জঙ্গলায়নে কিছুক্ষণের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন শুরু হবে। অনেক বিষয়- আঞ্চলিক ও জাতীয়, ম্যাক্রো ও মাইক্রো, মোটা ও পাতলা, নরম ও শক্ত, ছোট ও বড়, দেশী ও বিদেশী বা ঘরে-বাইরের ব্যাপার নিয়ে খোলামেলা কথা বলবেন সুন্দরবনের বাঘ বানর হরিণ কুমির (বাবাহকু) সমিতির সভাপ্রধান সুন্দর মিয়া। চলমান ঘটমান বর্তমান মুহ্যমান মালমশলা মিডিয়ায় মেশাতে নাকি রেডি রাখা হয়েছে। পেষানোর জন্য শিলপাটাও রেডি। শিলপাটা জাদুঘরে যাওয়ার জোগাড়। ব্লেন্ডিং মেশিন নামের এক যন্ত্র আছে, তাতে বামপন্থী-ডানপন্থী জোট মহাজোট সব ধরনের ফলমূল মশলা মেশানো যায়, পেষানো যায়। বাবাহকু ঐতিহ্যবাহী সংগঠন, তাদের প্রচার ও প্রসারবিষয়ক সম্পাদক সবুরান সাসাসান সব সময় আদি অকৃত্রিমতায় বিশ্বাসী। তিনি চকমারির হুলোর জেলেপাড়ার মালোদের কাছ থেকে আদি শিলপাটা আনিয়েছেন। সবুরানের নিজস্ব কনস্টিটিউনেসি চকমারি। তার পিতা প্রায় ২৫ বছর একটানা এ আসন থেকে উচ্চকক্ষ বনে-জঙ্গলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নবীন নেতা সাবুরানের সুন্দর মিয়ার নজরকাড়া এ মুহূর্তে বড্ড প্রয়োজন কেননা, সামনে বড় একটি ডাক আসার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। নিদেনপক্ষে জাঁদরেল ও গণগুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে না হোক সংসদীয় কমিটির কর্তা হওয়ার সুযোগ যেন ঠিক সামনে তার। দেশের একটি পেটমোটা (অনেক পাতা ভরে বহু খবরাখবর নিয়ে) নতুন পত্রিকার মফস্বল সংবাদদাতা সুশীল সানা, তার বাড়ি সুন্দরবন সন্নিকটবর্তী জনপদে। যে অঞ্চলের খবর সুশীল সুবোধ বালকের মতো পরিবেশন করে সেটি পৃথিবীর শেষ জনবসতি-ভূমিপ্রান্ত, কেননা, মানচিত্রে দেখা যায়, তার ভূখ-ের পর সুন্দরবন, তারপর বঙ্গোপসাগর, তারপর শুধু পানি আর পানি সেই অ্যান্টার্কটিকা ওরফে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত। অসময়ের গলাবাজি পত্রিকার মফস্বল সংবাদদাতা এ জন্য নিজেকে আলাদাভাবে আলাদা মনে করেন। তিনি এভাবে বুদ্ধিদীপ্ত সংবাদ পরিবেশনে নিবেদিত নিষ্ঠাবান। সম্প্রতি লোকালয়ে ঘনঘন বাঘ চলে আসা, বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু আর মানুষের হাতে বাঘের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি ভুল বোঝাবুঝির পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে কিংবা কোনো স্বার্থান্বেষী মহল এটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে বাবাহকুর উচ্চ পরিষদের ধারণা। মাঝে মধ্যে এমন ঘটনাও ঘটছে যে, মানহানির মামলা জুড়ে দিতে তৃণমূল থেকে চাপ আসছে। তৃণমূলকে উপেক্ষার উপায় নেই। বাবাহকুর প্রেসিডিয়াম মনে করে, ভুল বোঝাবুঝির ডালপালা লম্বা হয়ে আগাছায় পরিণত হওয়ার আগে এসব ব্যাপারে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা হলে ভালো হতো, কিন্তু কার সাথে কার আলাপ বা সংলাপ, সে সংলাপের কার্যপরিধি নির্ধারণ নিয়েও সমস্যা আছে এই মনে করে বাবাহকু সংসদের কথক (স্পিকার) সেদিন রুলিং দিয়েছেন এ ব্যাপারে তথ্য দফতর প্রয়োজনবোধে সংবাদ সম্মেলন করতে পারে। শোনা যায়, হরিণা হাপান তথ্য অধিদফতরকে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রস্তুতি চলছে। কচিখালীর ক্যানেলটা যেখানে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে দূরে বেশ একটা জটলা সুন্দরী গাছের মিছিলের সামনে চরের চত্বরে। মনে হচ্ছে চারদিকে একটা নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। ক্যানেলটিতে কুমিরের দল ভাসমান অবস্থায়, তীর ঘেঁষে একদল বানর শক্ত অবস্থান নিয়েছে, আকাশে ২০-২৫টির মতো শঙ্খচিল অনবরত উড়ে জটলা স্থলকে পাহারা দিচ্ছে, আটটি তাগড়া মহিষ মঞ্চের চারধারে ঠায় দাঁড়িয়ে। ছোটখাটো অথচ নয়নাভিরাম মঞ্চ তৈরি দেখে বোঝা যায় ‘মিট দ্য প্রেস’ ধরনের একটা ঘোষণা মঞ্চ যেন, বেত, হেতাল আর বাইন কাঠের সমন্বয়ে তৈরি দুটো চেয়ার সেখানে পাতা। সুশীলের মনে হলো এ সেই সংবাদ সম্মেলন না তো। কিন্তু আর কাউকে তো সে দেখতে পাচ্ছে না। সে নিজেও কোনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পেয়েছে কিনা মনে করতে পারছে না। ক্যানেলটা অন্য সময় ট্যুরিস্ট লঞ্চে ভরা থাকে, অদূরে পর্যটনের একটি মোটেল ছিল সেটিও তো তার চোখে পড়ছে না, তার দেখতে ভুল হচ্ছে না তো, যদিও স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে তার ব্যাপারটি। সে লঞ্চ থেকে নামবে না, যদি পাছে তার বসার সিটটা বেহাত হয়ে যায়। তার পত্রিকার মালিকের মুখে শোনা গল্প- একবার তিনি ভেড়ামারা গিয়েছিলেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে। বাস থেকে অন্যরা নামলেও সম্পাদক সাহেব নামলেন না। ট্যুরিস্ট বাসে সুন্দর একটি সিট তিনি পেয়েছিলেন। ভাবলেন ব্রিজ দেখতে গেলে কেউ যদি তার সুন্দর সিটটিতে বসে পড়ে! ব্রিজ দেখতে এতদূরে এসেও সিটের নিরাপত্তা চিন্তায় সম্পাদক সাহেব! সুশীল একই কথা ভাবছে কচিখালীর ক্যানেলে।
এ মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, সে মঞ্চটির একেবারে কাছে। মঞ্চে একটি মোটাসোটা নাদুসনুদুস অথচ বয়স্ক বাঘ এবং একটি অতীব সুন্দর হরিণ বসে। বাঘটি গম্ভীর প্রকৃতির তবে তার মুখে সৌম্য সমুজ্জ্বল হাসির রেখা বোঝা যায়, কোন একটা সংস্থার চেয়ারম্যানকে একসময় সে এরকম দেখেছিল, তবে মনে করতে পারছে না। আর হরিণ (হরিণী নয় তো! এত সুন্দরী!) বেশ মার্জিত মেজাজ আর রূপ মনোহর মনে হলো। বাঘটি মুখ খুলল প্রথমে- ‘আমি সুন্দর মিয়া বাবাহকুর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রধান। আজকে আমাগো বিশেষ সংবাদ সম্মেলনে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি গো’ বড় ভারী গলা, উচ্চারণ বাজখাই। আঞ্চলিক টান তো আছেই। ‘প্রথমে আমাদের পক্ষে হরিণা হাপান (হরিণটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে) একটি লিখিত বক্তব্য দেক, তারপর আপনাগো সব প্রশ্নের জবাব দেবানে।’ সংবাদ সম্মেলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ‘সুন্দর মিয়া …’ অত্যন্ত দুঃখির বিষয় যে আমাদের সাথে লোকালয়ের ছোট পীরদের মধ্যি দূরত্ব সৃষ্টির চেষ্টা চলতেছে, আমরা ভুল বোঝাবুঝির শিকার হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে, এটি আমাগো কারুর কাম্য না কিন্তু। আমাগো মধ্যি মনোমালিন্য সৃষ্টি হলি আমরা উভয়পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হতি পারি। এ বন এবং এর পাশের লোকালয় সব আমাদের। আমরা একে অন্যের। আমরা বনে বাস করি বলে স্রেফ নিজেদের স্বার্থে পাহারা দেইনে, আমরা পাহারা দেই বলে লোকালয়ের বিস্তর মানুষের কর্মসংস্থান হয় এখানে, আমরা কেন পরস্পরের আক্রমণের শিকার হবো? মাঝে মধ্যে অমূলক আশঙ্কা কিংবা অনাবশ্যক বিষয় নিয়ে অনেকে এমন মন্তব্য করেন যে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানহানির মামলা করার পরামর্শ আমরা পাই। কিন্তু আমরা মামলাবাজ না, কোর্ট কাচারি করতি আমাগো ভালো লাগে না। আমাদের প্রচার বিভাগের প্রধান হরিণা হাপান বিভিন্ন দিক আগে তুলে ধরবে, সে সাম্প্রতিক সময়ের তিক্ত ও দুঃখজনক কিছু ঘটনার কথাও তুলে ধরবেনে যা বুঝতি সাহায্য করবে কেন আমরা এরকম অবস্থায়। এরপর আপনাগো সব প্রাসঙ্গিক, মার্জিত ও শুধু দলমতনিরপেক্ষ প্রশ্নের জবাব আমরা দেবো। শেষে আমরা আপ্যায়নের পরিবর্তে ঐতিহ্যবাহী কিছু সামগ্রী উপহার দেবানে সবাইকে। আপ্যায়নে অনেক অপচয় হয়, অনেকে খেয়েও বলে খাইনি, পেয়েও বলে পাইনি, অনেক জাগায় এ উপলক্ষে মারামারিও হয় নাকি শুনিছি। আমরা আপ্যায়ন আনুষ্ঠানিকতার বিরোধী না, তবে যেম্মায় এটি করা হয় তার পন্থী না।’ হরিণা দাঁড়ানোর আগে বেশ সুদর্শন চার-পাঁচটি বিড়াল উপস্থিত সাংবাদিকদের হাতে একটি ফ্যাক্ট শিটের মতো মনে হলো, দিয়ে গেল। আজকাল এটি একটি চল হয়েছে যে, সংবাদ সম্মেলনে আগে থেকে লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য দুটো হতে পারে- ১. সাংবাদিকদের সামনে এক্সটেম্পোর বক্তৃতা দিতে অনেকে ভয় পান, কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলা হয় আর সাংবাদিকরাও তা কিভাবে নোট করে কে জানে, লিখিত দেয়া থাকলে যে বক্তব্য দেয় তারও সুবিধা আর ডকুমেন্ট থেকে রিপোর্ট করতেও সুবিধা; ২. যারা রিপোর্ট লেখেন এক্সটেম্পোর বক্তৃতা থেকে তারাও তাড়াতাড়ি সব নোট করতে পারেন না, তাছাড়া মতাদর্শ অনুযায়ী একই বক্তব্য একেকজন একেকভাবে শোনে বা লেখে, সে ঝামেলা তো আছেই। এসব এড়াতে আজকাল শুধু সাংবাদিক সম্মেলন না, যেকোনো সভার প্রেস রিলিজ উদ্যোক্তারা আগে ভাগে তৈরি করে মিডিয়ার হাতে দিয়ে দেন। বাঁধাধরা পছন্দমতো মন্তব্য ও শব্দে ঠাসা এই রেডিমেড নিউজ থেকে নিউজ তৈরি করার ক্ষেত্রে কতই না মজার ঘটনা ঘটে। সভায় রিপোর্টার নিজে উপস্থিত না থেকেও নিউজ করতে পারেন, অনেক মহাজন বাক্য কোনো বক্তার মুখ দিয়ে বলানো যায় যদিও তিনি তা বলেননি, এমনকি অনেক সময় দেখা গেছে সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথির বক্তব্য রেডিমেড প্রেস রিলিজে আছে অথচ বাস্তবে, অনিবার্য কারণে, তিনি বা তেনারা সেই সভাতে দৈহিকভাবে উপস্থিত হতে পারেননি। এ পথ ও পন্থা সুশীলের ভীষণ অপসন্দ, এটি পেশাদারিত্বের পরিপন্থী। যা হোক হরিণা লিখিত বক্তব্য পাঠ শুরু করল বেশ মোহনীয় কোমল স্বরে- সম্প্রতি দু’টি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি যুক্তিপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। বাবাহকু পরিষদ উভয় দেশের সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছে। বাবাহকু সশ্রদ্ধচিত্তে স্বাগত জানাতে চায় উভয় দেশের বাঘদের সংরক্ষণ সহযোগিতা বৃদ্ধিকল্পে সম্পাদিত চুক্তিটির জন্য। এটি একটি মাইলফলক। আমরা বহু দিন যাবৎ এ জাতীয় সহযোগিতা চুক্তির দাবি করে আসছিলাম। গত বছর নিখিল ভারত বাঘ ফেডারেশনের সভাপতি গিরিদারিদারাজাতু এসেছিলেন শুভেচ্ছা সফরে। তিনি সে সময় এরকম একটি সম্ভাবনাময় সুখবর সন্দেশের আভাস দিয়েছিলেন। হরিণা নাতিদীর্ঘ এই বিবৃতি সুন্দর করে পাঠ করলেন। একটি ময়না এসে তাকে পানীয় জাতীয় কিছু একটা খেতে দিলো। মনে হলো সে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। তার বক্তব্যে আঞ্চলিকতার টান নেই, সব কিছু গোছালো তথ্যভিত্তিক। তার উচ্চারণ বেশ বলিষ্ঠ, সুরেলা তার কণ্ঠ, বাচনভঙ্গিতে মনে হয় সে কোনো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত। এরপর সুন্দর মিয়ার সাথে কানে কানে ফিসফিস করে কী যেন বলল। সুন্দর মিয়ার নির্দেশনা সে বেশ বুঝতে পেরেছে এরকম একটি সায় দিয়ে সে আবার দাঁড়াল সামনে। সাম্প্রতিককালে বাঘের আক্রমণের শিকার মানুষদের এবং মানুষদের হাতে বাঘের মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত, সুশীল আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, লোকালয়ের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত চারটি নিউজ (ঘটনাস্থল সুবিদখালী স্টেশন, শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, সুন্দরবনসংলগ্ন মোলাখালী, খুলনার দাকোপ উপজেলার কালাবগি এলাকা) সে সরাসরি তুলে ধরল।
ঘটে যাওয়া উপরের চারটি ঘটনার উল্লেখ করে হরিণা বলেন, আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত এসব অতর্কিত আক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য। তবে লক্ষণীয় যে প্রতিটি ক্ষেত্রে আক্রমণগুলো হয়েছে আমাদের নিজস্ব বিচরণ ক্ষেত্রে আচমকা এবং আমাদের নিজস্ব সময়ে পড়ন্ত বেলায় কিংবা গভীর রাতে। যারা যে কাজে যে এলাকায় যে সময়ের জন্য অনুমতি নিয়ে এসেছেন ঘটনাগুলো সে সময়ে সে এলাকায় সে কাজের কালে ঘটেনি। যা হোক, আমরা প্রত্যেকটি ঘটনায় অভ্যন্তরীণভাবে সুষ্ঠু তদন্তের ব্যবস্থা নিয়েছি। আমাদের সব তদন্তের রিপোর্ট যথাসময়ে দাখিল হয়, ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। লেখক : রসরচয়িতা, উপকূলীয় উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক