আমরা যারা ইসলাম ধর্ম পালন থেকে পুরোপুরি বা আংশিক উদাসীন, আমাদের কি চোখে পড়ে না আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত অনেক অনেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম পালনে নিবেদিত প্রাণ, এমনকি শুধু পালনেই নয়; বরং ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারেও অনেকেই যথেষ্ট পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ- ঢাকা শহরের শীর্ষস্থানীয় তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ যেখানে পাওয়া যাবে এমন অনেক সৌভাগ্যবান শিক্ষক যারা প্রশংসনীয় ধার্মিক। এসব শিক্ষক দেশের সেরা মেধাবী ব্যক্তিত্ব। বিশাল ঢাকা শহরে বহু বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় আছে, খোঁজ নিলে ইনশাআল্লাহ সেখানেও পাওয়া যাবে অনেক অনেক ধর্মপ্রাণ শিক্ষক। তেমনি করে সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয় সংখ্যায় যা অনেক অনেক, সেখানেও পাওয়া যাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মপ্রাণ শিক্ষক। সর্বোপরি পাওয়া যাবে ভারতের বিশ্ব বিখ্যাত ডা: জাকির নায়েক, যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাস করা অথচ তুলনামূলক ধর্মীয় জ্ঞানে তিনি শীর্ষস্থানীয়। প্রখ্যাত আলেমে দ্বীনরা তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, যথা- ডা: জাকির নায়েক আল্লাহর অন্যতম নিদর্শনাবলি। তার হাতে বহুসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। যেকোনো প্রশ্নের তিনি তাৎক্ষণিক জবাব দিতে সক্ষম। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে আল্লাহ যেন তাকে দয়া করে জান্নাতুল ফেরদাউসে স্থান দান করেন। আমীন। আমরা যারা উপরিউক্ত ধর্মপ্রাণদের পথের পথিক নই, তারা কি আমাদের ন্যায়-নির্বোধদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে না? আমরা তো তাদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত বা জ্ঞানী-গুণী নই। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়, তারা কি সঠিক পথের পথিক, না আমরা সঠিক পথের পথিক? এটা তো অবশ্যই সম্ভব নয় যে, আমরা উভয় দলই সঠিক পথের পথিক অথবা ভুল পথের পথিক। তাই যদি হয় তাহলে আমরা হয় সঠিক পথের পথিক হবো অথবা ভুল পথের পথিক হবো। এখন আমাদের নির্ণয় করা দরকার আমরা কোন পথের পথিক।
ইসলাম ধর্মে প্রদর্শিত পথ মাত্র দুটো যথা- একটি সঠিক, অপরটি ভ্রান্ত যা সূরায়ে ফাতিহা (সর্বশ্রেষ্ঠ সূরা) দ্বারা নির্ণীত। সঠিক পথ অর্থাৎ সহজ সরল ও আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্তদের পথ এবং ভ্রান্ত পথ অর্থাৎ আল্লাহর অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্টদের পথ। সরল পথ মানে আল্লাহর দাসত্বের পথ ও তার কাছে পৌঁছার পথ। পক্ষান্তরে ভ্রান্ত পথটি হলো শয়তানের সাথী বা বন্ধু হওয়ার পথ, কারণ শয়তান অভিশপ্ত ও বিপথগামী। সঠিক পথের পথিকরা আল্লাহর নিয়ামতপ্রাপ্ত ও জান্নাতবাসী। পক্ষান্তরে, ভ্রান্ত পথের পথিকরা কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, মহাপাপী- ফলে তারা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত ও জাহান্নামবাসী। তদ্রুপ আমরা যারা মুমিন মুসলিম হিসেবে বিশ্বে পরিচিত, যদি আমরা ন্যূনতম স্তরের মুমিনও হই, তার পরও আমরা দুই দলে বিভক্ত। এক দল পাবে সরাসরি জান্নাতবাসের সুযোগ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে এবং অন্যদল যাবে জাহান্নামে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা না পাওয়ার দরুন তাদের পাপের আধিক্যের কারণে। তাদেরকে পাপের পরিমাণ ও ধরনগত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মেয়াদে জাহান্নামে বিভিন্ন প্রকারের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
বিশ্বের সব মানুষের সর্বশেষ স্থান দু’টো যথা- একটি জান্নাত ও অপরটি জাহান্নাম। কাফির, মুশরিক, মুনাফিক চিরকাল বা অনন্তকাল ধরে জাহান্নামে অবর্ণনীয় ও অসহনীয় শাস্তি ভোগ করতেই থাকবে। এ শাস্তি থেকে কোনো দিনই তারা নিষ্কৃতি বা মুক্তি পাবে না। আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিন্ম স্তরে থাকবে এবং তুমি তাদের পক্ষে কোনো সাহায্যকারী পাবে না’ (সূরা আন নিসা-১৪৫)।
কাফিররা পাশাপাশি মুনাফিকও বটে, তাদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন। বর্ণিত শাস্তি কত ভয়াবহ তা সত্যিকার অর্থে প্রকাশ করার জন্য তাফসিরে নূরুল কুরআন থেকে নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: এ আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, দোজখের সর্বনিম্ন স্তরে লৌহ নির্মিত সিন্দুক থাকবে, তার মধ্যে মুনাফিকদের বন্দী করা হবে। আল্লামা বগবি রহ: হজরত আবু হুরায়রা রা:-এর বর্ণনার উদ্ধৃতি দিয়েছেন, মুনাফিকদেরকে সিন্দুকের মধ্যে বন্দী রাখা হবে, তাদের উপর-নিচে জ্বলন্ত অঙ্গার থাকবে।
আল্লামা ইবনে কাসির রহ: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা:-এর কথার উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, লৌহ সিন্দুকগুলো অগ্নিতে পরিণত হয়ে যাবে, যা চতুর্দিক থেকে বন্ধ থাকবে। কেউ তাদের জন্য সাহায্যকারী থাকবে না যে, তাদেরকে উদ্ধার করবে অথবা তাদের শাস্তি লাঘব করবে।
আল্লাহর বাণী- ‘নিশ্চয় যারা কাফির হয়, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর সামনে কখনো কোনো কাজে আসবে না। আর তারাই হলো জাহান্নামের আগুনের অধিবাসী, তারা সে আগুনে চিরকাল থাকবে’ (সূরা আলে ইমরান-১১৬)। আল্লাহর বাণী- ‘যারা কুফরি করবে এবং আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী, অনন্তকাল সেখানে থাকবে’ (সূরা আল বাকারা-৩৯)।
আমাদের প্রত্যেকেই তার সন্তানগণের জন্য শুভাকাক্সক্ষী, কল্যাণকামী, মায়া-মমতা, আদর-যতœ, স্নেহ-ভালোবাসা ইত্যাদিতে ভরপুর। তা ছাড়া তাদের সুখ-শান্তির ব্যবস্থা, দুঃখ-যাতনা মুক্ত রাখা, লেখাপড়া, প্রতিষ্ঠিত হওয়া ও সর্ব বিষয়ে পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয় অবস্থানে অবস্থান করাতে আমরা নিরলস সচেষ্ট। কিন্তু আমরা ভুলে যাই বাস্তব সত্য বিষয়টি যথা- অস্থায়ী পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় বা তার কাছাকাছি স্থানে অবস্থান করানোর জন্য আমরা যথাসাধ্য পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করলাম, পক্ষান্তরে চিরস্থায়ী জীবনের সুখ-শান্তি অর্জন এবং অগ্নিদগ্ধ কঠোর শাস্তি থেকে নিষ্কৃৃতি লাভ করাতে সন্তানদের জন্য কার্যকরী কী ব্যবস্থা অবলম্বন করলাম?
আমরা সন্তানদের জন্য কি কুরআন-হাদিসের জ্ঞান লাভের ব্যবস্থা নিয়েছি, যাতে করে তারা আল্লাহর বিধানাবলি যথাযথভাবে জেনে ও পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে এবং ফলে প্রবেশ করতে সফল হয় চিরস্থায়ী শান্তিময় স্থান জান্নাতে? দু’-চার দিনের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করলাম, কিন্তু চিরস্থায়ী জীবনের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানের জন্য রয়ে গেলাম বেমালুম উদাসীন, যা মহা পরিতাপের বিষয় নয় কি? সর্বকালের বা উভয়জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ রাসূল সা: আমাদের জন্য কি আদর্শ এবং বিধান রেখে গেছেন, আর আমরা মানুষরা ধোঁকাবাজ শয়তান ও ধোঁকাবাজ পৃথিবীর ধোঁকার শিকার হয়ে রাসূল সা:-এর প্রদর্শিত আদর্শ বিসর্জন দিয়ে স্বরচিত আদর্শ অনুসরণ করে ক্ষণস্থায়ী জীবনের অনেক কিছু ভোগ করলাম চিরস্থায়ী জীবনের কঠিন শাস্তির বিনিময়ে।
রাসূল সা: ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃৃতি পাওয়ার জন্য পেটে পাথর বেঁধেছিলেন, দিনের পর দিন তার ঘরে চুলা জ্বলেনি, তার কন্যা ফাতিমা রা: তার দুই সন্তান হজরত হাসান রা: ও হজরত হোসাইন রা:-সহ দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়েছেন। এসব কিছু কি আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় বিষয় নয়? অবশ্যই এসব কিছু আমাদের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত ও অনুকরণীয় বিষয়।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ