শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ন

যত্রতত্র বর্জ্যের ভাগাড়, পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে

এমদাদ উল্যাহ কুমিল্লা :
  • আপডেট সময় সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩

দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইনখ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ডিভাইডার ও দুই পাশেই বর্জ্য স্তুপ করে ফেলে রাখে বিভিন্ন পৌরসভার কর্তৃপক্ষ ও বাজারের ব্যবসায়ীরা। সড়কের অর্ধশতাধিক স্থান যেন মরা পশু, মরা হাঁস-মুরগি আর ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড় হয়ে উঠেছে। বর্জ্য পরিশোধানাগর ব্যবস্থা না থাকায় মারাত্মক পরিবেশ দূষণসহ জনজীবন দূর্বিষহ হয়ে পড়েছে। হুমকির মুখে জীব বৈচিত্র্য। পরিবেশ দূষণ রোধ ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের কার্যকরী কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। জানা গেছে, আবর্জনা সংগ্রহে পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, পুণর্ব্যবহার ও নিষ্কাশনের সমন্বিত ব্যবস্থাকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বুঝায়। বর্জ্য পদার্থের আধুনিক ও নিরাপদ অপসারণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা। পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল ও দশম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ফলে দেশে বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে সমান তালে বেড়ে চলেছে সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমস্যাও। বর্তমানে বাংলদেশে বর্জ্য সৃষ্টির পরিমাণ প্রতি বছর প্রায় ২২.৪ মিলিয়ন টন, অর্থাৎ মাথাপিছু ১৫০ কিলোগ্রাম। এ হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সালে দৈনিক প্রায় ৪৭ হাজার ৬৪ টন বর্জ্য উৎপন্ন হবে। এতে করে মাথাপিছু হার বেড়ে দাঁড়াবে ২২০ কিলোগ্রাম। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন প্রক্রিয়ায় বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠেছে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা। এসব অবকাঠামোর জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য নিষ্কাশনের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। ফলে অসংখ্য মানুষের বাসগৃহ থেকে প্রচুর পরিমাণ গৃহস্থালি বর্জ্য প্রতিদিন যত্রতত্র নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। কঠিন বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থাও অত্যন্ত নাজুক এবং সেকেলে। বর্জ্য পদার্থকে রাস্তার পাশে এখানে-সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়, এবং তা পঁচে-গলে বাতাসকে মারাত্মক দূষিত করে। মহাসড়কের কুমিল্লা অংশ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চৌদ্দগ্রাম, মিয়াবাজার, গৌরীপুর, তালতলি, মাধাইয়া, চান্দিনা, নিমসার, কাবিলা, নিশ্চিন্তপুর, আমতলী, আলেখারচর, পদুয়ারবাজার, সুয়াগাজী এলাকায় মহাসড়কের ভিাইডার ও দুই পাশে কাঁচাবাজারের ময়লা-আবর্জনা ও বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ফেলার কারণে স্তূপ তৈরি হয়েছে। এসব স্তূপে প্রতিনিয়ত মহাসড়কের দুই পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অধিকাংশ হোটেল রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য, পঁচা শাক-সবজি, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠাসহ নানা ধরনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। আবার কোথাও রাস্তার পিচের ওপর আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এসব ময়লার ভাগাড়ে পশু-পাখি ও কুকুর-বিড়াল খাবারের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করার সময় এলোমেলো করে মহাসড়কে ছড়িয়ে ফেলছে। সড়কের ওপরের এসব ময়লা-আবর্জনা যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে এবং এসব ময়লা ধুলায় পরিণত হয়ে বাতাসে উড়ছে। বিশেষ করে বাতাসে ময়লা-আবর্জনা ও বিষাক্ত ধুলা উড়ে আশপাশের বাড়িঘরসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। দুর্গন্ধে মহাসড়কে চলাচলকারী হাজার হাজার যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা সমস্যায় পড়ছেন। সড়কের পাশের এলাকার বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। মহাসড়কের এসব স্থান দিয়ে চলার সময় নাকে রুমাল চেপে চলতে হয়। এক কথায়-মানুষের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য অধিকার ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সম্প্রতি অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্জ্যের কারণে পরিবেশ দূষিত হওয়ার মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। শিল্প বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য, প্রাণীজ বর্জ্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্যে দুষিত হচ্ছে বায়ু ও পানি ইত্যাদি। এর প্রভাব পড়ছে জীব বৈচিত্র্যের ওপর। পড়ছে জলবায়ুর ওপর প্রতিকূল প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন প্রাণীর জটিল ও কঠিন রোগ দেখা দিচ্ছে। পরিবেশের ওপর জলবায়ুর প্রভাবের জন্য ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত, খাদ্যাভাবজনিত রোগসহ নানা জটিল ও অপরিচিত রোগ হয়ে থাকে। বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। চারপাশের পরিবেশের এ বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ু দুষণ। এটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে ২২ শতাংশ মানুষ বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা ও ৩০ শতাংশ মানুষ জ্বালানি সংশ্লিষ্ট দূষণের শিকার। ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো হচ্ছে- মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজোন ইত্যাদি। পশু সম্পদ বর্জ্য ঠিক মতো ব্যবস্থাপনার অভাবে যেসব সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে সেগুলো হলো; ভূ-গর্ভস্থ জল দূষণ, বায়ু দূষণ, জীব বৈচিত্র্য হ্রাস, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। পশুসম্পদ বর্জ্য থেকে উৎপন্ন দুর্গন্ধ মানুষ ও পশুপাখির বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন-অস্থি সমস্যা, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি। ক্ষতিকর গ্যাসগুলোর মাত্রারিক্ত সেবন মানুষ ও পশুপাখির মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এছাড়া এতে সৃষ্টি হয় এসিড বৃষ্টি। বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব ও নাইট্রেট পরিবেশে পানি দূষণের অন্যতম কারণ। খাবার পানিতে উচ্চতর ঘনত্বের নাইট্রেটের উপস্থিতি মানুষ ও পশুপাখির স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত এসিড, বালাইনাশক, তেল ও বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস করতে পারে। ফসফেট, রাসায়নিক সার, সাবানজাতীয় দ্রব্য ও বিষ্ঠা, জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদকে মাত্রাতিরিক্ত পুষ্টি যোগানোর মাধ্যমে পানি দূষিত করে। গৃহস্থালি আবজর্না, শিল্প ও কৃষিখামারের বর্জ্য এবং মানুষ ও পশুর মলমূত্র থেকে প্রতিনিয়ত ঘটছে পানিদূষণ। অধিক পুষ্টির ফলে জলজ শ্যাওলার অত্যধিক বৃদ্ধি ও পরবর্তী সময়ে মৃত্যু ঘটে, ব্যাকটেরিয়া এসব মৃত শ্যাওলার পচন ঘটাতে অত্যধিক পরিমাণে পানির দ্রবীভুত অক্সিজেন গ্রহণ করে। এতে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। মানুষসৃষ্ট বর্জ্য জলবায়ুর ওপর যে আঘাত এনেছে তা নিয়ে সারা পৃথিবী উদ্বিগ্ন। জলবায়ুর ওপর বর্জ্যের প্রভাব কমাতে জাতিসংঘ বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। তাদের কর্মসূচিগুলো হলো-সব দেশে জলবায়ু সম্পর্কিত বিপদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্থিতিস্থাপকতা ও অভিযোজন ক্ষমতা জোরদার, জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাকে জাতীয় নীতি, কৌশল এবং পরিকল্পনায় একীভূতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, অভিযোজন, প্রভাব হ্রাস এবং শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নতকরণ ও প্রারম্ভিক সতর্কতা ইত্যাদি। উন্নত বিশে^ বর্জ্য নিয়ে দুটো কথা চালু আছে; আজকের বর্জ্য আগামীকালের সম্পদ। আবর্জনাই নগদ অর্থ। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন ও নরওয়েতে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহারযোগ্য অন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে এবং এ ব্যবসাটি সেখানে অত্যন্ত লাভজনক। একে ঘিরে তারা অন্য দেশ থেকেও বর্জ্য আমদানি করছে। দেশ-স্থান-কালভেদে পরিবেশ দূষণ রোধে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ভূমিকা অপরিসীম। সঠিক উপায় নির্ধারণে ব্যত্যয় ঘটলে কালক্রমে পরিবেশ অসহনীয় পর্যায়ে নিপতিত হয়। উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে অপর্যাপ্ত অর্থ-প্রযুক্তি-লোকবলের জোগান বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে অতিশয় দুর্বল-বিপর্যস্ত করে তোলে। সার্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মত বাংলাদেশেরও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। বর্জ্য বা অপদ্রব্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বর্জ্য সংরক্ষণ, নিরপেক্ষায়ন, নিষ্ক্রিয়করণ অথবা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ব্যবহারের উপযোগী বিভিন্ন নতুন জিনিস বানানো উচিত। এতে যেমন পরিবেশ লাভবান হবে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে দেশের মানুষ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী শেখ ফরিদ বলেন, ‘বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে দিন দিন পানি ও বায়ু দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। জীব বৈচিত্র্য বাঁচাতে এখনই উন্নত দেশের মত বাংলাদেশেও আধুনিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্জ্য পরিশোধন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এজন্য সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে’।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com