(শংকর এক জন জনপ্রিয় লেখক । তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়তাঁর ‘সীমাবদ্ধ’ এবং ‘জনঅরণ্য’ কাহিনী অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়করেছেন উত্তম কুমার। সেই প্রসঙ্গে শংকর বললেন, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’
১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর যশোরের বনগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আইনজীবী বাবা হরিপদ মুখোপাধ্যায়দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই চলে যান কলকাতার ওপারে হাওড়ায়। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড?াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। জীবনের শুরুতে কখনও ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনও প্রাইভেট টিউশনি, কখনও শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। এক ইংরেজের অনুপ্রেরণায়শুরু করেন লেখালেখি। ‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায়জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময়‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি আশি পেরিয়েছেন শংকর। এখনও সমান তালে লিখে চলেছেন। ইদানীং তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।)
ইন্টারনেটের সৌজন্যে খবরপত্রের পাঠকদের জন্য পত্রস্থ করা হলো।- বি.স
(পূর্ব প্রকাশের পর)
রাতের অতিথিরা হঠাৎ যেন ঘুম থেকে উঠে বসেন! সময় হয়েছে নিকট, এবার বাঁধন ছিড়িতে হবে। যারা চালাক তারা কিন্তু চিন্তিত হন না, শুধু বারম্যানের দিকে তাকিয়ে কাছে আসতে ইঙ্গিত করেন।
বেয়ারা সে ইঙ্গিতের অর্থ বোঝে। বলে, কপেগ হুজুর?
সাহেব হিসেব করতে শুরু করেন। এক এক পেগে যদি আধঘণ্টা সময় গিলে ফেলা যায়, তাহলে আট পেগে রাত্রির অন্ধকারকে ভোরের আলোর খপ্পরে আনা যাবে। বারোটায় বার বন্ধ, কিন্তু বার-এ বসে আগে থেকে অর্ডার দেওয়া পানীয় পানে আপত্তি নেই। আর কয়েকটা ঘণ্টা টেবিলে জড়ো করে রাখা মদ সাবাড় করতে করতে কাটিয়ে দিতে পারলেই আবার যা হয় একটা সুযোগ এসে যাবে। যে তোবারক আলী আট পেগ মদ টেবিলে দিয়ে বার বন্ধ নোটিশ টাঙিয়ে দিয়ে, চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, সেই আবার ততক্ষণে রাত্রির ঘুম শেষ করে ডান হাতে লাল ব্যাজটা জড়াতে জড়াতে আবার বার-এ এসে ঢুকবে। দেখবে সাহেব সবকটা পেগ উড়িয়ে দিয়ে তীর্থকাকের মতো ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, কখন আবার বার খুলবে।
শাজাহান হোটেলের মেন গেট পেরিয়ে ভিতরে এসে ঢুকলাম। সত্যসুন্দরবাবু কাউন্টারে ডিউটি দিচ্ছেন। বাঁ হাতে টেলিফোনটাকে কানে ধরে আছেন, আর ডান হাতে বোধহয় কোনো মেসেজ লিখে নিচ্ছেন। আমাকে দেখে সত্যসুন্দরদা মাথা নাড়লেন। ইঙ্গিতে বললেন, সোজা কিচেনে চলে যাও। ওখানে তোমার কাজ আছে। কী কাজ? কে কাজ দেবেন, কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। সত্যসুন্দরবাবু তখন কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে বলছেন, হা, হ্যাঁ। শাজাহান রিসেপশন থেকে আমি স্যাটা বোস কথা বলছি। করবী গুহকে এখন ফোনে পাওয়া সম্ভব নয়। যদি আপনার কিছু বলবার থাকে বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি। উনি ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই আপনার মেসেজ পেয়ে যাবেন।
বোসদার মুখ দেখে বুঝলাম, টেলিফোনের অপর প্রান্তের ভদ্রলোক তাঁর উত্তরে খুশি হননি। বোসদা বলে উঠলেন, আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু স্পেশাল ইনস্ট্রাকশন না থাকাতে, কোনো বোর্ডারকে আমরা ঘুমের মধ্যে জ্বালাতন করি না।ৃআজ্ঞে, এ-বি-সি। এ কেমন নাম? বলছেন ওই বললেই শ্?ীমতী গুহ বুঝতে পারবেন। তবে আমাদের কাস্টম হল, পুরো নাম, ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর টুকে নেওয়াৃনা, না, প্লিজ রাগ করবেন না; সব কিছু বলা–বলা আপনার ইচ্ছে। আমি তাকে বলব, মিস্টার এ-বি-সি ফোন করেছেন।
ফোনের ওধার থেকে ভদ্রলোক তখনও কী সব বলছেন। টেলিফোন পর্ব শেষ হবার জন্য অপেক্ষা না করে আমি সোজা কিচেনের দিকে পা বাড়ালাম।
হটাও, হটাও, দূর থেকেই মার্কোপোলো সাহেবের বাজখাই গলার স্বর শুনতে পেলাম। কাছে এসে দেখলাম ঝাড?ুদাররা সব মাথা নিচু করে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ে ওরা ঠক ঠক করে কাঁপছে। মুখের অবস্থা দেখে মনে হয় মিলিটারি ক্যাম্পে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে ওদের কেউ দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজার সাহেবের দিকে ওরা এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন উনিই সেনাবাহিনীর মেজরÍএখনই গুলি করবার হুকুম দেবেন।
দুনিয়ার আর কোথাও এর থেকে নোংরা হোটেল আছে? মার্কোপোলো তারস্বরে প্রশ্ন করলেন।
সবাই মাথা নিচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। ওদের নীরবতায় বিরক্ত হয়ে মার্কোপোলো এবার গর্জন করে উঠলেন, ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব ইস্কুলের এক্স-স্টুডেন্টরা কি সবাই দলবেঁধে এই হোটেলে চাকরি নিয়েছে? তোমরা কথা বলো না কেন?
মার্কোপোলোর সন্ধানী চোখ এবার সার্চলাইটের মতো ঘুরতে আরম্ভ করল। ঘুরতে ঘুরতে চোখটা যেখানে এসে থামল, সেখানে স্টুয়ার্ড জিমি দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যানেজার আবার তোপ দাগলেন, জিমি, তুমি কি গ্যান্ডি পার্টিতে জয়েন করেছ? সায়লেন্স-এর ভাও নিয়েছ?
স্টুয়ার্ড, যাঁর প্রতাপের খানিকটা অভিজ্ঞতা আমার আছে, যেন কেঁচো হয়ে গিয়েছেন। কোনোরকমে বললেন, সত্যি খুব নোংরা, আপনি যা বলছেনৃ
এবং তুমি সেই হোটেলের স্টুয়ার্ড-যার রান্নাঘর দিয়ে দিনেরবেলায় কুমিরের মতো বড় বড় ইঁদুর ছোটাছুটি করে।
ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। সায়েবের সামনে দিয়ে দুটো সঁদুর কিচেনের ফ্লোরে ছোটাছুটি করেছে। তারপরই এই দৃশ্য। সায়েব আর কাউকে ছাড়তে রাজি নন।
মুখের পাইপ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে, মার্কো এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, মাইডিয়ার ফেলাজ, তোমরা যেভাবে চলছ, যেভাবে স্টোরস এবং কিচেন নোংরা করে রাখছ, তাতে যদি সামনের সপ্তাহে দেখি, ইঁদুর কেন এখানে হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাহলেও আমি আশ্চর্য হব না।
জমাদাররা ততক্ষণে ঘরের মেঝে সাবধানে মুছতে আরম্ভ করেছে। স্টুয়ার্ড হেড কুককে ডেকে বললেন, আমি ঠিক লাঞ্চের পরই আসছিÍসমস্ত কিছু আজ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে চাই। কেউ যেন আজ বাইরে না পালায়। প্রত্যেককে আমি এখানে হাজির দেখতে চাই।
পাইপটা হাতে নিয়ে আর একবার ঘুরতে গিয়ে, মার্কোপোলো আমাকে দেখতে পেলেন। যিনি এতক্ষণ ৪৪০ ভোল্টের মেজাজে ছিলেন, তিনিই এবার স্নিগ্ধ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, হালো, গুড মর্নিং।
আমার এই অভাবনীয় সৌভাগ্য স্টুয়ার্ডের বোধহয় মনঃপূত হল না। বাঁকা চাহনি এবং মুখের ভাব দেখে তার মনের কথাটা আমার বুঝতে বাকি রইল না। কিন্তু ও-নিয়ে সময় খরচ করবার উপায় ছিল না। পিঠে একটা চাপড় দিয়ে মার্কোপোলো বললেন, এসো।
এবার তাকে আমি অন্যরূপে দেখতে আরম্ভ করলাম। তিনি আমার দ-মু-ের কর্তা শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার নন। এঁকে কাল রাত্রে এলিয়ট রোডের এক অন্ধকার ঘরে আমি মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছি। আঘাতে আঘাতে শক্ত হয়ে যাওয়া ওই দেহটার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি সেই শিশুকে, অনেকদিন আগে মধ্যপ্রাচ্যের ভূমিকম্পে যে সব হারিয়েছিল; এথেন্সের ফাদাররা যাকে আবার সব দিয়েছিল; আবার আমাদের এই কলকাতা যার সর্বস্ব হরণ করে নিয়েছিল।
শাজাহান হোটেলের ম্যানেজার আজ আমার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পরিপূর্ণ রূপটা আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আর তিনিও ম্যাজিসিয়ানের মতো মুহূর্তে নিজের রূপ পালটিয়ে ফেললেন। কে বলবে, এই লোকটাই দু মিনিট আগে ইঁদুর দেখে হোটেলের সব কর্মচারীকে একসঙ্গে রসাতলে পাঠাবার চেষ্টা করছিলেন।
আমার মুখের দিকে মার্কো অমনভাবে কেন তাকিয়ে রয়েছেন? হয়তো ভাবছেন, আমি সব জেনে ফেলেছি। আবার ঠিক নিঃসন্দেহও হতে পারছেন না। ডিটেকটিভ বায়রন এই অজানা ছোকরাকে কতখানি বলেছেন আর কতখানি বলেননি, কে জানে। আমারও কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সেই অস্বস্তি থেকে বাঁচবার জন্যই বললাম, স্যর, গতকাল মিস্টার বায়রনের কাছে আমি গিয়েছিলাম।
বাড়ি চিনতে তোমার কোনো কষ্ট হয়নি তো?
বললাম, না। অপরিচিত জায়গা বটে, কিন্তু নম্বর তো জানা ছিল।
আই হোপ, সমস্ত জীবনই কলকাতার ওই অঞ্চল তোমার কাছে অপরিচিত থাকবে। মাইডিয়ার ইয?ংম্যান, জীবনে সবরকম অন্যায়ের প্রলোভন থেকে দূরে থাকবার চেষ্টা কোরো। আমি তোমাকে উপদেশ দিতে চাই না; বাট বিলিভ মি, আমরা প্রায়ই নিজেদের দুঃখ নিজেরাই সৃষ্টি করি।
আমি চুপ করে রইলাম। আর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি কোনোরকমে টোক গিলে বললাম, গতকাল রাত্রে মিস্টার বায়রনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, আপনি যেন ধৈর্য হারাবেন না।
ধৈর্য! পৃথিবী কোনোদিন এর থেকেও ধৈর্যশীল মানবশিশুকে লালন করেছে? মার্কোপোলো যে কাকে প্রশ্ন করলেন বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এই প্রথম মনে হল, যাকে আমি পাথর বলে মনে করেছিলাম আসলে সে একটা বরফের চাঙড়। আমারই চোখের সামনে বরফের বিশাল টুকরোটা গলতে শুরু করেছে।
যাঁর সঙ্গে আমার প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক, তিনি মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন আমি কে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সঙ্গে বলতে গেলে আমার কোনো পরিচয়ই নেই। আই হার্ডলি নো ইউ। কিন্তু তোমার মুখ দেখে মনে হয় পৃথিবীকে তুমি চেনো না। তুমি জানো না, কোন পৃথিবী-হোটেলে বাস করবার জন্য ঈশ্বর আমাদের অ্যাকোমোডেশন বুক করেছেন। খুব সাবধান।
আমার কথা বলবার মতো সামর্থ্য ছিল না। শুধু নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়েছি। সংসারের দুঃখময় যাত্রাপথে অকারণে কতবারই তো মানুষের অযাচিত ভালোবাসা পেয়েছি। না চাইতে পেয়ে পেয়ে আমার লোভ যেন অনেক বেড়ে গিয়েছে। আজও ভালোবাসার অভাব হল না।
আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তুমি খুব খারাপ টাইপিস্ট নও। গলার, হারটা ডান হাতে নাড়তে নাড়তে মার্কোপোলো বললেন।
মাথা নিচু করে তার প্রশংসা গ্রহণ করলাম। এই সামান্য সময়ে যদি তাকে খুশি করে থাকতে পারি, তবে তার থেকে আনন্দের কী হতে পারে? বিনা-চাকরির জীবনটা যে কী রকমের, তার কিছু নমুনা আমি আস্বাদ করে দেখেছি। বিশেষ করে একবার চাকরি করে যে আবার পথে বেরিয়ে এসেছে। সত্যসুন্দরবাবু হাসতে হাসতে একবার বলেছিলেন, মেয়েদের স্বামী, আর ছেলেদের চাকরি। অরিজিন্যাল বেকার আর চাকরি খোয়ানো বেকারÍযেন কুমারী মেয়ে আর বিধবা মেয়ে। দুজনেরই স্বামী নেই। কিন্তু তফাতটা যে কী, সে একমাত্র বিধবাই বেখে।
সত্যসুন্দরবাবুর ভাষায় স্বামী হারিয়ে আবার স্বামী পেয়েছি, সুতরাং চাকরি যে কী দ্রব্য বুঝতে বাকি নেই। কোনো চেষ্টা না-করতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, নাইস অফ ইউ টু সে সো স্যর।
মার্কোপোলোর গোলগোল চোখ দুটো মধুর দুষ্টুমিতে ছটফট করতে লাগল। বললেন, এতদিন হাইকোর্টে চাকরি করেও তুমি মানুষ চেনোনি। নাইস আমি মোটেই নই।
আমার অস্বস্তিকর মুখের অবস্থা দেখে, মার্কোপোলো এবার আলোচনার মোড় ফেরালেন। বললেন, আই অ্যাম স্যরি। তোমাদের ও-পাড়াকে বেশ ভয় করি; কয়েকবার ওখানে গিয়েছি। সত্যি কথা বলতে কি, কোনো যাঁড় যদি আমাকে তাড়া করে, তবে লাইফ সেভ করবার জন্য আমি নদীতে ঝাঁপ দেব, তবু কিছুতেই ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের কোনো বাড়িতে উঠব না।
উত্তর না দিয়ে কেবল হাসলাম। মার্কোপোলো জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় থাক?
বললাম, হাওড়ায়।
সে আবার কোথায়? মার্কোপোলো যেন অমন জায়গার নামই শোনেননি। বুঝিয়ে বললাম, গঙ্গার পশ্চিমদিকে হাওড়া স্টেশনের পরে।
ওঁর মুখ দেখে মনে হল, হাওড়া স্টেশনের পরে যে কোনো ভূখ- আছে, তা যেন ওঁর জানাই ছিল না। যেন ওইখানেই স্থলভাগ শেষ হয়ে, সমুদ্র আরম্ভ হয়ে গেল!
মার্কোপোলো এবার যা প্রস্তাব করলেন তার ইঙ্গিত সত্যসুন্দরবাবুর কাছে আগেই পেয়েছিলাম। সত্যসুন্দরবাবু বলেছিলেন, এ আপনার সাধারণ আপিস নয় যে, দশটা পাঁচটায় বাঁধা জীবনÍশনিবার অর্ধেক, রবিবারে পুরো ছুটি। যদি এখানে চাকরি পাকা হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে কর্তা একদিন আপনাকে দুনিয়ার সঙ্গে সম্বন্ধ চুকিয়ে, শাজাহান হোটেলে এসে আশ্রয় নিতে হুকুম করবেন।
চাকরিটা রক্ষে করবার জন্য, দুনিয়ার যে কোনো বাড়িতে এসে থাকতে প্রস্তুত আছি আমি।
আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে, সত্যসুন্দরবাবু বলেছিলেন, যা বুঝছি, শাজাহান হোটেলের অন্ন আপনার জন্যে অনেকদিন বাঁধা রয়েছে। স্টুয়ার্ড জিমির হাবভাব দেখে আন্দাজ করতে পারছি আমি। আপনার সম্বন্ধে জিমি এখন খুব নরম হয়ে গিয়েছে। জিমি উপরওয়ালার মন বুঝে চলে।
সত্যসুন্দরবাবুর ভবিষ্যদ্বাণী সফল হল। মার্কোপোলো একটা বার্মা সিগার ধরিয়ে বললেন, তোমাকে একটা ইমপর্টান্ট ডিসিশন নিতে হবে। তোমার আগে যে এখানে কাজ করত তার নাম রোজি। তাকে এখানে থাকতে হত। তাতে ম্যানেজমেন্টের সুবিধে। পাঁচটার মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলবার জন্যে আমাকে হাঁকপাক করতে হত না; জরুরি কাজগুলো আসামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে শেষ করে ফেলা যেত। আমাকে বলতেই হবে, রোজির মতো ওয়ান্ডারফুল সেক্রেটারি আমি কখনও দেখিনি। তার আঙুলগুলো টাইপরাইটারের কি-বোর্ডের উপর দিল্লি মেলের স্পিডে ছোটাছুটি করত, অথচ মুখে হাসি লেগেই আছে। আনগ্রাজিং, কখনও কাজ করতে অসন্তুষ্ট হত না।
একদিন তো বেচারাকে রাত বারোটা থেকে ডিক্টেশন নিতে হল। আমার কাজ নয়। এক গেস্টের কাজ। সে ভদ্রলোক ভোরবেলাতেই দমদম থেকে লন্ডন চলে যাচ্ছেন। পথে করাচিতে একটা চিঠি ডেলিভারি দিতেই হবে। বেচারার টাইপরাইটার নেই, নিজেও টাইপ জানেন না। আমাকে এসে রাত এগারোটায় ধরলেন। আমি বললাম, এত রাত্রে, কোথায় স্টেনো পাব? সে ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। এত বড় কলকাতা শহর, এখানে তোমরা চেষ্টা করলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
আমার রোজির কথা মনে পড়ে গেল। বিলিভ মি, সেই রাত্রে রোজি প্রায় তিনটে পর্যন্ত টাইপ করেছিল। আমি জানতাম না। রোজিকে কাজে বসিয়ে দিয়ে আমি ঘুমোতে চলে গিয়েছিলাম। পরের দিন ভোরে রোজিও আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু পরে বিলেত থেকে ভদ্রলোকের চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেনÍসেদিন আপনার সেক্রেটারি আকাশের পরীর মতো উপর থেকে নেমে এসে আমাকে রক্ষে করেছিলেন। তাঁকে এবং আপনাকে কীভাবে ধন্যবাদ দেব জানি না। তিনি রাত তিনটে পর্যন্ত টাইপ করলেন, অথচ একটুও বিরক্ত না-হয়ে কাজ শেষ করে, আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন!Íমার্কোপোলো সগর্বে তাঁর সেক্রেটারির কাহিনি আমাকে বললেন।
তুমিও এখানে থেকে যাও। মার্কোপোলো বললেন।
মিস্টার মার্কোপোলো আমার সম্মতির জন্য অপেক্ষা করলেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, আমি জিমিকে বলে দিয়েছি। সে নিশ্চয়ই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। যদি কোনো অসুবিধে হয় সে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।
মার্কোপোলো এবার বিল রেজিস্টারটা পরীক্ষা করবার জন্যে কাউন্টারের দিকে চললেন। আমি প্রথমটা বুঝতে না পেরে এবং শেষে বুঝতে পেরে ধপাস করে বসে পড়লাম। আকাশের নক্ষত্রদের কোন ষড়যন্ত্রে গৃহ থেকেও গৃহহারা হতে চলেছি কে জানে!
আমার নিজস্ব একটা নাম ছিল। হাইকোর্টে সেটা হারিয়ে এসেছিলাম। একটা ঠিকানা অবশিষ্ট ছিল। বহুকষ্টের মধ্যেও এতদিন ধরে কোনোরকমে সেটা রক্ষে করে আসছিলাম। পয়সা জমিয়ে একটা চিঠির কাগজ পর্যন্ত ছাপিয়েছিলাম। ইউরোপীয় কায়দায় তার ডানদিকে শুধু ঠিকানাটাই লেখা ছিল। নাম এবং ধাম সমেত একটা রবার স্ট্যাম্পও আত্মপ্রসাদের নেশায় নগদ বারো আনা পয়সা খরচ করে তৈরি করিয়েছিলাম। স্থানে-অস্থানে সেই স্ট্যাম্প অকৃপণভাবে ব্যবহার করে, সগর্বে আমার কৌলীন্য প্রচার করেছি! সে দুটো একসঙ্গে একইদিনে নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে গেল। শাজাহান হোটেলের বিশাল গহ্বরে যে মানুষটা এবার হারিয়ে যাবে তার নামও থাকবে না, ঠিকানাও থাকবে না। সে যেন সত্যিই সরাইখানার নামহীন গোত্রহীন অজানা মুসাফির।
রেজিস্টারে নাম লিখতে লিখতে সত্যসুন্দরবাবু মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, আগাম খবর পেয়ে গেছি।
সামনে একজন বিদেশি অতিথি দাঁড়িয়েছিলেন। বেয়ারা দূর থেকে ছুটে এসে কাছে দাঁড়াতেই, সত্যসুন্দরবাবু বললেন, এক নম্বর সুইট।
বেয়ারা দেওয়ালের বোর্ডে যে অসংখ্য চাবি ঝুলছে, তার একটা সায়েবের দিকে এগিয়ে দিয়ে সেলাম করলে। সায়েব বাঁহাতে মাথার সোনালি চুলগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে, ডানহাতে চাবির রিঙটা ঘোরাতে ঘোরাতে উপরে উঠে গেলেন।
সত্যসুন্দরদা ফিস ফিস করে বললেন, একলা এসেছেন, কিন্তু ডবল বেডের রুম নিলেন।
……..চলবে