রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ১২:১৯ পূর্বাহ্ন

ঝুলে আছে প্রবিধানমালা: নিশ্চিত হয়নি হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ‘ট্রান্সফ্যাটমুক্ত’ খাদ্য

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

আমাদের রক্তে দুই ধরনের কোলেস্টেরল থাকে। মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটযুক্ত (ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড) খাবার রক্তের ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে ‘ভালো’ কোলেস্টেরল কমিয়ে দেয়। দীর্ঘ মেয়াদে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি দেশের তালিকায় ভারত, পাকিস্তানের পাশাপাশি রয়েছে বাংলাদেশ।
মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে সরকার একটি প্রবিধানমালা তৈরি করে ২০২১ সালে। ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা’ নামে ওই প্রবিধানমালা দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনাও হয়। তবে তিন বছরেও তা বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।
ট্রান্সফ্যাটের উৎস: বাজারে বিক্রিত ভোজ্যতেল, সেই তেলে বানানো পেস্ট্রি, কেকসহ ডুবোতেলে মচমচে করে ভাজা সব খাবারই ট্রান্সফ্যাটে ভরা। এসব সাধারণত হাইড্রোজেনেটেড তেলেই ভাজা হয়, একবার ব্যবহারের পর যে বাড়তি তেল থাকে সেটা ব্যবহার করা হয় ক্রমাগত। পুরোনো তেল ফেলে দেওয়া হয় না। আলুর চিপস, শিঙাড়া, জিলাপি, কচুরি, পাকোড়া, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার প্রভৃতি খাবারে ট্রান্সফ্যাট বেশি ব্যবহৃত হয়।
জানা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মন্দার বাজারে সস্তায় ভোজ্য স্নেহপদার্থের জোগান দেওয়ার জন্য হাইড্রোজেনেটেড তেল তৈরি হয়েছিল। তারপর ক্রমশ এর ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। ১৯৮০ সালের পর ক্ষতিকারক দিকগুলো সামনে আসে। এরপর থেকেই উন্নত দেশগুলোতে মার্জারিন, বনস্পতির মতো হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট (চর্বি) ব্যবহারে রাশ টানার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বাংলাদেশের খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কিছু সময় পরে হলেও তিন বছর আগে সরকার এ ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারে প্রবিধিমালা করেছে। তবে এখনো তা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন শুরু করতে পারেনি। প্রবিধানমালাটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি।
সম্প্রতি দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া বোতলজাত সয়াবিন তেলে সহনীয় মাত্রার বেশি ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া গেছে। ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিডের এ উপস্থিতি উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট পাবলিক হেলথ স্কুলের ১৩ জন গবেষকের দুই বছর মেয়াদি এক গবেষণায়। এতে বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন তেলের প্রায় ৬৭ শতাংশ নমুনায় সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। খোলা সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে হারটি প্রায় ২৫ শতাংশ।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা বলেন, ‘আমাদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বাজারে প্রাপ্ত ভোজ্যতেলের যে অবস্থা দেখতে পেয়েছি, তা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির বার্তা দিচ্ছে। খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ও বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমরা এরই মধ্যে গবেষণার মাধ্যমে এই মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায় চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছি।’ এদিকে কয়েক বছর আগে আরেক গবেষণায় ডালডায় ট্রান্সফ্যাটের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় ২ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট থাকার কথা থাকলেও সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট মিলেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের ব্যবহার রোধের লক্ষ্য নির্ধারণ করে। এই লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব তেল, ফ্যাট ও খাদ্যপণ্যে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা মোট ফ্যাটের ২ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা চূড়ান্ত করে। কথা ছিল এ সময়ের পরে মাত্রাতিরিক্ত সব পণ্য বিপণন বন্ধ হবে। তবে কয়েক দফা এ সময় বাড়ানো হয়েছে, যা এখনো কার্যকর হয়নি।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাটের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাবারে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট ব্যবহারের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ১৫টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ প্রবিধিমালা কবে কার্যকর হবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) ড. মোহাম্মদ মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোজ্যতেলে ট্রান্সফ্যাট কমিয়ে আনার ওপর আমরা বিশেষভাবে জোর দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই আমরা সমাধানে পৌঁছাবো।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাবারের ট্রান্সফ্যাট হলো ক্ষতিকর চর্বির একটি রূপ। এটি রক্তের ‘ভালো’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং ‘খারাপ’ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। রক্তে অতিরিক্ত মাত্রার খারাপ কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই ট্রান্সফ্যাট বেশি গ্রহণ করা হলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শুধু কারখানায় পরিশোধের গলদ নয়, খাবার ভাজার জন্য বারবার একই তেল (পোড়া তেল) ব্যবহার করলে ট্রান্সফ্যাট ঝুঁকি সবচেয়ে বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ফুড সেফটি ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার বলেন, ‘প্রবিধানমালা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।’
এদিকে এ পরিস্থিতিতে দেশে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস পালন হচ্ছে শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি)। প্রতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) এ দিবসটি পালন করে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সমৃদ্ধি চাই, নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নাই’।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রান্সফ্যাটঘটিত হৃদরোগে অকাল মৃত্যুর মতো ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড অন্য যে কোনো খাদ্যের তুলনায় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি রক্তে ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেয় এবং ‘ভালো’ কোলেস্টেরল কমায়। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়ে। ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে উচ্চহারে হৃদরোগের পাশাপাশি স্মৃতিভ্রংশ এবং স্বল্প স্মৃতিহানির মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে।’
দেশে ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো পালিত হয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। ওই বছর সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতন করে তোলার অংশ হিসেবে ২ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ( প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন নাজমুল হুসাইন জাগোনিউজ২৪.কম এর নিজস্ব প্রতিবেদক। প্রতিবেদনটি জাগোনিউজ২৪,কমের সৌজন্যে পত্রস্থ করা হলো)




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com