বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠের খেলোয়াড় কি সবই হায়ার করে আনা? সরকার গঠনে নিয়ামক শক্তি ভোটার কারা? প্রশ্নগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেই রাখা যায়। এমন বলার সুযোগ নেই, সরকারি দল কিংবা বিরোধী দল একটি বিদেশমুখী, আরেকটি নয়। তারা বিদেশের সহযোগিতা চায় এটা যেমন প্রতিষ্ঠিত সত্য, একইভাবে দুই পক্ষই সেটা অস্বীকারও করে, এটাও সত্য। একইভাবে একে অন্যের বিরুদ্ধে বিদেশমুখী হওয়ার অভিযোগটিও সমান তালে করে। একে অন্যকে দোষারোপ করে জনভিত্তি না থাকার কথা বলে। তাদের বক্তব্য কখনো কখনো স্ববিরোধীও হয়ে যায়। যেমন বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। কয়েক মাস আগে তিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন, ‘আওয়ামী লীগ এখন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতায় থাকতে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে তারা (আওয়ামী লীগ) আজ পরাজিত হয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে।’ (দৈনিক বাংলা, ২৭ এপ্রিল ২০২৩)
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর এই বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, তারা জনসম্পৃক্ত এবং তারা বিদেশিদের মুখাপেক্ষী নয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। কিন্তু আবার যখন তাদের দলের মহাসচিবের বক্তব্য পড়ি, তখন উলটোটাই চোখে পড়ে। সম্প্রতি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য বিদেশিদের সহযোগিতা চেয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো দেশের গণতন্ত্র বিলুপ্ত হলে কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই সেই দেশে জনগণকে নিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। জনগণ গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দেবে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি যখন বলেন, ‘আপনাদের (গণমাধ্যম) মাধ্যমে সব আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে, ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির কাছে, একই সঙ্গে জনগণের কাছে বলতে চাই, আসুন আজকে আমরা বাংলাদেশের মানুষকে তার গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে দিতে, তার ভোটের অধিকার ফিরে দেওয়ার জন্য পাশে দাঁড়াই।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ৩ সেপ্টেম্বর ২০-২৩) এমন বক্তব্য প্রমাণ করে, আওয়ামী লীগ নয়, তারাই চান বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করুক। তার মানে, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী যে অভিযোগটি করেছেন, সেই অভিযোগ সেপ্টেম্বরে এসে নিজের দলের মহাসচিবের ওপরই পড়ে যায়। অর্থাৎ, তারা বিদেশিদের সহযোগিতায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্যের সংবাদ। মাত্র দুই দিন আগে তাদের দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মহসচিবের বক্তব্যের উলটো কথা বললেন, ‘জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিচ্ছে আ.লীগ’ ( এসএ টিভি, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। বিএনপি বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়Íএই অভিযোগ আওয়ামী লীগেরও। প্রাসঙ্গিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার পেয়েছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে বিএনপির পক্ষ থেকে জোরালো লবিং করা হচ্ছে, আগামী মেয়াদে যেন বাংলাদেশের সরকার গঠন করতে পারে বিএনপি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিভিন্ন বিদেশি ব্যক্তির সরকারের কাছে আবেদনের বিষয়টি। বিষয়টি বিশ্লেষকগণ ভিন্নমাত্রায় বিশ্লেষণ করছেন। তাদের বক্তব্য, যা সরকারের বিপক্ষে যায় তা-ই তাদের কথা। পরোক্ষভাবে এই আবেদন প্রক্রিয়াকেও তারা বিএনপির পক্ষে বলে মনে করছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় বিদেশিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রয়োজন আছে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য বিদেশি সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। সেটা শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, সব দেশেরই প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশে কে সরকারে আসবে, কাকে নির্বাচিত করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত তো গ্রহণ করবে বাংলাদেশের জনগণ। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলো যদি বিদেশিদের সহযোগিতায় রাজনীতি করতে চায়, তাহলে তাদের জনভিত্তি না থাকার বিষয়টিই প্রমাণিত হয়ে যায়। এটাকে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাও বলা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো কি তাহলে জনগণের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে? বিরোধী দলগুলো বছরের পর বছর জনগণের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে। তার পরও তাদের কেন বিদেশিদের কাছে যেতে হবে? তার মানে তারা নিজেরাই প্রমাণ করছে, জনগণ তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। যদি জনগণ তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারত, তাহলে তাদের কথা অনুযায়ী দেশে যখন গণতন্ত্র অনুপস্থিত, সেই গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে জনগণ তাদের আগেই মাঠে নেমে পড়ত। সেই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তাদের বিদেশিদের পাশে থাকার আবেদন জানাতে হতো না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ এই পরিস্থিতিকে হতাশার বহিপ্রকাশ হিসেবেও আখ্যায়িত করছেন। আলোচনায় এমন কথাও উঠে আসছে, জনসমর্থনকে পুঁজি করে বা জনগণকে সংগঠিত করার কোনো রকম ইচ্ছাই দলটির নেই, একমাত্র বিদেশের দিকে চেয়ে থাকাই তাদের ভরসা।
লক্ষণীয় যে, আগে তারা বিদেশি দূতাবাসে গিয়ে কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চেয়েছেন, এমন তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তখন তাঁরা এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গণমাধ্যমগুলোও এমনভাবে সংবাদ প্রকাশ করেছে, যাতে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই ইতিহাস এটা। কিন্তু যে মুহূর্তে একটি দলের মহাসচিব সরাসরি প্রকাশ্যে বলেন যে, তাদের পাশে যেন বিদেশিরা থাকে, তখন আর কিছুই বাকি থাকে না। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা তেমন একটা নেই। এত দিন তারা নিজেদের উপলব্ধিটাকে শেয়ার করত নিজেদের মধ্যে। কিন্তু এখন রাজনৈতিক দলগুলোই প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে জনসম্পৃক্ত হওয়ার বিকল্প নেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র রক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই মূল শক্তি দেশের জনগণ। জনগণকে বাদ দিয়ে কোনোটাই সম্ভব নয়। সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠায় জন আস্থা অর্জন অপরহার্য। সেই কাজ কতটা সাফল্যজনকভাবে করা হলো, তার ওপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাফল্য-ব্যর্থতা। এটি না করতে পারলে বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে কোনো লাভ হয় না। খেলার মাঠে বিদেশি খেলোয়াড় হায়ার করে এনে খেলায় জেতা যায়, রাজনীতির মাঠে বিদেশি খেলোয়াড়েরা গণতন্ত্র বিজয় করে দিতে পারে না। এই সত্য নিশ্চয়ই রাজনৈতিক নেতাদের অজানা নয়। ( উৎস:দৈনিক ইত্তেফাক) লেখক: সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক