বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে গরু পাচার, জঙ্গি অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ঠেকাতে এবার ‘মৌমাছি যোদ্ধাদের’ কাজে লাগানো শুরু করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিরিউটি ফোর্স (বিএসএফ)। বিভিন্ন সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কেটে দিয়ে অপরাধমূলক কাজ করার চেষ্টা করা হয়। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিএসএফ এই নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে, জঙ্গিসহ অনুপ্রবেশকারী এবং চোরাকারবারিদের থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বেড়া সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে বিএসএফ মৌমাছি পালন শুরু করেছে। এই পদক্ষেপের ফলে বেড়া কাটা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা হচ্ছে বিএসএফের পক্ষ থেকে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কাদিপুর গ্রামে এই পাইলট প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছে। মৌমাছি পালন এবং ঔষধি গাছ চাষের ওপর ভারত সরকারের ‘সম্মিলিত পরিকল্পনা’-এর একটি অংশ, যা পাইলট প্রকল্প হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রহরারত বিএসএফের ৩২ ব্যাটালিয়নের অধীনে শুরু হয়েছে কাদিপুর গ্রামে। এরপর সীমান্তের কাঁটাতারের লাগোয়া বিভিন্ন গ্রামে পর্যায় ক্রমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। আশা করা হচ্ছে মৌমাছিরা ‘মৌমাছি যোদ্ধা’ হিসেবে কাজ করবে, যাতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী এবং চোরাকারবারিদের বেড়া কাটা থেকে বিরত রাখবে।
বিএসএফের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে প্রায় ২ হাজার ২১৭ কিলোমিটার। সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এবং স্থানীয় গ্রামবাসীদেরকে নিয়ে এপিকালচারের মাধ্যমে সাহায্য করার লক্ষ্যে নদীয়া জেলার সীমান্ত এলাকায় প্রথম এটি শুরু করা হলো।’
কেন্দ্রীয় আয়ুষ মন্ত্রণালয়কে এ প্রকল্পের জন্য বিএসএফ-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিএসএফকে মৌমাছিসহ মৌচাক সরবরাহ করেছে। এই মৌচাকগুলোই কাঁটাতারে বেড়াকে ঠিক রাখতে কীভাবে কাজ করবে তার প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। বিএসএফের ৩২ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ট সুজিত কুমার এই প্রকল্পের ধারণাটি তৈরি করেছেন। তিনি বলেন, “বিএসএফ ভারত সরকারের ‘ভাইব্রেন্ট ভিলেজ প্রোগ্রাম (ভিভিপি)’- এর অধীনে উদ্যোগ নিয়েছে এবং আয়ুষ মন্ত্রণালয়ের কাছে ঔষধি গাছ সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করে। ফুল দেয় এমন ধরনের গাছ এই মৌমাছির বাক্সগুলোর চারপাশে রোপণ করা যেতে পারে যাতে মৌমাছিরা প্রচুর পরিমাণে পরাগায়ন করতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার সঙ্গে মৌমাছির চাক রাখার এই প্রকল্পটি গত ২ নভেম্বর চালু করা হয়েছে। বিএসএফ মৌমাছি পালনে নিযুক্ত স্থানীয়দের এর সঙ্গে যুক্ত করেছে। এই উদ্যোগের জন্য গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খুব ভালো সাড়া পাওয়া গেছে।” বিএসএফের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, নদীয়া জেলার বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্তের অধীন সীমান্ত অ লগুলোতে গরু, সোনা, রূপা এবং মাদক চোরাচালানের মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধের প্রবণতা রয়েছে। অতীতে এমন উদাহরণ রয়েছে যখন দুর্বৃত্ত ও চোরাকারবারিরা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া হয় কেটে ফেলেছে বা কাটার চেষ্টা করেছে তাদের অবৈধ কার্যকলাপের জন্য। ওই মৌমাছিরা বেড়া কাটার চেষ্টাকারী চোরাকারবারিদের জন্য একটি প্রতিবন্ধক হবে কারণ এই ধরনের যেকোনও প্রচেষ্টা মৌমাছিদের বিরক্ত করবে এবং স্বভাব অনুযায়ী মৌমাছিদের ঝাঁক তাদের আক্রমণ করে গুরুতরভাবে আহত করবে।
ঠিক কতগুলো মৌমাছির বাক্স রাখা হচ্ছে তার সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা না হলেও, এগুলো নিয়মিতভাবে এবং চোরাচালান-প্রবণ অ লে কাঠের সাপোর্ট ফ্রেম ব্যবহার করে বেড়ার ওপর রাখা হচ্ছে। মৌমাছির বাক্সগুলোকে মাটি থেকে কিছুটা ওপরে রেখে বেড়ার পাশাপাশি স্থাপন করা হবে। বাক্সের চারপাশে কিছু ফুলের চারা রোপণ করা হবে এবং বাক্সের ওপর ছায়া দিয়ে মৌমাছিদের জন্য একটি প্রাকৃতিক আবাসস্থল তৈরি করা হবে। আয়ুষ মন্ত্রণালয় মৌমাছিদের মধু আহরণের জন্য বিএসএফকে সরিষা, তুলসী, একাঙ্গী, সাতমুলি, অশ্বগন্ধা, ঘৃতকুমারীর মতো ঔষধি গাছের চারা সরবরাহ করেছে। সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সদস্যরা স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত এলাকায় সেগুলো রোপণ করছে। নদীয়ার কাদিপুর গ্রামে একটি অনুষ্ঠানে স্থানীয় গ্রামবাসীদের জানানো হয়েছে, তারা এই মৌমাছি থেকে যে মধু আহরণ করবে, তা বিএসএফের পরিবার কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠিত দোকানের মাধ্যমে বিক্রি করা হবে। মধু বিক্রি করে যে লাভ হবে তা স্থানীয়দের কাছে যাবে।
জানা গেছে, এই প্রকল্পের সঙ্গে পূর্বা ল, জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ বোর্ড, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে, যারা প্রয়োজনীয় বীজ, মাটি পরীক্ষা, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের অধীনে ক্রমাগত জানার উপায় এবং গাছের চারা সরবরাহ করবে এবং কোনও ঝামেলা ছাড়াই এই প্রকল্পে উৎপাদিত মধু ক্রেতাদের কাছে যুক্তিসংগত বিক্রয় মূল্যে সরবরাহ করতে সহায়তা করবে। এর ফলে শুধু সীমান্ত নিরাপত্তা নয়, ওই অ লের ফসল উৎপাদনেও সাহায্য করবে।
পরিসংখ্যান বলছে, মৌমাছি ছাড়া বিশ্বব্যাপী ফসলের ফলন ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। মৌমাছিরা খাদ্য সংগ্রহের জন্য ফুলের ওপর ঘোরাফেরা করে, তাই পরাগায়নকারী হিসেবে তারা বিশ্বের জনসংখ্যার খাদ্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এই ‘মৌমাছি যোদ্ধারা’ এই বিপদের সমাধান করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাশাপাশি সীমান্তের লাগোয়া গ্রামে বসবাসকারী মানুষের সার্বিক উন্নয়নে সাহায্য করবে।-বাংলাট্রিবিউন