এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে কেঁপেছে মরক্কো। গতকাল শুক্রবারের এই শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকা। গতকাল শনিবার দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে অন্তত ৮২০ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছেন তাঁরা। মরক্কোর দক্ষিণ–পশ্চিমের শহর মারাকেশ দেশটির অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। গত শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১১টা ১১ মিনিটে মারাকেশ ও এর আশপাশ এলাকায় ভূকম্পন অনুভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৮। মারাকেশ থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে একটি পাহাড়ি এলাকায় ভূমিকম্পটির উৎপত্তি। মারাকেশ ছাড়া পাশের উপকূলীয় শহর রাবাত, কাসাব্লাঙ্কা ও এসাওরিয়াতে শক্তিশালী ভূকম্পন অনুভূত হয়। মারাকেশের বাসিন্দা ৩৩ বছর বয়সী আব্দেল হক এল আমরানি বলেন, ‘হঠাৎ অনেক বড় ধরনের কম্পন শুরু হলে বুঝতে পারি এটা ভূমিকম্প। দেখলাম, ভবনগুলো দুলছে। এরপর বাড়ির নিচে নেমে পড়ি। নিচে যাওয়ার পর দেখি সবমেত সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। কাঁদছে শিশুরা।’ মরক্কোতে এর আগে কখনোই এত শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়নি। এদিকে এক ভূমিকম্প–বিশেষজ্ঞের দাবি, ওই অঞ্চলে বিগত ১২ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প। ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইমেরিটাস অধ্যাপক বিল ম্যাকগায়ার এএফপিকে বলেন, ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প তেমন একটা হয় না, এমন এলাকাগুলোতে যথেষ্ট মজবুত করে ভবন নির্মাণ করা হয় না। এতে করে ভূমিকম্পে ভবনগুলো ধসে পড়ে এবং অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। গতকাল শনিবার বিকেলে মরক্কোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভূমিকম্পে হতাহত ব্যক্তিদের হালনাগাদ হিসাব দেয়। তাতে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে ৮২০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগের বেশি ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল আল–হাউস ও তারোদান্ত প্রদেশের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভূমিকম্পে আহত ৬৭২ জনের মধ্যে ২০৫ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন।
‘অসহ্য’ আহাজারি: প্রকৌশলী ফয়সাল বাদ্দোর বললেন, তিনি যে ভবনে ছিলেন, সেখানে তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছিল দ্রুতগতির একটি ট্রেন আমাদের ভবনের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।’ ভূমিকম্পের সময় ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মারাকেশের বাসিন্দা ৪৩ বছর বয়সী মাইকেল বিজেত। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছিল বিছানাটা উড়ে যাবে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আমি কাপড় না পরেই বাড়ির নিচে যাই। কিছুক্ষণ পর গিয়ে দেখি, পুরো ভবন বিধ্বস্ত। এটা সত্যিকার অর্থেই মহাবিপর্যয়।’ মারাকেশের আরেক বাসিন্দা ফয়সাল বাদৌর। তিনি এএফপিকে বলেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ফয়সাল বলেন, ‘ভূকম্পন অনুভূত হলে গাড়ি থামাই। আমার তখন শুধু মনে হচ্ছিল, এটা কত বড় এক বিপর্যয়। আমি তখন অসহ্যরকম আহাজারি ও কান্না করতে থাকি।’ শক্তিশালী ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এক জনপদের রূপ নিয়েছে মারাকেশ ও এর আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা। বড় বড় ভবন ধসে পড়েছে। বিধ্বস্ত ভবন থেকে বের করা হচ্ছে মরদেহ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকাজের জন্য সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। ভূমিকম্পে আহত ব্যক্তিদের রক্ত দেওয়ার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে স্বেচ্ছায় রক্তদানের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো। এদিকে ভূমিকম্পের ফলে মারাকেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। প্রাণঘাতী এ ভূমিকম্পের ঘটনায় মরক্কোর প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের নেতারা। সমবেদনা জানিয়েছে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাও (ওআইসি)।