হারিয়ে যাওয়ার ২১ বছর পর অবশেষে ছেলেকে কাছে ফিরে পেলেন মা-বাবা। তাকে ফিরে পেতে অধীর আগ্রহে এতোদিন অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনেরাও। ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে মা-বাবার বুক শূন্য করে হারিয়ে যান মো. মতিউর রহমান (৩৬)। হারিয়ে যাওয়ার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মতিউরের কোনো সন্ধান পাননি তার বাবা-মা। তবে, তাদের আশা ছিল কোনো একদিন মতিউরকে ফিরে পাবেন তারা। অবশেষে তাদের সেই অপেক্ষার অবসান হয়েছে। মতিউর ফিরে এসেছেন পরিবারের কাছে।
গতকাল শুক্রবার (২১ জুলাই) বিকেলে ভারত থেকে দেশে ফেরেন মতিউর। প গড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর হয়ে দেশে আসলে তাকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে পরিবারের কাছে তুলে দেয় পুলিশ। এ সময় সৃষ্টি হয় এক আবেগঘণ মুহূর্ত। সন্তানকে জড়িয়ে আনন্দের কান্না শুরু করেন বাবা-মা। স্বজনদের চোখেও তখন আনন্দের অশ্রু ছিল। মতিউর রহমানের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ দেবীডাঙ্গা গ্রামে। তিনি সহিদুল ইসলাম ও মর্জিনা বেগম দম্পতির বড় ছেলে। তিনি কখন, কীভাবে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন তা এখনো জানা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মতিউর ২০০২ সালে ১৫ বছর বয়সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এরপর তিনি নিখোঁজ হন। তার সন্ধানে সেসময় ঠাকুরগাঁও সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন বাবা সহিদুল ইসলাম। এরপর সারা দেশে খুঁজেও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ভারতের ‘শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের’ দুই কর্মী মতিউর রহমানকে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আসেন
মতিউরকে হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন- বাবা সহিদুল ইসলাম, মা মর্জিনা বেগম, ছোট বোন সাইফুন্নাহার, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ ও ভবঘুরেদের নিয়ে কাজ করা ভারতীয় সংগঠণ ‘শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের’ প্রতিনিধি নিতিশ শর্মা, ডা. শ্বারালি কে উইনডিলকার, আখানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রোমান বাদশা, ইউপি সদস্য হুমায়ুন কবির প্রমুখ। এর আগে, গত ২৭ জুন মতিউরের দেশে ফেরার কথা ছিল। মা-বাবা তাকে নিতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে এসেছিলেন। পরে তারা দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরেও যান। কিন্তু কাগজপত্রের জটিলতায় সেদিন মতিউর দেশে ফিরতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জুনে ভারতের মহারাষ্ট্রের কারজাত এলাকার রাস্তা থেকে মতিউরকে উদ্ধার করেন ‘শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের’ সমাজকর্মীরা। তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন মতিউর। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের চিকিৎসকেরা তাঁকে চিকিৎসা দেন। মতিউরকে সম্ভাব্য সিজোফ্রেনিয়ার রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়। একসময় জানা যায়, তাঁর বাড়ি বাংলাদেশে। এরপর করোনা মহামারি শুরু হলে মতিউরের পরিবার সন্ধানের বিষয়টি স্থবির হয়ে পড়ে। ‘শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশন’ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা রাস্তায় থাকেন, তাঁদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করে। ছেলেকে ফিরে পেয়ে ‘শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনকে’ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান মতিউরের বাবা সহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মতিউর বড়। বড় ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন ছিলো অনেক। আমি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলাম, ছেলেকেও ভালো যায়গায় পৌঁছাতে চেয়েছি। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। ওকে যে আমরা ফিরে পাবো ভাবিনি। আজকে ফিরে পেয়েছি অনুভুতি বুঝাতে পারবো না।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ছোট বোন সাইফুন্নাহার বলেন, ‘আমার বয়স তখন ৯ বছর। একদিন স্কুলে কক্ষ ঝাড়ু দিচ্ছিলাম, এটা আমার ভাই দেখে খুব বকেছিলো। এরপর ভাই হারিয়ে যান। দীর্ঘদিন পর ভাইকে পেয়ে আমরা সবাই খুবই আনন্দিত। ঠাকুরগাঁওয়ের আখানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রোমান বাদশা বলেন, ‘আমরা সকাল থেকেই মতিউরের অপেক্ষায় ছিলাম। দীর্ঘ অপেক্ষা পর তাকে পেয়েছি। তার জন্য বাড়িতে শতশত মানুষ অপেক্ষা করছেন। গ্রামের লোকজনও আনন্দে ভাসছেন।’ শ্রদ্ধা পুনর্বাসন ফাউন্ডেশনের কর্মী নিতিশ শর্মা বলেন, ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষ, বিশেষ করে যারা রাস্তায় থাকেন, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে কাজ করি আমরা। ২০১৯ সালের আমরা মতিউরকে উদ্ধার করি। সে সুস্থ্য হলে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে ভিডিও কল কথা বলিয়ে দেই। সবশেষে আজকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিলাম।’
বাংলাবান্ধা ইমিগ্রেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা খয়রুল ইসলাম বলেন, ‘দুই দেশের হাই কমিশনের সিদ্ধান্তে মতিউরকে ভারতের ফুলবাড়ি ইমিগ্রেশন থেকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আমরাও আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাকে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি।’