শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ০৫:০৭ অপরাহ্ন

বার্ধক্য আড়াল করার সংস্কৃতি কাম্য নয়

হাসান আলীম :
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০২৩

৩১ জুলাই ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো ব্যতিক্রমী প্রবীণ সাহিত্য সম্মেলন। বলা হয়ে থাকে, সাহিত্য সমাজের আয়না। সেই আয়নায় প্রবীণের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সফলতা-ব্যর্থতা, সম্মান-অসম্মান কতখানি দেখা যায়, তা নিয়ে কথা বলার অবকাশ রয়েছে। সমাজে একদিন মুখে মুখে রচিত গল্প, কবিতা, ছড়া, কবিগান, জারিসারি মানুষের বিনোদনের প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, প্লেগ, কালাজ্বরের মতো মহামারি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু গড় আয়ু কমিয়ে রেখেছিল। ফলে মানুষ প্রবীণ হওয়ার সুযোগ তেমন একটা পেত না। যারা প্রবীণ হতেন, তারা সম্মান-মর্যাদা বেশি পেতেন। সমাজে প্রবীণ মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে অনেক কম থাকায় সাহিত্যে তাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি আমাদের নজরে পড়ে না। সাহিত্যের প্রধান চরিত্রগুলোতে তরুণ-তরুণীদের প্রচ- দাপট ছিল। সমাজ তখন অনেকখানি তরুণনির্ভর থাকায় তরুণ-তরুণীদের সুখ-দুঃখ, বিরহ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিগুলো সাহিত্যের বড় অংশ দখল করে রেখেছিল। অল্প কিছুসংখ্যক মানুষ প্রবীণ হওয়ার সুযোগ পেতেন, যার মধ্যে বেশির ভাগই নারী। এই প্রবীণ নারীরা সমাজে, পরিবারে খানিকটা অসম্মান-অপমানের শিকার হতেন। তাদের সমাজ ও পরিবারে বুড়ি হিসেবে সম্বোধন করা হতো। বিভিন্ন ধরনের প্রবাদ দ্বারা তাদের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করা হতো। কানা বুড়ি, চরকা বুড়ি, কুটনি বুড়ি, কুঁজো বুড়ি, উকুনে বুড়ি, পেতিœ বুড়ি, ডাইনি বুড়িএসব বলে প্রবীণ নারীর চলাফেরা, আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। নেতিবাচক পরিচিতি দিতে বলা হতোচাল নষ্ট মুড়ি আর পাড়া নষ্ট বুড়ি। বিশেষ করে পরিবারের তরুণ সদস্যরা প্রবীণ নারীর প্রতি অনেক সময় শোভন আচরণ করত না। ফলে প্রবীণ নারীরা রাগে-দুঃখে, অসম্মান, অপমানে অভিযোগ, নালিশ, অভিশাপ দিয়ে নিজেকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করতেন।
প্রবীণ পুরুষদের হাতে জমিজমা, সহায়সম্পদ থাকায় তেমন একটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় না। তাই সাহিত্যে তাদের উপস্থিতি খানিকটা মর্যাদা ও সম্মানের। আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমান শিশুদের জন্য কয়েকটি ছড়া রচনা করেছেন। তিনিও প্রবীণ নারীর প্রতি সদয় হতে পারেননি। তার রচিত ছড়াগুলোর নাম উকুনে বুড়ি, জটি বুড়ি, চরকা বুড়ি। ভাগ্যিস তিনি প্রবীণ পুরুষদের নিয়ে ছড়া লেখেননি।
আমি যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম, তখন খ্যাতিমান ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়ার রচিত ‘ক্রেবিড এইজ অ্যান্ড ইয়ুথ’ কবিতাটি পাঠ্যতালিকায় ছিল। সেই কবিতার মধ্য দিয়ে কবি যৌবন ও বার্ধক্যের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। বার্ধক্যকে শীতকাল এবং যৌবনকে গ্রীষ্মকাল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বার্ধক্য অক্ষম, অচল; অন্যদিকে যৌবন চপল, চঞ্চল। যৌবন দুঃসাহসিক, উচ্ছল আর বার্ধক্য শৈথিল্য, খিটখিটে। কবি বার্ধক্যকে ঘৃণা করেছেন, অন্যদিকে যৌবনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেজন্যই বার্ধক্য আড়াল করার সংস্কৃতি জোরদার হচ্ছে কি না, সেটা আমাদের চিন্তা করতে হবে।
নোবেল বিজয়ী আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ১৯৫২ সালে রচনা করলেন ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ নামের ১২৭ পৃষ্ঠার কালজয়ী উপন্যাস। উপন্যাসের নায়ক সান্তিয়াগো ৮৫ বছর বয়সি কিউবান মৎস্য শিকারি। স্ত্রী বেঁচে নেই। একাকী থাকেন। তার মেনোলিন নামে কম বয়সি এক শিষ্য ছিল। আমরা এই উপন্যাসে একজন হার না মানা মৎস্য শিকারি প্রবীণ বীরকে দেখতে পাই, যিনি প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন। নিঃসঙ্গতা, হতাশা, সমালোচনা, ক্লান্তি তার কাছে পাত্তা পায় না। আমার ধারণা, বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রবীণ জীবনকে দার্শনিকভাবে তুলে ধরেছেন মরমি কবি হাসন রাজা। তার কালজয়ী রচনা ‘লোকে বলে বলে রে, ঘরবাড়ি ভালা না আমার।/ কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।/ আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার’। অন্যদিকে প্রবীণ জীবনের নানান চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছেন বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম। তিনি রচনা করলেন স্মরণকালের জনপ্রিয় গান : ‘আগের বাহাদুরি এখন গেল কই?/ চলিতে চরণ চলে না, দিনে দিনে অবশ হই।/ মাথায় চুল পাকিতেছি, মুখে দাঁত নড়ে গেছে।/ চোখের জ্যোতি কমেছে মনে ভাবি চশমা লই।/ মন চলে না রংতামাশায়, আলস্য এসেছে দেহায়।/ কথা বলতে ভুল পড়ে যায়, মধ্যে মধ্যে আটক হই’। এই গানের মধ্যে শাহ আবদুল করিম জীবনের প্রতিটি পর্যায়কে তুলে ধরে মানুষের মনকে দোলা দিতে পেরেছেন। আমাদের দেশে শিশু উপযোগী লেখা তৈরি করার জন্য শিশু সাহিত্যিকেরা রয়েছেন। কিশোর উপযোগী লেখাগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শুধু প্রবীণদের জন্য আলাদা করে সাহিত্যচর্চা নেই। আছে বিক্ষিপ্তভাবে। প্রবীণের মন-মানসিকতা, চাহিদা, বিনোদন বিবেচনায় নিয়ে প্রবীণ সাহিত্য তৈরি করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি প্রবীণের বসবাস। তাদের জীবনের নানান চ্যালেঞ্জ, সংকট, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রেম-বিরহ, ব্যথা-বেদনা, নিঃসঙ্গতা সাহিত্যে তুলে আনাই লেখকদের একটা কাজ হতে পারে। ২ কোটি প্রবীণের জীবন কবি-সাহিত্যিকের বিবেচনার বাইরে থাকলে তা হবে বয়সবিদ্বেষী মনোভাব।
লেখক, প্রকাশকেরা উদ্যোগ নিয়ে আলাদা করে প্রবীণ সাহিত্য হিসেবে নতুন ধারা চালু করতে পারে। নানা কারণে প্রবীণের চলাচল সীমিত হয়ে যায়। সশরীরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ কমতে থাকে। ফলে বই, পত্রিকা, টেলিভিশন, ইউটিউব, ফেসবুকের ওপর নির্ভরতা বাড়ে। অথচ পত্রিকায় আলাদা প্রবীণ পাতা নেই, টেলিভিশনে প্রবীণদের দুঃখ-দুর্দশাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। বার্ধক্যকে উপভোগ করার ক্ষেত্রে সাহিত্য বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রবীণ উপযোগী সাহিত্যজীবন সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি লাভে সহয়তা করবে। আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা প্রবীণ উপযোগী সাহিত্য রচনায় এগিয়ে আসবেন, এটাই প্রত্যাশা। লেখক: প্রবীণবিষয়ক লেখক, গবেষক ও সংগঠক




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com