পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের সুগন্ধী কালোজিরা ধান। বেশি খরচ, কম লাভের কারণে এই ধান চাষে আগ্রহ হারা”েছন উপজেলার প্রান্তিক কৃষক। তারা বিকল্প হিসেবে আবাদ করেছেন গুটি স্বর্ন, স্বর্ন-৫.স্বর্ন ৪৯, স্বর্ন গোঠা. মোথা মোটা, বি-ধান ৪৩। কৃষি বিভাগের মাধ্যমে এই এই জাতের ধান আবাদে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা বা প্রর্শনী প্লট প্রকল্প গ্রহণ করলে বিলুপ্তির হাত থেকে তা ফেরানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। সূত্র জানায়, উপজেলায় কালোজিরা ধান স্থানীয় ভাষায় ঘুয়াধন (সুগন্ধী কালোজিরা) হিসেবে বেশ পরিচিত। এক সময় উপজেলার কৃষকদের মধ্যে জন প্রিয় ছিল কালোজিরা ধান। সর্বত্র চাষও হতো। গ্রামীণ জীবনে এই ধানটি ছিল এক প্রকার অপরিহার্য অংশ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই ধানের ¯’ান দখলে নিয়েছে উ”চ ফলনশীল জাতের ধানগুলো। এই সুগন্ধী চিকন চাল দিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানে তৈরি হতো পিঠা-পুলি, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, ক্ষির, পায়েস, ফিরনি ও জর্দাসহ আরো সুস্বাদু মুখরোচক নানা ধরনের খাবার। কিন্তু এ সবই এখন স্মৃতি হতে বসেছে। এই ধান কাটার সময়কে ঘিরে গ্রামবাংলায় মেতে উঠত নবান্নের উৎসব। সেসব এখন অনেকটা অতীত। বীজের অভাব, সার, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান কারণে হারিয়ে যা”েছ এ সুগন্ধী ধানের চাষাবাদ। ২৫-৩০ বছরের ব্যবধানে এ ধানের জায়গা দখল করে নিয়েছে উফশি ও উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান। উপজেলায় এক সময় দেশিয় জাতের সুগন্ধি কালোজিরা ধান চাষ হতো কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে। ক্রমবর্ধমান খাদ্যের চাহিদা মেটাতে দেশ থেকে হারিয়ে যা”েছ প্রকৃতিবান্ধব এমন হাজারও জাতের দেশি ধান। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত বাজারে আসায় দেশিয় ওই সব ধানের নাম ভুলতে বসেছে মানুষ। বীজের অভাব, সার, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানান কারণে হারিয়ে গেছে এসব সুগন্ধি ধানের চাষাবাদ। তবে সুখের কথা, বি”িছন্ন ভাবে কম পরিমাণে হলেও বিলুপ্ত প্রায় কালোজিরা ধান। কলাপাড়া কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এ উপজেলায় ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভায় ৩৫ হাজার ৫০০ কৃষক পরিবার রয়েছে। এ বছর ৩০ হাজার ৭শত হেক্টর জমিতে আমন আবাদ করেছেন কৃষকরা। এর মধ্যে কালোজিরা ধান চাষ হয়েছে ৫০ হেক্টর জমিতে। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, এ জাতের ধান আগে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে চাষ করা হতো। কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ায় কৃষকরা বীজ আমদানির ওপর নিভর্রশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে হারিয়ে যা”েছ এক সময়ের জনপ্রিয় কালোজিরা দেশি ধান। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যা”েছ গ্রামীণ ঐতিহ্যের সুগন্ধি ‘কালিজিরা’ ধান। বেশি খরচ, কম লাভের কারণে এই ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন উপজেলার কৃষকরা। খোঁজ জানা গেছে, উপজেলার ধুলাসার, নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, নীলগঞ্জসহ ইউনিয়নের কৃষি জমি গুলোতে দেখা যায়, এসব অঞ্চলের খুব কম জমিতে কালিজিরা ধান চাষ হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন গ্রামে বিভিন্ন জাতের ধান আবাদকারী কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই জাতের ধানের ফলন হয় কম। বিঘা প্রতি অন্য জাতের ধান যেখানে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ২০ মণ উৎপন্ন হয় সেখানে এই জাতের ফলন হয় সর্বোচ্চ ৮ মণ পর্যন্ত। তবে বাজারে দাম দ্বিগুণ পাওয়া যায়। সার, সেচ, পরিচর্যাও লাগে কম। সে হিসেবে আবাদে লোকসান হয় না বললেও চলে। এখনো গ্রামের গ্রহস্থ পরিবারের কাছে এই ধানের কদর যথেষ্ট। এখনো প্রতি কেজি এই জাতের ধানের চাল বিক্রি হয় ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তবে এই চাল সচরাচর সব খানে পাওয়া যায় না। উপজেলায় কালিজিরা জাতের ধানের চাষে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ লক্ষ করা গেলেও বীজের অভাবে অনেকের পক্ষে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। ধানক্ষেত দূর থেকে দেখলে মনে হবে, এ যেন কোনো চিত্রশিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা ছবি। এই জাতের ধান সাধারণত কালো বর্ণের হয়। অন্য ধানের চেয়ে এর আকারও ছোট। গ্রামীণ জীবনে এই ধানটি ছিল অপরিহার্য। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এই ধানের জায়গা দখল করে নিয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের ধান। প্রতিটি বাড়িতে সংরক্ষণ করা হতো কালিজিরা ধান। এই জাতের সুগন্ধি চালের নাম শুনলে কার মুখে রসনায় পানি না আসে। এই সুগন্ধি চিকন চাল দিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানে তৈরি হয় পিঠা-পুলি, পোলাও, বিরিয়ানি, খিচুড়ি, ক্ষির, পায়েস, ফিরনি ও জর্দাসহ আরো সুস্বাদু মুখরোচক নানা ধরনের খাবার। এ ছাড়া সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন পূজা-পার্বণের ভোগ, মিষ্টান্ন রান্নার কাজে কালিজিরা চাল ব্যবহার করে। ফলে ধানটি সবার কাছেই বিশেষ প্রয়োজনীয়। কিন্তু এসবই এখন কালের স্মৃতি। উপজেলার ১৫টি ছোট বড় হাটবাজারে এখন আর এই চাল পাওয়া যায় না। বিলুপ্তির পথে এই উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এ সুগন্ধি ধান। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য অনুযায়ী বাড়িতে জামাই এলে শ্বশুরবাড়িতে চিকন চালের ভাত দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। নি¤œ, মধ্য, গরিব হলেও দিনে একবেলা অবশ্যই একবার এই চালের ভাত রান্না হতো। এ ধান কাটার সময়কে ঘিরে গ্রাম বাংলা মেতে উঠত নবান্নের উৎসবে। সেসব এখন অতীত দিনের স্মৃতি। বীজের অভাব, সার, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ নানান কারণে হারিয়ে যা”েছ এ সুগন্ধি ধানের চাষাবাদ। ‘গুয়া ধানের (কালিজিরা ধান) চালের ভাত রান্না করলে মৌ মৌ গন্ধে চতুর্দিক ভইরা যাইত। এই ভাত এমনি এমনিই খাওয়া যাইত। গুয়া ধানের চাউলের ভাতের স্বাদের কথা জীবনেও ভুলতে পারবো না’Ñ এভাবেই গুয়া ধান (কালিজিরা ধান) নামক ধানের চালের স্বাদ ও সুগন্ধের কথা বলছিলেন কলাপাড়া বৌলতলী গ্রামের কৃষক বজলু মিয়া। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কালোজিরা ধানের ফলন হয় কম। বিঘা প্রতি অন্য জাতের ধান যেখানে ১৫ থেকে সর্বো”চ ২০ মণ উৎপন্ন হয় সেখানে এ জাতের ফলন হয় সর্বো”চ আট মণ পর্যন্ত। তবে বাজারে দাম দ্বিগুণ পাওয়া যায়। সার, সেচ ও পরিচর্যাও লাগে কম। সে হিসেবে আবাদে তেমন লোকসান হয় না। এখনও গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের কাছে এ ধানের কদর রয়েছে। স্থানীয় কৃষক হোসন জানান, ১৫ বছর আগে আমন চাষের পাশাপাশি গুরা ধানের (কালোজিরা) চাষও করতাম।
কিš‘ খরচ বেশি ও লাভ কম হওয়ায় এই চাষ এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছি। বর্তমানে মাত্র ৪ শতক জমিতে এই ধানের চাষ করেছি। কৃষক কামাল বলেন, একসময় প্রত্যেক কৃষক আমনের পাশাপাশি কম-বেশি কালোজিরা চাষ করতো। এখন হাতেগোনা কিছু কৃষক কালোজিরা ধান চাষ করেন। এই ধানের ফলন অন্য ধানের চেয়ে অনেক কম। যে জমিতে আমন চাষ করে ৫ মণ ধান পাওয়া যায় সে পরিমাণ জমিতে কালোজিরা ৩ মণও পাওয়া যায় না। ধুলাসার ইউনিয়নের তারিকাটা গ্রামের কৃষক মহিউদ্দিন খাঁ জানান, এক সময় প্রত্যেক চাষিই কম বেশি এই ধান চাষ করত। তিনি বলেন, আজ থেকে ২০ বছর আগে ও অনেক কৃষক পরিবার কালোজিরা ধান চাষ করত। এখন হাতে গোনা কিছু কৃষক পরিবার নিজেদের খাবার জন্য কিছু জমিতে কালোজিরা ধান চাষ করেন। আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এই ধানের ফলন অন্য ধানের চেয়ে অনেক কম। যে জমিতে আমন চাষ করে ৫ টন ধান পাওয়া যায় সে পরিমাণ জমিতে কালোজিরা ৩ টন ও পাওয়া যায় না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ বলেন, কালোজিরা ধান তুলনামূলক ফলন কম হওয়া কৃষকরা এই ধান আবাদে দিনে দিনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। শুধু মাত্র কৃষকের প্রয়োজনে যত টাকু লাগে এখন ততো টুকু চাষবাদ করে। বান্যিজিক ভাবে কোন কৃষক চাষাবাধ করেন না। খরচ বেশি ও লাভ কম হওয়ায় কৃষকরা এই ধান চাষে আগ্রহ হারিয়েছেন।