ঢাকার কুড়িল এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন সুরাইয়া বেগম। পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। নিজে চাকরি করেন। তাই সময় মেপে রান্নার কাজটা করতে হয়। প্রায় মাসখানেক ধরে গ্যাসের চাপ এত কম যে চুলাই জ্বলে না সারাদিন। প্রথম দিকে ভোরে গ্যাস মিললেও এখন রাত ১০টার পর গ্যাস আসে। ভোর না হতেই চলে যায়। চাকরি, সংসার, রান্না-খাওয়া ম্যানেজ করা রীতিমতো দুষ্কর হয়ে উঠেছে সুরাইয়ার জন্য। ধানমন্ডি, মহাখালী, নদ্দা, বসুন্ধরা, কুড়িল, ভাটারা, বাড্ডা, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। অধিকাংশ বাড়িতেই একই অবস্থা। কেউ কেউ মধ্যরাতে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ কোনো কোনো বাসায় গ্যাস আসছে রাত দেড়টার পর। বাধ্য হয়ে অনেকে ইলেক্ট্রিক চুলার দিকে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ আবার সিলিন্ডার গ্যাস কিনে নিয়েছেন। এতে তাকে মাসিক গ্যাস বিলের পাশাপাশি বাড়তি গুনতে হচ্ছে সিলিন্ডারের দেড় হাজার টাকা। যারা ইলেক্ট্রিক চুলা ব্যবহার করছেন তাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি বিল। রায়েরবাজার এলাকার বাসিন্দা আয়েশা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এদিকের বাসায় মোটেই গ্যাস থাকে না। কখন গ্যাস আসে কখন যায় বুঝতেই পারি না। রান্না করতে অনেক সমস্যা হয়। উপায় না পেয়ে এখন ইলেক্ট্রিক চুলায় রান্না করি। গ্যাসের আশায় বসে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।’
ধানমন্ডির জিগাতলা এলাকায়ও গ্যাস সংকটে ভুগছে বাসিন্দারা। এই এলাকার রায়হান হোসেন বলেন, ‘আগে ঠিকঠাক গ্যাস থাকতো। শুধু দুপুরে দুই ঘণ্টা থাকতো না। বাকি সময় গ্যাস কম থাকলেও রান্নার কাজটা কোনো রকমে চলতো। এখন সকাল থেকেই গ্যাস থাকে না। রান্নায় অনেক সমস্যা হয়। মহাখালী ওয়্যারলেস এলাকায় গত এক সপ্তাহ ধরে গ্যাসের চাপ কম। আজিমপুর এলাকায় গ্যাসের সংকট আরও তীব্র। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বাসায় গ্যাস থাকে না। এ এলাকার বাসিন্দা মনিরা বলেন, ‘সকাল থেকেই বাসায় গ্যাস থাকে না। নিজেরা না খেলাম, বাচ্চার খাবার তো রান্না করতে হয়। সিলিন্ডার কিনলে খরচ বেশি হবে। ডাবল খরচ করার টাকাও নেই।’ গ্যাসের সাপ্লাই কম এজন্য এ সমস্যাটা হচ্ছে। একটা এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ আছে। ওটা চালু হলে ইমপ্রুভ হবে। শুনছি আরেকটা এলএনজি আসবে। এগুলো মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।– তিতাসের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া নদ্দার চাকরিজীবী নারী শিউলি বলেন, ‘আমার বাসায় গ্যাস আসে রাত দেড়টার পর। ভোরে আবার চলে যায়। সকালে অফিস থাকে। তাই রাত জেগে রান্না করাও সম্ভব না। বাধ্য হয়ে ইনডাকশন কিনেছি। গত এক মাস বিদ্যুৎ ব্যবহার করে রান্না করছি। গরমে যদি এসমস্যা ঠিক না হয় আরও সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ তখন লোডশেডিংও হবে।’
কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা মাইমুনা বলেন, ‘সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গ্যাসের সমস্যা। ঠিকভাবে রান্না করা যায় না। বিকেলে কিছুটা গ্যাস পাওয়া যায়। আবার সন্ধ্যা সাতটা বা সাড়ে সাতটার মধ্যে গ্যাস চলে যায়। খুবই সমস্যায় আছি গ্যাস নিয়ে।’ একই চিত্র রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, বকশিবাজার, মিরপুরের কিছু এলাকা, ডেমরা, শ্যামলী, বনশ্রী, ভাসানটেক, পল্লবীসহ আরও অনেক এলাকায়।
নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ না থাকায় শ্যামলী এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আরাফাত রহমানের সংসার খরচ বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘গ্যাস না থাকার কারণে বাসায় ঠিকমতো রান্না হয় না। বাইরের হোটেল থেকে প্রায়ই খাবার কিনতে হয়। এতে বাসায় বাজার খরচের পাশাপাশি হোটেলের খাবার খরচ গুনতে হচ্ছে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের যে অবস্থা তাতে এভাবে খরচ মিটিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’ পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, সারাদেশে প্রতি মাসে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে প্রায় তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। চলতি মাসে এই চাহিদার বিপরীতে সারাদেশে গড়ে দুই হাজার ৫শ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে, যা ২০২০ সালের এপ্রিলের পর সর্বনি¤œ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলএনজি আমদানি করে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে তা আবার গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে একটি টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ আছে। দুটি টার্মিনাল মিলে যেখানে গ্যাস সরবরাহ করতো ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। একটি বন্ধের কারণে সেটি বর্তমানে ৫শ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্যাসের সাপ্লাই কম এজন্য এ সমস্যাটা হচ্ছে। একটা এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ আছে। ওটা চালু হলে ইমপ্রুভ হবে। শুনছি আরেকটা এলএনজি আসবে। এগুলো মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন ও বিপণন) মেহেরুল হাসান কথা বলতে রাজি হননি। আর সংস্থাটির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌ. মো. কামরুজ্জামানকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। গতকাল মঙ্গলবার (১৬ জানুয়ারি) সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা দেখছি কিছুদিন গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। শীতকালে গ্যাসের চাপ কম থাকায় এমনটা হচ্ছে। আশা করছি দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হবে।