চীনের রাজনীতিতে যাকে ভবিষ্যৎ নেতা বা উদীয়মান তারকা হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী চিন গ্যাংকে হঠাৎ করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন স্বয়ং শি জিনপিং। চিন গ্যাংয়ের অপসারণ নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে শোরগোল তৈরি হলেও, চীনে গতানুগতিক নীরবতার মধ্য দিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে এবং এই বিষয়ে খুব কম তথ্যই প্রকাশ করা হয়েছে।
দেড় বছর আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর বিশ্বে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠা চিন গ্যাংয়ের অপসারণের খবরটি সন্ধ্যার টেলিভিশন খবরে প্রকাশ করা হয়, সে দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার পাঠানো ছোট একটি খবর পাঠ করার মাধ্যমে। প্রায় মাস খানেক আগে থেকে তাকে সরকারি কোনো দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে তার স্বাস্থ্যগত জটিলতার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পার হওয়ার পরেও যখন তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছিল না, তখন ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার তৈরি হয়েছিল যে রাজনৈতিক কোনো কারণে হয়তো তাকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে একটি গুজব ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে যে একজন টেলিভিশন উপস্থাপিকার সাথে তার প্রেমের জের ধরে এই ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ওই উপস্থাপিকাও হঠাৎ করেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। চীনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেন, এমন কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করেন, একই সময়ে এই দু’টি ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে যে, কমিউনিস্ট পার্টিতে তার বিরোধী পক্ষ নৈতিকতার কারণ দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। এ ধরনের সম্পর্ক থাকাটা চীনে বেআইনি নয়, কিন্তু একে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হিসাবে দেখা হতে পারে।
আবার স্বাস্থ্যগত জটিলতার যে কথা বলা হয়েছে, সেটাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। আসলে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত চীনের শাসন ব্যবস্থার অস্বচ্ছতার কারণে এসব সম্ভাবনার কথা যেমন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, আবার একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না। চিন গ্যাংয়ের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সবাই অবাক হয়েছে এই কারণে যে তার পেছনে চীনের সব ক্ষমতাবান ব্যক্তির সমর্থন আছে বলে মনে করা হতো। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করার সময় তাকে ফিরিয়ে এনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেদেশের সর্বোচ্চ নেতা শি জিনপিং। এরপর থেকে বিশ্লেষকরা তার দিকে নজর রাখছিলেন যে, নতুন দায়িত্বে তিনি কতটা কঠোর বা ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ হয়ে উঠতে পারেন।
চীনের কূটনীতিকদের একটি দলকে পশ্চিমারা ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ বলে বর্ণনা করে থাকে, যারা চীনের সমর্থনে সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। চীনের দিক থেকে মনোযোগ সরাতে যদি কাউকে গালি দেয়ারও দরকার হয়, তাতেও তারা পিছপা হন না। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসাবে যখন তিনি কাজ করতেন, সেই সময় থেকে চীনের সমর্থনে কঠোর অবস্থান নেয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন। সেই সঙ্গে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন, যিনি অন্যদের আকর্ষণ ধরে রাখতে পারেন। ইংরেজিতে সাবলীলভাবে কথা বলতে সক্ষমতা এবং উৎসাহী ক্রীড়া অনুরাগী চিন গ্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রে এনবিএ খেলার সময় ফ্রি থ্রো লাইন থেকে শট নিতে দেখা গেছে। অথবা তার আগে যুক্তরাজ্যে দায়িত্ব পালনের সময় তার প্রিয় দল আর্সেনালের পক্ষে উল্লাস করতে দেখা গেছে।
হয়তো চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কোনো কোনো নেতা এ ধরনের ব্যক্তিকে যথেষ্ট কঠোর বা ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ বলে মনে করছেন না। তার সাথে যতবার বিবিসি সংবাদদাতার দেখা হয়েছে, ততবার তিনি অত্যন্ত জোরের সাথে নিজের দেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এবং অন্যদের কাছে যতটা সম্ভব ভালোভাবে দেশকে উপস্থাপন করেছেন। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যে ধরনের আধুনিক, মার্জিত কর্মী দরকার ছিল, তিনি সেরকম একজন বলেই মনে করা হচ্ছিল, যাকে তারা নানাভাবে ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু এখন চিন গ্যাংয়ের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা কারো জানা নেই। তার সম্পর্কিত তথ্য এর মধ্যেই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। একে যেভাবেই নেয়া হোক না কেন, এর ফলাফল ভালো হতে পারে না। সূত্র : বিবিসি