১. আলিফ-লাম-মিম। ২. এটি হলো সে কিতাব, যাতে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই; এটি হলো হিদায়াত মুত্তাকিদের জন্য। ৩. যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, সালাত কায়েম করে এবং তাদেরকে যে জীবিকা আমি দিয়েছি, তা থেকে সৎ পথে ব্যয় করে। ৪. আর তোমার প্রতি যে কিতাব (কুরআন) নাজিল করা হয়েছে এবং তোমার আগে যা নাজিল করা হয়েছিল, তার ওপর ঈমান আনে এবং আখিরাতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। ৫. তারাই তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত, আর তারাই হলো সফলকাম। (সূরা বাকারাহ)
মর্ম ও শিক্ষা : সূরা বাকারার এ আয়াতগুলোতে কুরআনের পরিচয়, অবস্থান এবং মানবজীবনে তার ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। কুরআন মানুষের জন্য হক ও সত্য-পথের দিশারি, হিদায়াত ও জীবনবিধান। কুরআন থেকে কারা হিদায়াত পেয়ে সাফল্যম-িত হবে, আলোচ্য আয়াতগুলোয় তার আলোচনা রয়েছে।
কুরআন হলো জান্নাতে ফিরে যাওয়ার রোডম্যাপ : আদম আ: ও হাওয়া আ:-কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠাবার সময় আল্লাহ তাঁদেরকে বলেন, তোমরা অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে যাচ্ছ, পৃথিবীতে তোমাদের কাছে হিদায়াত (অর্থাৎ জান্নাতে ফিরে আসার রোডম্যাপ) যাবে, যা অনুসরণ করলে কোনো চিন্তা বা ভয় থাকবে না। এখানে সূরার প্রথমেই বলা হচ্ছে, এই কুরআনই হিদায়াত। (আয়াত-২) অর্থাৎ এ কুরআনেই জান্নাতে যাওয়ার সোজা পথের বর্ণনা বা জান্নাতে যাওয়ার রোডম্যাপ দেয়া হয়েছে।
কুরআন হলো আল্লাহ প্রদত্ত জীবনাদর্শ ও জীবনবিধানের দলিল : কুরআনের রোডম্যাপ অনুসরণ করা মানে কুরআন প্রদর্শিত পথে চলা, কুরআনকে জীবনাদর্শ ও জীবনবিধান হিসেবে মেনে নেয়া, তা গ্রহণ, ধারণ ও অনুসরণ করা। কুরআন মানুষের জন্য আল্লাহর মনোনীত জীবনদর্শন, হিদায়াত ও রোডম্যাপের লিখিত দলিল এবং সরল-সোজা সত্যপথের দিকনির্দেশনা।
কুরআনি জীবনাদর্শ সন্দেহাতীতভাবে নির্ভুল : আয়াতে প্রত্যয়ন করা হয়েছে যে, এ কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই। বাতিলপন্থীরা মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য কুরআনের ব্যাপারে নানা ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করত। বলত, এ কুরআন পূর্ববর্তীদের কল্পকাহিনী, তা মুহাম্মাদের নিজস্ব তৈরি, আবার কখনোবা বলত, তা নিছক কাব্য। এভাবে মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য তারা যা ইচ্ছা তা-ই বলত। এখানে আল্লাহ এমন মিথ্যাচারের এক কথায় জবাব দিয়েছেন যে, আল্লাহর এ কিতাবে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই।
কুরআন থেকে হিদায়াত পাওয়ার শর্ত
তাকওয়া : কুরআন থেকে হিদায়াত পাওয়ার জন্য শর্ত হলো পাঠকের ইতিবাচক মানসিকতা। (আয়াত-২) এখানে ‘তাকওয়া’ দ্বারা এ ইতিবাচক মানসিকতার কথা বলা হয়েছে। তাকওয়া হলো সদা-সতর্ক সক্রিয় মানসিক অবস্থা, যা মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে। এরূপ তাকওয়ার মানসিকতাসহ কুরআন অধ্যয়ন করলেই হিদায়াত পাওয়া সম্ভব। তা না হলে কুরআন-প্রদর্শিত পথের যৌক্তিকতা হয়তো বুঝা যাবে, কিন্তু হিদায়াত পাওয়া কঠিন।
হিদায়াত লাভে তাকওয়ার প্রথম শর্ত- অদৃশ্যে বিশ্বাস : হিদায়াতের জন্য যে তাকওয়া প্রয়োজন, তার প্রথম শর্তই হলো অদৃশ্যে বিশ্বাস। (আয়াত-৩) ইসলামী জীবনদর্শনের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি অদৃশ্যে বিশ্বাস। এ জগৎ এমনিতেই হয়ে যায়নি; বরং এর স্রষ্টা আছেন, তিনি হলেন আল্লাহ। তিনি সবকিছুর প্রতিপালন করেন। মানুষের কর্ম আমলনামায় লেখা হচ্ছে। দুনিয়ার এ জীবনই শেষ নয়; বরং আখিরাতে অনন্তকালের জীবন আছে। কিয়ামতের দিন সব মানুষ পুনরুত্থিত হবে। আমল অনুযায়ী বিচার হবে, বিচারক হিসেবে আল্লাহ বিচার করবেন। ভালো কর্মফলের জন্য রয়েছে জান্নাত, আর মন্দ কর্মফলের জন্য দোজখ। আল্লাহ থেকে নিয়ে জান্নাত-জাহান্নাম পর্যন্ত উপরে বর্ণিত সবই অদৃশ্যে বিশ্বাস। এ বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ। এ বিশ্বাস না থাকলে মানুষ দুনিয়াতে ভালো কাজের প্রেরণা পাবে না।
হিদায়াত লাভে তাকওয়ার দ্বিতীয় শর্ত- সালাত কায়েম করা : তাকওয়ার দ্বিতীয় শর্ত হলো সালাত কায়েম করা। (আয়াত-৩) ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহ-প্রদত্ত ও রাসূল-প্রদর্শিত জীবনবিধান গ্রহণের প্রমাণই হলো জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধিনিষেধের বাস্তবায়ন। আর তার প্রধান একটি ক্ষেত্র হলো দৈহিক আনুগত্য তথা শারীরিক ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য। এ আনুগত্যের প্রতিফলন ও অনুশীলন হয় সালাতের মাধ্যমে। সালাতে যেভাবে নিজেকে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে দেয়া হয়, সেভাবে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করাই হলো সালাত কায়েম করার আসল অর্থ।
হিদায়াত লাভে তাকওয়ার তৃতীয় শর্ত- আল্লাহর পথে ব্যয় : তাকওয়ার তৃতীয় শর্ত হলো আল্লাহর পথে ব্যয়। (আয়াত-৩) বিষয়টি গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত মানুষ জড়-স্বার্থের সীমা অতিক্রম করে মানবতার মহান গুণাবলিতে উত্তীর্ণ হয়। নিছক জড়বাদী ও বস্তুবাদী অর্জনই তাদের কাছে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। কাজেই তারা ধনসম্পদ অর্জনের জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয় না এবং কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ধনসম্পদ ব্যয় করতেও দ্বিধা বোধ করে না।
হিদায়াত লাভে তাকওয়ার চতুর্থ শর্ত- আল্লাহর কিতাব কুরআনের প্রতি ঈমান : তাকওয়ার চতুর্থ শর্ত হলো কুরআনের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। (আয়াত-৪) উল্লেখ্য, মানুষের হিদায়াতের জন্য আল্লাহর মনোনীত জীবনাদর্শ রাসূলের মাধ্যমে কিতাব আকারেই নাজিল হয়। মানবজাতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্তÍ এ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় শেষ নবীর ওপর নাজিলকৃত কিতাব হলো আল-কুরআন। সুতরাং হিদায়াত পেতে হলে কুরআনের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে, তাকে গ্রহণ ও অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য নবীর ওপর যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তার ওপর সামগ্রিকভাবে ঈমান আনতে হবে।
হিদায়াত লাভে তাকওয়ার পঞ্চম শর্ত- আখিরাতের ওপর ঈমান : কুরআনে বর্ণিত ইসলামী জীবনব্যবস্থা যতই যুক্তিপূর্ণ ও যুক্তিসঙ্গত হোক না কেন, সমাজ ও জীবনে তার বাস্তবায়নের পেছনে প্রধান প্রেরণাই হলো আখিরাত। কুরআনে বর্ণিত বিধিনিষেধ অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা হলো কি না, কিয়ামতের দিন তার জবাবদিহি করতে হবে। তখন মুক্তি পেয়ে গেলে আখিরাতে অনন্তকালীন জীবনে থাকবে অনাবিল সুখ-শান্তি। আর মুক্তি না পেলে থাকবে অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও কঠিন শাস্তি।
মু’মিনের গুণাবলি, হিদায়াতপ্রাপ্ত কারা : আলোচ্য আয়াতগুলোতে (আয়াত : ১-৫) বলা হয়েছে, কারা এ কুরআন থেকে হিদায়াত পাবে। এখানে পাঁচটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যারা এগুলোর অধিকারী, তারাই হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। (আয়াত-৫) অর্থাৎ কুরআন সব মানুষের হিদায়াতের জন্য অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও শুধু কয়েকটি বিশেষ গুণের অধিকারী ব্যক্তিরাই এর থেকে হিদায়াত পাবে। অন্যরা হিদায়াত পাবে না।
সাফল্যের মাপকাঠি : এখানে মানুষের সাফল্যের মাপকাঠির একটা স্বচ্ছ ধারণা দেয়া হয়েছে। (আয়াত-৫) দুনিয়ার প্রচলিত ধ্যানধারণা অনুযায়ী ধনসম্পদ, ক্ষমতা, রাজনৈতিক অর্জন ইত্যাদিকে সাফল্যের মাপকাঠি বলে বিবেচনা করা হয়। ইসলামী চিন্তাধারায় প্রকৃত সাফল্য হলো ঈমান ও আমলের সাথে জীবন যাপন করে আখিরাতে নাজাত পেয়ে জান্নাতের অধিকারী হওয়া। এরূপ আদর্শিক জীবন যাপন করলে দুনিয়াতেও শান্তি ও সাফল্য পাওয়া যায়। (অসমাপ্ত) (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত তাফসির ‘হিদায়াতুল কুরআন’ থেকে সংক্ষেপিত) লেখক : শিক্ষাবিদ ও বহু গ্রন্থ রচিয়তা sadeqaub@gmail.com