নৈতিকতা বলতে সেই গুণকে বুঝায়, যা মানুষকে অন্যায় থেকে বিরত রাখে এবং ন্যায় কাজে নিয়োজিত রাখে। জীবনের সব ক্ষেত্রে মনুষ্যত্ব ও নীতি-আদর্শ শিক্ষাকে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। নৈতিকতা মানুষকে উত্তম চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তোলে এবং সমাজে সম্মানের অধিকারী করে। অন্যদিকে নৈতিকতার শিক্ষা না থাকলে শান্তি থাকে না। ফলে সমাজে দুর্নীতি, সন্ত্রাসী, চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা, মাদক, ইভটিজিং ইত্যাদি ঘৃণিত কাজ বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যে দয়া, মায়া ও ভালোবাসা প্রভৃতি সদগুণাবলীর চর্চা থাকে না। এতে মানুষ পরস্পরকে অবিশ্বাস ও সন্দেহ করে এবং সমাজে নানা অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির সৃষ্টি হয়। এতে দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নৈতিকতা নেই বললেই চলে। আর সেটা তরুণদের দেখে বেশি উপলব্ধি করা যায়। বর্তমান সমাজে বেশি উচ্ছৃখল হয়ে পড়েছে তরুণরাই। তারা বড়দের দেখলে সাধারণত কোনো সম্মান করে না। আজকের তরুণরাই দেশ বা জাতির ভবিষ্যৎ। তারা যদি নৈতিক শক্তির অপব্যবহার করে তাহলে ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবে কারা? বর্তমান তরুণ-তরুণীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে শুধু নৈতিকতার শিক্ষা না থাকার কারণে। তারা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে বিপথগ্রস্ত এবং হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। এমন কাজ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অনেকে। ইভটিজিংয়ের মতো ঘৃণিত কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না অনেকে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে শহরের অলি-গলিতে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে তরুণীরা। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে তারা। এমন ঘৃণিত কাজ পুরুষদের জন্য কলঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ছোট থেকে সন্তানদের নৈতিকতায় শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিকল্প নেই। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, উত্তম চরিত্র গঠনে এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে নৈতিকতার চর্চা সবার জন্য জরুরি।
ভালো মানুষ হতে হলে শিষ্টাচার বা ভদ্রতার গুণটি অত্যন্ত আবশ্যক। এ গুণ অর্জন করে যে কেউ নিজেকে উন্নত এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে। ছাত্রজীবন, চাকরিজীবন সব ক্ষেত্রে সফলতা বয়ে আনতে পারে। মানুষ স্বভাবতই বিনয়, নম্রতা ও শালীনতা পছন্দ করে। পাশাপাশি ঔদ্ধত্য কিংবা দাম্ভিকতা কেউ পছন্দ করে না। শিষ্টাচার অর্জন করার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয় না। দরকার সদিচ্ছা আর সাধনা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিষ্টাচার শিক্ষার সূচনা হয় মূলত পরিবার থেকে। শিশুদের যদি পারিবারিকভাবে সুশিক্ষা দেওয়া হয় তবে তারা হয়ে ওঠে আদর্শবান ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। পারিবারিক কলহ বিবাদের মধ্যে বেড়ে ওঠা বা রূঢ় আচরণ দেখা শিশুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তার পক্ষে বিনয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আমাদের সমাজ থেকে শিষ্টাচার বা ভদ্রতা যেন ক্রমেই উধাও হয়ে যাচ্ছে। কেউই ছোট হতে চায় না। সবাই ভাবে, লোকে আমাকে বড় মনে করুক, সম্মান করুক। সম্মান পেতে হলে আগে অন্যকেও সম্মান করতে হয়, এটা আমরা ভুলে যাই। সম্মান ও স্নেহ করার শিক্ষা এখন কেবল বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। কেউ কোনো উপকার করলেও আমরা ধন্যবাদটুকুও জানাতে কুণ্ঠাবোধ করি। আমাদের মধ্যে সহনশীলতার বড়ই অভাব। কারো ভালো কিছু আমরা সহ্য করতে পারি না। আমাদের মধ্যে প্রচ- ইগো কাজ করে। কোনো কিছুতে একটু কমবেশি হলেই এটা আমাদের ইগোতে লাগে। আর এসব ছোটখাটো বিষয় নিয়েই সমাজে বেড়ে যায় মারামারি, হানাহানি, কিংবা খুনখারাবির মতো ঘটনা। আমাদের চক্ষুলজ্জাও অনেক কমে গেছে। রাস্তাঘাটে মেয়েদের দেখলে ইভটিজিং করা, অনুমতি না নিয়ে কারো ঘরে ঢুকে পড়া যেন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাসে উঠলে দেখা যায়, মুরব্বি, মহিলারা দাঁড়িয়ে আছে অথচ তাদের জন্য সিটটি ছাড়তে সকলেই নারাজ। এটি ভদ্রতার খুব সামান্য নমুনামাত্র। অথচ আমরা সেটা করি না। অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনেও চলছে এসব।
এখন সমাজ এতটাই ঘুণে ধরেছে যে, কাউকে একটু হেনস্তা করতে পারলেই আমরা যেন পৈশাচিক আনন্দ লাভ করি। কথা বলার মাঝে গালিগালাজ না করতে পারলে যেন, কথাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। নামে বেনামে ফেক আইডি খুলে অন্যকে জ্বালাতন করা, ভিন্ন মতাবলম্বীর কোনো পোস্ট কিংবা ভিডিওতে অযাচিত মন্তব্য করা অনেকের নেশা হয়ে গেছে। সাথে ট্রল তো আছেই। এর বিপরীতে আছে আবার নিজ দল কিংবা গোত্রের প্রতি অতিরঞ্জিত তৈলমর্দনের হিড়িক। এ ছাড়াও রয়েছে মোসাহেবি, তোষামোদি, যা থেকে দূরে থাকা উচিত। কেননা, এতে ব্যক্তিত্ব ক্ষুণœ হয়। একজন সুনাগরিক এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি শিষ্টাচারী হবেন এমনটাই বাঞ্ছনীয়। কেননা এখন মানুষ আগের মতো অরণ্যে বসবাস করে না, তাকে সমাজের আর দশজনের সঙ্গে মিশতে হয়। তাদের সঙ্গে নানা সম্পর্কে জড়িয়ে থাকতে হয়। আর এসব সম্পর্ক তখনই সুষ্ঠু ও সুন্দর হতে পারে যদি আমরা সৌজন্য, ভদ্রতা ও সহানুভূতিসম্পন্ন হতে পারি। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট