দেশের প্রতিটি কারাগারে কারাবিধির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে বন্দী নেতাকর্মীদের ওপর বিভৎস নিপীড়ন চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, গত তিন মাসে কারানির্যাতনে বিএনপির ১৩ জন নেতার মৃত্যু হয়েছে।
প্রত্যেকটি মৃত্যু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে কারা হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানান তিনি।
গতকাল শুক্রবার সকালে নয়া পল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব অভিযোগ করেন।
রিজভী বলেন, অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার উদগ্র বাসনা চরিতার্থ করতে গত ৭ জানুয়ারি বিরোধী দলহীন উদ্ভট ডামি নির্বাচন নির্বিঘœ ও কন্টকমুক্ত করার জন্য গুম-খুন-গায়েবি মামলা, হুলিয়া, গ্রেফতার-হয়রানি, নিপীড়ন, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘর ভাঙচুরের যে ভয়াবহতা চলছিল, তা এখনো অব্যাহত রেখেছে একনায়ক ডামি সরকার। অরাজকতা, নৈরাজ্য আর বিশৃঙ্খলার বৃত্তে জনমানুষকে বন্দী করা হয়েছে।
গত ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে বাধা বিঘœতা দূর করতে বিএনপির ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। আমরা চিন্তা ভাবনা করেই এই কাজ করেছি। তাদেরকে জেলে না ভরলে দেশ অচল হয়ে যেতো।’
তিনি বলেন, জনগণকে প্রতারিত করে, রাষ্ট্রীয় পেশীশক্তির জোরে ৭ জানুয়ারি ভোটারহীন পাতানো ভুয়া নির্বাচনে ষোলকলা পূর্ণ করলেও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থেমে নেই বিরোধী দল-মতের ওপর বহুমাত্রিক জুলুম, উৎপীড়নের অমানবিক নিষ্ঠুরতা। দেশজুড়ে বেপরোয়া গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে।
বিএনপির এই মুখপাত্র অভিযোগ করে বলেন, দেশের কারাগারগুলো ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বিএনপি নেতাকর্মীতে ঠাসা।
কারা সেলগুলো একেকটি শ্বাসরুদ্ধকর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছে। অতিমাত্রায় উৎসাহী কর্মকর্তারা গেষ্টাপোদের ন্যায় মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি কারাগারের ভেতরে কারাবিধির সমস্ত সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে বন্দী নেতা-কর্মীদের ওপর চালাচ্ছে বিভৎস নিপীড়ন। খাওয়ার কষ্ট দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। ছাত্রলীগের সাবেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী ক্যাডারদের কারা কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দিয়ে শেখ হাসিনা কারাগারেও বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর নিপীড়ন চালাতে লেলিয়ে দিয়েছে। তারা প্রতি মুহূর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। কারা হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের শিকার বিএনপির নেতা-কর্মীদের কারো না কারো মৃত্যুর সংবাদ আসছে প্রায়ই। গত তিন মাসে কারাগারে নির্যাতন করে বিএনপির ১৩ জন নেতার মৃত্যু হয়েছে কারা হেফাজতে। প্রত্যেকটি মৃত্যু পরিকল্পিত হত্যাকা-।
গত বৃহস্পতিবার বিনা অপরাধে রংপুর কারাগারে বন্দী রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি মহিপুর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলামকে নির্যাতন করে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, মনোয়ারুলের বাবা ফজলে রহমান, ছোট ভাই হারুনসহ স্বজনরা বলেছেন, ১৩ জানুয়ারি সুস্থ সবল মনোয়ারুলকে পুলিশ দিনের বেলায় বাসা থেকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ওই দিন আদালতে চালান না দিয়ে পরের দিন রাত পর্যন্ত থানায় আটকে রেখে বর্বরোচিত কায়দায় অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। তার পুরো শরীরে, পায়ে, পিঠে ও মাথায় আঘাতের গভীর চিহ্ন দেখা গেছে। পুলিশ নির্যাতন চালিয়ে মনোয়ারুলকে বিনা চিকিৎসায় হত্যা করেছে।
তিনি বলেন, সরকারের সাথে আঁতাত করায় একই মামলায় একই ধারায় জামিন মিলেছে শাহজাহান ওমরের। অথচ মহাসচিবসহ বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর জামিন মিলছে না। এটাতে প্রমাণিত হয় শেখ হাসিনার নির্দেশেই পুলিশ ও আদালত একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া এখনো বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় লাখো নেতাকর্মী মানবেতর অবস্থায় পলাতক জীবন যাপন করছেন। খেয়ে না খেয়ে আদালতের বারান্দায় ধর্না দিচ্ছেন। গণভবন-বঙ্গভবনে খোলা কমান্ড সেন্টারের নির্দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিএনপি চেয়ারপার্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আজো বন্দী করে রাখা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, আব্দুস সালাম পিন্টু, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, লায়ন আসলাম চৌধুরী, জহির উদ্দিন স্বপন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, আমিনুল হক, শরিফুল আলম, কাজী আবুল বাশার, রফিকুল আলম মজনু, সাইফুল আলম নীরব, আবু সাঈদ চাঁদ, শেখ রবিউল আলম রবি, সাইফুল ইসলাম পটু, ফজলুর রহমান খোকন, এস এম জাহাঙ্গীর, আমির এজাজ খান, অ্যাডভোকেট দুলাল হোসেন, শেখ ফরিদ উদ্দিন বাহার, মাহফুজন্নবী ডন, সিরাজুল আসলাম, হযরত আলী, আমজাদ হোসেন, মনিরুল ইসলাম, ইউসুফ বিন জলিল, আজিজুর রহমান মুসাব্বির, আমান উল্লাহ আমান (ছাত্রদল), খোরশেদ আলম সোহেল, পাভেল সিকদার, মেহেদী হাসান পলাশসহ হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে আমি অবিলম্বে তাদের নিঃশর্ত মুক্তির জোর আহ্বান জানাচ্ছি। তারা অসুস্থ হলেও উপযুক্ত চিকিৎসা না দিয়ে প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে।
তিনি আরো বলেন, কারাগারে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্দী নেতাদের পরিবারের সদস্যরা গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনযাপন করছে।