শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৯ অপরাহ্ন

আওয়ামী লীগ-স্বতন্ত্র: হুমকি-সংঘর্ষে বেসামাল নেতাকর্মীরা

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

ঘটনা ১: মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের সমর্থক হেবা মোল্লা ও মহিউদ্দিন মোল্লার বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। ভুক্তভোগী মহিউদ্দিন মোল্লা অভিযোগ করেন, তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থন করায় নৌকার প্রার্থী অ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাসের সমর্থক সওকত দেওয়ান ও বাবুল কাজী লোকজন নিয়ে তাদের বাড়িতে কয়েক দফা হামলা করেন।
ঘটনা ২: ঢাকা-৫ আসনে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কামরুল হাসানের সমর্থক মো. সুজনকে ঈগলের পক্ষে কাজ করলে হুমকি দিয়েছেন ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালাউদ্দিন আহম্মেদ। স্থানীয় লোকজন বলছেন, কাউন্সিলর সালাউদ্দিন মূলত দিনে নৌকার প্রার্থী হারুনুর রশিদ মুন্নার সঙ্গে আছে দেখালেও রাতে কাজ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সজল মোল্লার প্রার্থী। এলাকায় তার কথার বাইরে গেলেই তাকে হুমকি-ধমকি দেন তিনি।
ঘটনা ৩: নোয়াখালী-৪ আসনের ‘ট্রাক’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহিনের নির্বাচনি সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিবের বাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ হয়েছে। ভুক্তভোগী অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান নাছের সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে বিভিন্ন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ এবং হুমকি-ধমকির ঘটনা ঘটছে। গত ৫ দিনে ৩৬টির বেশি স্থানে হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় হামলা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মীদের ওপর।
আওয়ামী লীগের যেসব প্রার্থীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ বা চিঠি দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ৫২ জন বর্তমান সংসদ সদস্য। এছাড়া ২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির ৯ প্রার্থীকেও শোকজ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে নির্বাচন উন্মুক্ত করছেন তারা। এজন্যই এবার দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের হতে বাধা দেওয়া হয়নি। কিন্তু গত পাঁচ দিনে যেভাবে নেতাকর্মীদের মধ্যে যুদ্ধে নেমেছে তা নিয়ে বিরক্ত কেন্দ্র। এ নিয়ে রোববার (২৪ ডিসেম্বর) বৈঠকে বসবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। দু-একদিনের মধ্যে কঠোর নির্দেশনা যেতে পারে তৃণমূলে। এরই মধ্যে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা স্পষ্টত বার্তা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘সংঘাত মারামারি কোনো কিছু আমি দেখতে চাই না। আমার দলের যদি কেউ করে তার কিন্তু রেহাই নেই। সাথে সাথে ব্যবস্থা নেবো। আমরা চাই, জনগণ তার ভোটধিকার নির্বিঘেœ প্রয়োগ করবে। যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে, সে জয়ী হয়ে আসবে। প্রার্থীরা স্বাধীনভাবে প্রচারণা চালাবে। জনগণকে সুযোগ দিতে হবে। তারা পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিবে। তাতেই আমাদের গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হবে।’
দলীয় প্রধানের এই কড়া বার্তার পরও গত দু’দিনে হামলা, হুমকি-ধমকির রেশ টানতে পারেনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্র। শনিবার ঢাকা-৫ আসনের ৬৯ নং ওয়ার্ড এর কাউন্সিলর সালাউদ্দিন আহমেদ ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কামরুল হাসানের সমর্থক মো. সুজনকে তার গরুর খামারে ডেকে নিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। এ নিয়ে পুরো এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের তৈরি হয়। বিষয়টির দ্রুত সুরাহা না হলে নেতাকর্মীদের মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
হুমকি পাওয়া সুজন জানান, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সুজনকে ফোন করে ডেমরা থানাধীন রাজাখালী মসজিদ সংলগ্ন তার গরুর খামারে যেতে বলেন কাউন্সিলর সালাউদ্দিন। এ সময় আমাকে ঈগল প্রতীকের সাথে কাজ না করে তার সঙ্গে কাজ করার কথা বলেন।
পটুয়াখালী-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমানের ঈগল প্রতীকের সমর্থনে অনুষ্ঠিত পথসভায় নৌকার কর্মী-সমর্থকদের ‘হাত কেটে দেবো’ হুমকি প্রদানের বক্তব্য সংবলিত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক মা-বোনদের বুঝাবেন এবার আওয়ামী লীগের মার্কা ঈগল, আর পাগলের মার্কা হচ্ছে নৌকা।’ এসময় নৌকার সমর্থকদের হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘হাত কেটে দেবো, হাত কেটে দেবো।’ এদিকে চেয়ারম্যান হয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদধারী একজন নেতা নৌকা প্রতীককে ব্যঙ্গ করে এমন কথা বলায় ক্ষোভে ফুঁসছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
নির্বাচনী প্রচারণার প্রথম পাঁচ দিনে চট্টগ্রামের বিভিন্ন আসনে সহিংসতা হয়েছে। এতে নির্বাচনী প্রচারণার আমেজ নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ ভোটারদের। তারা জানান, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় সব প্রার্থীই শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। এখন প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন এলাকায় তাদের কর্মীরা পরস্পরকে আক্রমণ ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন।
ভোটাররা জানান, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যেই অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ শুক্রবার বিকেলে মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নে প্রচারণা চালাতে গেলে চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের এক কর্মী প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন।
গত ১৫ বছর ধরে যারা সরকারের বিভিন্ন ভাতা ভোগ করে আসছেন, নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে গেলে নির্বাচনের পর তাদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন জামালপুর সদর উপজেলার এক আওয়ামী লীগ নেতা। জামালপুর-৫ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদের পক্ষে ভোট চান উপজেলার লক্ষীরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হাতেম আলী।
শুক্রবার ফরিদপুর-৩ (সদর) আসনের ‘ঈগল’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল কাদের আজাদের (একে আজাদ) সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকের সমর্থকরা। হামলায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে গুরুতর ৫ জনকে ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
যশোর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম লিটনের ওপর হামলা চালিয়েছে নৌকার প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দীনের সমর্থকরা। গাজীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী আলিম উদ্দিনের অস্থায়ী কার্যালয় ভাঙচুর ও মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে নৌকার প্রার্থী জাহিদ আহসান রাসেলের বিরুদ্ধে। জামালপুর-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী মাহবুবুর রহমান হেলালের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রশিদের সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় চারজন আহত হয়েছেন।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ড. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন রাইজিংবিডিকে বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে রোববার বৈঠকে বসবেন দলের দায়িত্বশীল নেতারা। এখান থেকে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং অংশগ্রহণমূলক করার নির্দেশনা কঠোরভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হবে।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম রাইজিংবিডিকে বলেন, দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের, বিশেষ করে যারা নির্বাচন করছেন তাদের নির্বাচনি আচরণবিধি মেনে চলা উচিত। এ নিয়ে দলের নির্দেশনা আগে থেকেই আছে। আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনে আমাদের যে প্রত্যয় সেটি বারবার জানানো হচ্ছে।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য এখন মাঠে আছেন প্রায় ৮০০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এছাড়া ‘ভোটপূর্ব অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত’ করার জন্য জুডিশিয়াল (বিচারিক) ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে প্রতিটি আসনে একটি করে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি রয়েছে। তারাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে। তবে তারা নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিটিগুলো ইসিকে সুপারিশ করতে পারে।- রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com