সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৪:৫৫ পূর্বাহ্ন

পানি জীবন, পানিই খাদ্য কেউ থাকবে না পিছিয়ে

কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৩

জীবজগতের অস্তিত্বে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখছে পানি। মানুষের জীবন ধারণের জন্য অক্সিজেনের পরই পানি দ্বিতীয় উপাদান। মানুষের রক্তে ও কোষে পানি অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে থাকে। মানবদেহে ২৫ শতাংশ অক্সিজেন পানি থেকেই আসে। নিয়ম মেনে পানি পান করলে দেহের ওজন কমানো থেকে শুরু করে ক্যানসারের ঝুঁকি পর্যন্ত কমানো সম্ভব। পানির রাসায়নিক ও ভৌত বৈশিষ্ট্য এটিকে অন্যান্য তরলের চেয়ে বেশি পদার্থ দ্রবীভূত করতে সক্ষম। পৃথিবীর সকল প্রকার প্রাণী, গাছপালা, তরুলতা সবাই পানির ওপর নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত ও নিরাপদ খাবার পানি মানবাধিকার ধারণার পূর্বশর্ত। বিষাক্ত পানি পান করে রোগ জটিলতায় মৃত্যুবরণ পর্যন্ত ঘটতে পারে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, আগামী দিনে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহই হবে পৃথিবীর অন্যতম কঠিন চ্যালেঞ্জ। পানির অন্য নাম মরণও হতে পারে। এক ফোঁটা নোংরা পানিতে ৫ কোটিরও বেশি জীবাণু থাকতে পারে। বন্যা ও খরা বিশুদ্ধ পানির উৎসকে ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া এবং টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত গবেষণা মতে, পাইপলাইনের পানির ৮০ ভাগেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। পুকুর ও টিউবওয়েলের পানিতেও এই ক্ষতিকর অণুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়াকে দায়ী করা হয়। জৈব ও অজৈব দূষকযুক্ত পানি পান করলে চর্ম রোগ, যকৃত বিকল, কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হওয়া, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, কার্সিনোজেন, ফুসফুসের কার্যকারিতা ধ্বংস হতে পারে। ভারী ধাতু মিশ্রিত পানি পান করলে দেহের এনজাইমের কার্যকারিতা নষ্ট, মস্তিষ্ক ও হাড়ের ক্ষয় এবং পঙ্গুত্ব হতে পারে। শুধু পানি দূষণের কারণেই প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ১ হাজার ৪০০-এর বেশি এবং বাংলাদেশে প্রায় ৮০ জন লোকের মৃত্যু হয়।
ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশে কৃষি কাজে ব্যবহূত মোট পানির ৭৮ ভাগ পানি হচ্ছে ভূগর্ভস্থ। বিএডিসির গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশের ডেলটা প্ল্যান ২১০০ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৭০ ভাগ অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ মিটার উচ্চতার মধ্যে অবস্থিত। এতে বন্যার আশঙ্কা প্রবল। যার প্রভাবে প্রায় ৩ হাজার মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যেতে পারে এবং সার্বিক উৎপাদন শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে
পৃথিবীর মোট জলভাগের প্রায় ৯৭ দশমিক ৩ শতাংশ হচ্ছে লোনাপানি আর বাকি ২ দশমিক ৭ শতাংশ হচ্ছে স্বাদু পানি। বিশ্বে স্বাদু পানির প্রায় ৬৯ শতাংশ রয়েছে ভূগর্ভে আর ৩০ শতাংশ মেরু অঞ্চলে বরফের স্তূপ হিসেবে জমা আছে এবং মাত্র ১ শতাংশ আছে নদী ও অন্যান্য উেস। ভূগর্ভস্থ পানি অধিক উত্তোলনের কারণে প্রাকৃতিক পানি সম্পদের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ বাড়ছে। এই চাপ মোকাবিলায় নদী অববাহিকায় উজানের দেশগুলো কৃষি ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সংরক্ষণের জন্য গড়ে তুলছে বিশালাকার বাঁধ বা ড্যাম। উজানের দেশগুলোর বাঁধ নির্মাণের কারণে ভাটি অঞ্চলের দেশগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যার চরম খেসারত দিচ্ছে নিচু অঞ্চলকে। এছাড়াও নদীগুলোতে পলি জমা হয়ে নাব্য কমে যাওয়ার কারণে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
পানির সংকট একটি বৈশ্বিক সংকট। পরিবেশ বিপর্যয়, বিশ্বায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ণ, পানি দূষণ ও অপচয় হলো পানিসংকটের অন্যতম কারণ। এছাড়া যথাযথ অবকাঠামোর অভাব এবং জোরপূর্বক অভিবাসন বা শরণার্থী সংকটও পানিসংকটের জন্য দায়ী। মানুষের বিভিন্ন কর্মকা- ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে এ সংকট। ওয়াটার এইডের গবেষণা মতে সুপেয় পানি পাচ্ছে না দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। নিরাপদ পানির অধিকারবঞ্চিত বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই চরম দরিদ্র।
ক্রমবর্ধমান পানির সংকট বিশ্বব্যাপী চরম অস্থিরতার সৃষ্টি করতে পারে। বিজ্ঞানীরা পানির সংকটের পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন। মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফের স্তূপ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লোনাপানির প্রবেশ বাড়ছে। এছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক, পারদ, লোহা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রেট, ফ্লোরাইড ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ ও দূষক ইত্যাদিও বিশুদ্ধ পানিসংকটের অন্যতম কারণ। বর্তমানে যে পরিস্থিতি, তাতে সংকট সমাধানে পুরো বিশ্বে পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে চিন্তার সময় এখনই। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো অচিরেই বিশ্ব এমন এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হবে যেখানে বন্দুক, মিসাইল কিংবা পারমাণবিক বোমা নয়, পানিই হবে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। জলবায়ু বিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ শতাংশ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি সংস্থাটি সারা বিশ্বের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে সুপেয় ও বিশুদ্ধ পানির স্বল্পতাকে। ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবল ঘাটতি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। আমেরিকার ওয়াটার ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন তাদের সর্বশেষ গবেষণায় জানিয়েছে, মধ্যপ্রাাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে রয়েছে পানিসম্পদের বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দেশে পানির স্বল্পতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদ বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে এবং এ কারণে নিরাপদ সুপেয় পানিপ্রাপ্তি হবে আগামী বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জ। সুপেয় পানির পরিমাণই যেখানে দিনকে দিন কমছে, সেখানে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো এই নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিসম্পদের জন্য লড়বেন শিগিগরই সেটা নিশ্চিত। পানি ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে পানির পুনঃব্যবহার এবং সমুদ্রের পানি নির্লবণীকরণ। এই পদ্ধতি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, ইসরাইলসহ আরো অনেক দেশ সমুদ্র থেকে লবণ পানি তুলে পরিশোধন করে নিয়ন্ত্রিত চাষাবাদ করছে। জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের পানি ব্যবহার করে। সেখানে সরকারি বিধান অনুযায়ী সব আবাসিক-অনাবাসিক, সরকারি-বেসরকারি ভবনে পানীয় জলের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয় এবং অন্যান্য ব্যবহারের জন্য অন্য লাইনে ভূপৃষ্ঠের পানি ব্যবহার করা হয়। অনেক ভবনে ব্যবহূত ভূপৃষ্ঠের পানি ফিলটার করে পুনঃব্যবহার করার ব্যবস্থা থাকে। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে, ফিলটার করে পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ছয় নম্বরটি সুপেয় পানি নিয়ে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে শতভাগ নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ নিরাপদ পানি প্রাপ্তিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার পরও বিশ্বের ৭৮ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২ কোটি ৬০ লাখ। অনিরাপদ পানীয় জলের কারণে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
ইউনিসেফ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী নিরাপদ পানির সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুই-তৃতীয়াংশের বসবাস ১০টি দেশে, যার মধ্যে চীন, ভারত, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। পানি ছাড়া মানব অস্তিত্ব অসম্ভব। আন্তর্জাতিক আদালত ও বিভিন্ন দেশের স্থানীয় আদালত পানিকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জলবায়ু সংকট আরো প্রবল হলে বৈশ্বিক সুপেয় পানির সংকট আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে। দেশের কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশুদ্ধ পানির অধিকার প্রতিষ্ঠায় এখন থেকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি শুধু পানীয় জল হিসেবেই ব্যবহার করা উচিত। বৃষ্টিপ্রধান এ দেশে বর্ষা মৌসুমে পানিকে অবশ্যই ধরে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিশুদ্ধ পানির উৎসগুলো রক্ষা এবং জনগণকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের অঙ্গীকার সামনে রেখে সরকারকে আগামী দিনের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। লেখক: প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com