মার্কোপোলা। আমরা যত বড় ভাবি কলকাতা তার থেকে অনেক বড়।
মার্কোপোলোর মুখের দীপ্তি এবার হঠাৎ অর্ধেক হয়ে গেল। বললেন, এখনও নয়? আর কবে?Íআর কবে?
পুরনো সময় থাকলে ওঁর হতাশায় ভরা কণ্ঠ থেকে কোনো রহস্যের গন্ধ পেয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়তাম। কিন্তু এখন কোনো কিছুতেই আমার আগ্রহ নেই; সমস্ত কলকাতা রসাতলে গিয়েও যদি আমার একটা চাকরি হয়, তাতেও আমি সন্তুষ্ট।
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বায়রন এবার কাজের কথাটা পাড়লেন। আমার পরিচয় দিয়ে বললেন, একে আপনার হোটেলে ঢুকিয়ে নিতেই হবে, আপনার অনেক কাজে লাগবে।
শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন, কোনো উপায় নেই। ভাড়া দেবার ঘর অনেক খালি আছে, কিন্তু চাকরি দেবার চেয়ার একটাও খালি নেই। স্টাফ বাড়তি।
এই উত্তরের জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছিলাম। বহুবার বহু জায়গায় ওই একই কথা শুনেছি। এখানেও না শুনলে আশ্চর্য হতাম।
বায়রন কিন্তু হাল ছাড়লেন না। চাবির রিঙটা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, কিন্তু আমি জানি তোমার ভেকান্সি হয়েছে।
অসম্ভব, ম্যানেজার চিৎকার করে উঠলেন। সবই সম্ভব। পোস্ট খালি হয়েছে। আগামী কালই খবর পাবে। মানে?
মানে অ্যাডভান্স খবর। অনেক খবরই তো আমাদের কাছে আগাম আসে। তোমার সেক্রেটারি রোজিৃ।
ম্যানেজার যেন চমকে উঠলেন-রোজি? সে তো উপরের ঘরে রয়েছে।
গোয়েন্দাসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে বায়রন বললেন, বেশ তো, খবর নিয়ে দেখো। ওখানকার বেয়ারাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করো, গতকাল রাত্রে মেমসাহেব নিজের ঘরে ছিলেন কিনা।
মার্কোপোলোরও গোঁ চেপে গিয়েছে। বললেন, ইমপসিবল। চিৎকার করে তিনি তিয়াত্তর নম্বর বেয়ারাকে ডেকে পাঠালেন।
গত রাত্রে তিয়াত্তর নম্বরের নাইট ডিউটি ছিল। আজও সন্ধ্যা থেকে ডিউটি। সবেমাত্র সে নিজের টুলে বসেছিল। এমন সময় ম্যানেজার সায়েবের সেলাম। নিশ্চয়ই কোনো দোষ হয়েছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
ম্যানেজার হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন কাল সারারাত সে জেগে ছিল কি।
তিয়াত্তর নম্বর বললে, ভগবান উপরে আছেন হুজুর, সারারাত জেগে ছিলাম, একটিবারও চোখের দুটো পাতা এক হতে দিইনি।
মার্কোপোলোর প্রশ্নের উত্তরে বেয়ারা স্বীকার করলে, ৩৬২-এ ঘর সারা রাতই বাইরে থেকে তালাবন্ধ ছিল। বোর্ডে সারাক্ষণই সে চাবি ঝুলে থাকতে দেখেছে।
মৃদু হেসে বায়রন বললেন, গতরাতে ঠিক সেই সময়েই চৌরঙ্গীর অন্য এক হোটেলের বাহাত্তর নম্বর ঘরের চাবি ভিতরে থেকে বন্ধ ছিল।
মানে? মার্কোপোলো সভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
মানে, সেই ঘরে শুধু রোজি নয়, আরও একজন ছিলেন। তিনি আবার আমার বিশেষ পরিচিত। আমারই এক ক্লায়েন্টের স্বামী! এসব অবশ্য আমার জানবার কথা নয়। কিন্তু মিসেস ব্যানার্জি আমাকে ফি দিয়ে লাগিয়ে রেখেছেন। তার স্বামী কতদুর এগিয়েছেন, তার রিপোর্ট আজই দিয়ে এলামÍনো হোপ! কোনো আশা নেই। আজ সন্ধ্যায় আপনার সহকারিণী এবং ব্যানার্জি দুজনেই ট্রেনে চড়ে পালিয়েছেন। পাখি উড়ে গিয়েছে। সুতরাং এই ছেলেটিকে সেই শূন্য খাঁচায় ইচ্ছে করলেই রাখতে পারেন।
আমি ও ম্যানেজার দুজনেই স্তম্ভিত। বায়রন হা-হা করে হেসে উঠলেন। খবর দেবার জন্যই আসছিলাম, কিন্তু পথে আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
এরপর মার্কোপোলো আর না বলতে পারলেন না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও জানালেন, রোজি চাকরি ছাড়েনি, দুদিন পরে সে যদি আবার ফিরে আসেৃ।
তখন ইচ্ছে হলে একে তাড়িয়ে দিও। বায়রন আমার হয়েই বলে দিলেন।
শাজাহান হোটেলের সর্বেসর্বা রাজি হয়ে গেলেন। আর আমারও চাকরি হল। আমার ভাগ্যের লেজার খাতায় চিত্রগুপ্ত নিশ্চয়ই এই রকমই লিখে রেখেছিলেন।

০২.
আমার নবজন্ম হল। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টারের শেষ বাবু আজ থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের উপর দাঁড়িয়ে সে আর বাবুদের সঙ্গে গল্প করবে না, চেম্বারে বসে সে বিচার প্রার্থীদের সুখদুঃখের কাহিনি শুনবে না। আইনের সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরদিনের মতো শেষ হল। কিন্তু তবু সে এক অপূর্ব আনন্দের অনুভূতি। সাইক্লোনে ক্ষতবিক্ষত জাহাজ মারমুখী সমুদ্রের বুক থেকে যেন আবার বন্দরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে আসছে।
পরের দিন ভোরে স্নান সেরে, শেষ সম্বল প্যান্ট আর শার্টটা চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দূর থেকেই শাজাহান হোটেলের আকাশ চুম্বি হলদে রংয়ের বাড়িটা দেখতে পেলাম।
বাড়ি শব্দটা ব্যবহার করা উচিত হচ্ছে না। প্রাসাদ। তাও ছোট রাজরাজড়াদের নয়। নিজাম বা বরোদা নিঃসংকোচে এই বাড়িতে থাকতে পারেন–রাজন্যকুলে তাতে তাদের ঐশ্বর্যগৌরব সামান্য মাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
ওই সকালেই রাস্তার ধারে বেশ কয়েকখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। নম্বর দেখেই বোঝা যায় যে, সব গাড়ির মালিক এই কলকাতা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা নন। বোম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লি থেকে আরম্ভ করে ময?ূরভঞ্জ এবং ঢেঙ্কানল স্টেটের প্রতিনিধিত্ব করছে, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি এবং আমেরিকার কারখানায় তৈরি নানা মডেলের মোটরগাড়ি। ওইসব গাড়ির দিকে তাকিয়ে যে-কোনো পর্যবেক্ষক ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিতে পারেন। মোটর সোসাইটিতে কাস্ট সিস্টেম বা জাতিভেদ প্রথার যে এখনও প্রবল প্রতাপ, তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। গাড়ির আকার অনুযায়ী হোটেলের দারোয়ানজি সেলাম টুকছেন। দারোয়ানজির বিরাট গোঁফ, পরনে মিলিটারি পোশাক। বুকের উপর আট-দশটা বিভিন্ন আকারের মেডেল ঝলমল করছে। এই সাত-সকালে অতোগুলো মেডেল বুকে এঁটে দাঁড়িয়ে থাকার উদ্দেশ্য কী, ভাবতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই দারোয়ানজি যে কায়দায় আমার উদ্দেশে সেলাম ঠুকলেন তার খানিকটা আন্দাজ পেতে পারা যায় এয়ার-ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল বিমান প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে। দারোয়ানজির সঙ্গে বর্তমানে পৃথিবীবিখ্যাত এয়ারইন্ডিয়া মহারাজার আশ্চর্য সাদৃশ্যের কথা আজও আমাকে বিস্মিত করে। শুনলে আশ্চর্য হব না, শাজাহান হোটেলের এই দারোয়ানজিই হয়তো বিমান প্রতিষ্ঠানের শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
সেলামের বহর দেখেই বুঝলাম, দারোয়ানজি ভুল করেছেন। ভেবেছেন, শাজাহান হোটেলের নতুন কোনো আগন্তুক আমি।
গেট পেরিয়ে শাজাহান হোটেলের ভিতর পা দিয়েই মনে হল, যেন নরম মাখনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নিজের চাপে প্রথমে যেন মখমলের বিছানায় তলিয়ে গেলাম, তারপর কোনো স্নেহপরায়ণা এবং কোমলস্বভাবা পরী যেন আলতোভাবে আমাকে একটু উপরে তুলে দিল। পরবর্তী পদক্ষেপে আবার নেমে গেলাম, পরী কিন্তু একটুও বিরক্ত না হয়ে পরম যতেœ আমাকে আবার উপরে তুলে দিল। পৃথিবীর সেরা কার্পেটের যে এই গুণ তা আমার জানা ছিল না; তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, সেই অদৃশ্য অথচ সুন্দরী পরী আমার দেহটাকে নিয়ে কার্পেটের টেবিলে কোনো বান্ধবীর সঙ্গে পিপঙ খেলছে।
প্রায় নাচতে নাচতে কার্পেটের অন্যপ্রান্তে যেখানে এসে পৌছলাম তার নাম রিসেপশন। সেখানে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার চোখে সমস্ত রাত্রির ক্লান্তি জমা হয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন-গুড মর্নিং।
একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সুপ্রভাত ফিরিয়ে না দিয়ে, নিজের পরিচয় দিলাম। এইখানে একটা চাকরি পেয়েছি। গত রাত্রে আপনাদের ম্যানেজার মিস্টার মার্কোপোলোর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আজ সকাল থেকে আসতে বলেছিলেন। ওঁর সঙ্গে এখন কি দেখা করা সম্ভব?
চকিতে ভদ্রলোকের মুখের ভাব পরিবর্তিত হল। পোশাকি ভদ্রতার পরিবর্তে মুখে হালকা ঘরোয়া হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আসুন, আসুন, নমস্কার। ঙৎরবহঃং ড়ষফবংঃ যড়ঃবষ বিষপড়হাবং রঃং ুড়ঁহমবংঃ ংঃধভভ! প্রাচ্যের প্রাচীনতম হোটেল তার তরুণতম কর্মচারীকে স্বাগত জানাচ্ছে।
ভয় পেয়ে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভদ্রলোক করমর্দনের জন্যে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার নাম সত্যসুন্দর বোসÍঅন্তত আমার বাবা তাই রেখেছিলেন। এখন কপালগুণে স্যাটা বোস হয়েছি।
বোধহয় ওঁর মুখের দিকে অনেকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম। স্নেহমাখানো মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, এই পোড়ামুখ দেখে দেখে অরুচি ধরে যাবে। শেষ পর্যন্ত এমন হবে যে আমার নাম শুনলে আপনার গা বমি বমি করবে। হয়তো অ্যাকচুয়ালি বমি করেই ফেলবেন। এখন কাউন্টারের ভিতরে চলে আসুন। শাজাহান হোটেলের নবীন যুবরাজের অভিষেক-কার্য সম্পন্ন করি।
আমি বললাম, মিস্টার মার্কোপোলোর সঙ্গে একবার দেখা করবারৃ
কিচ্ছু দরকার নেই। সত্যসুন্দরবাবু জবাব দিলেন।গতকাল রাত্রে উনি আমাকে সব বলে রেখেছেন। এখন আপনি স্টার্ট নিন।
মানে?
মানে ফুল ফোর্সে বলতে গেলে গাড়িতে পেট্রল বোঝাই করে যেমনভাবে স্টার্ট নিতে হয়, ঠিক তেমনভাবে স্টার্ট নিন।
সত্যসুন্দরবাবুর কথার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেললাম। উনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, এ-এ-বির নাম শুনেছেন?
অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল?
হ্যাঁ হ্যাঁ! ওঁদের দুটো কম্পিটিশন হয়। স্পি কম্পিটিশন-কে কত জোরে গাড়ি চালাতে পারে। আর এনডিওরেন্স টেস্ট-কে কতক্ষণ একনাগাড়ে গাড়ি চালাতে পারে। আমাদের এখানে কিন্তু দুটি মিলিয়ে একটি কম্পিটিশন-স্পিড কাম এনডিওরেন্স টেস্ট। কত তাড়াতাড়ি কত বেশিক্ষণ কাজ করতে পারেন, শাজাহান ম্যানেজমেন্ট তা যাচাই করে দেখতে চান। মিস্টার বোসের পাশের টেলিফোনটা এবার বেজে উঠল। আমার সঙ্গে কথা থামিয়ে, কৃত্রিম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভঙ্গিতে সত্যসুন্দর বোস বললেন, গুড মর্নিং। শাজাহান হোটেল রিসেপশন।ৃজাস্ট-এ-মিনিটৃমিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাতারাওয়ালাৃইয়েস..রুম নাম্বার টু থার্টি টুৃনো মেনসন প্লিজৃ
ওঁর টেলিফোন সংলাপ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সত্যসুন্দর বোস আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এখন কান খুলে রেখে শুধু শুনে যান, সময়মতো সব বুঝতে পারবেন, শুধু মরচে পড়া স্মৃতিশক্তিকে ইলেকট্রোপ্লেটিং করে একটু চকচকে রাখবেন। বাকি সবকিছু এমনিতেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। যেমন ধরুন রুম নাম্বার। কোন ভিজিটর কোন ঘরে রয়েছে, এটা মুখস্থ থাকলে খুব কাজ দেয়।

রিসেপশন কাউন্টারটা এবার ভালো করে দেখতে লাগলাম। কাউন্টারের ভিতর তিনটে চেয়ার আছেÍকিন্তু দাঁড়িয়ে থাকাটাই রীতি। ভিতরের টেবিলের উপর একটা টাইপরাইটার মেসিনও রয়েছে। পাশে গোটাকয়েক মোটা মোটা খাতা-হোটেল রেজিস্টার। দেওয়ালে একটা পুরনো বড় ঘড়ি অলসভাবে দুলে চলেছে। যেন সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে, ঘড়িটা কোনো উদ্ভট চিন্তায় কুঁদ হয়ে রয়েছে।
সত্যসুন্দর বোস বললেন, ভিতরে চলে আসুন।
আমার মুখের উপর নিশ্চয়ই আমার মনে ছায়া প্রতিফলিত হয়েছিল এবং সেইজন্যই বোধহয় সত্যসুন্দরবাবু বললেন, কী, এরই মধ্যে অবাক হচ্ছেন?
লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলাম, কই? না তো। মিস্টার বোস এবার হেসে ফেললেন। চারিদিক একবার সতর্কভাবে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, এখনও তো শাজাহান হোটেলের ঘুম ভাঙেনি। তখন আরও আশ্চর্য লাগবে।
কোনো উত্তর না দিয়ে কাউন্টারের ভিতরে এসে ঢুকলাম। এমন সময় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। অভ্যস্ত কায়দায় টেলিফোনটা তুলে নিয়ে, বোস বাঁকা ও চাপা স্বরে বললেন, শাজাহান রিসেপশন। তারপর ওদিককার স্বর শুনেই হেসে বললেন, ইয়েস, স্যাটা হিয়ার! এবার টেলিফোনের অপর প্রান্তের সঙ্গে বোধহয় কোনো রসিকতা বিনিময় হল-মনে হল দুজনেই একসঙ্গে হাসতে আরম্ভ করেছেন।
টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বোস বললেন, স্টুয়ার্ড এখনি আসছেন। ওঁকে একটু বাটার দিয়ে প্লিজ করবার চেষ্টা করবেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি বিশাল দেহকে দূর থেকে দেখতে পাওয়া গেল। যেন চলন্ত মৈনাক পর্বত। অন্তত আড়াই মণ ওজন। অথচ হাঁটার কায়দা দেখে মনে হয় যেন একটা পায়রার পালক হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সায়েবের গায়ের রং পোড়া তামাটে। চোখ দুটো যেন এক জোড়া জ্বলন্ত টিকে।
ভদ্রলোক আমার দিকে গাঁক গাঁক করে তেড়ে এলেন। ও, তাহলে তুমিই সেই ছোকরা যে রোজিকে হটালে!
উত্তর দেবার কোনো সুযোগ না-দিয়ে স্টুয়ার্ড তার বিশাল বাঁ হাতখানা আমার নাকের কাছে এগিয়ে আনলেন। ওঁর হাতঘড়িটার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানালেন যে, আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট রেডি হবে। গত রাত্রে ব্রেকফাস্ট কার্ড তৈরি হয়নি; সুতরাং এখনই ও কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
ভদ্রলোক যে ইংরেজ নন, তা কথা থেকেই বোঝা গেল। আধো-আধো কন্টিনেন্টাল ইংরিজিতে চিৎকার করে বললেন, তেক দাউন, তেক দাউন কুইকলি।
একটা শর্টহ্যান্ডের খাতা এগিয়ে দিয়ে মিস্টার বোস চাপা গলায় বললেন, লিখে নিন।
একটুও অপেক্ষা না করে স্টুয়ার্ড হুড় হুড় করে কী সব বলে যেতে লাগলেন। কতকগুলো অদ্ভুত শব্দ, এর পূর্বে কোনোদিন শুনিনি, কানে ঢুকতে লাগলÍচিলড পাইনঅ্যাপেল জুইস, রাইস ক্রিসপিজ, এগস-বয়েল্ড, ফ্রায়েড পোন্ড, স্ক্র্যাম্বল্ডৃএকটা বিরাট ঢোক গিলে স্টুয়ার্ড চিৎকার করে নামতা পড়ার মতো বলে যেতে লাগলেন, ওমলেট–প্রন, চিজ আর টোমাটো। আরও অসংখ্য শব্দ তার মুখ দিয়ে তুবড়ির ফুলঝুরির মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। শেষ কথা-কফি।
তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে হিন্দিতে বললেন, জলদি, জলদি মাঙতা এবং আমাকে কিছু প্রশ্ন করবার সুযোগ না দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
আমার কাঁদো-কাঁদো অবস্থা। জীবনে কখনও ওইসব অদ্ভুত খাবারের নাম শুনিনি। যতগুলো নাম সায়েব বললেন, তার অর্ধেকও আমি লিখে নিতে পারিনি।
মিস্টার বোস বললেন, পঞ্চাশটা ব্রেকফাস্ট কার্ড এখনই তৈরি করে ফেলতে হবে।
আমার মুখের অবস্থা দেখে, মিস্টার বোস সান্ত¡না দেবার চেষ্টা করলেন। কিছু মনে করবেন না। ও ব্যাটার স্বভাবই ওরকম। সব সময় বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করছে।
আজকের ব্রেকফাস্টের লিস্ট আমি লিখে নিতে পারিনি।আমি কাতর ভাবে ওঁকে জানালাম।
মিস্টার বোস বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তার জন্যে চিন্তা করবেন। জিমির ফিরিস্তি আমার মুখস্থ আছে। আপনি আস্তে আস্তে টাইপ করুন, আমি বলে যাচ্ছি। এ-হোটেলে যেদিন থেকে ঢুকেছি, সেদিন থেকেই ওই এক মেনু দেখছি। তবু ব্যাটার বোজ নতুন কার্ড ছাপানো চাই।
চলবে…….




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com