ইসলাম কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের ওপর দায়বদ্ধ হওয়া ফরজ করে দিয়েছে। তেমনি ইসলাম এটিও চায় যে, মুসলিম শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিকের শিল্প-সাহিত্যকর্মও দায়বদ্ধ শিল্প এবং দায়বদ্ধ সাহিত্যকর্ম হোক। কারণ একজন লেখক ও সাহিত্যিক তার স্রষ্টার কাছে দায়বদ্ধ। একজন মুসলিম লেখক তার প্রতিটি কর্ম ও কথার জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘সে যে কথাই উচ্চারণ করে তা গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সূরা কাফ-১৮)
তাই মানুষ এমন কোনো কথা বলতে ও লিখতে পারে না, যা মানুষের ক্ষতি করবে, অন্যকে আহত করবে, মানুষের মধ্যে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনার বিকাশ ঘটাবে। মানুষের চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটাবে। মানুষ এমন কিছু লিখতে পারে না, যা অন্য মানুষের আকিদা বিশ্বাস ও নৈতিকতা বিনষ্ট করবে; বরং তাকে লিখতে হবে এমন সব কথা, যা মানুষের কল্যাণ করবে; মানুষের মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন সাধন করবে। মানুষকে সত্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার প্রেরণা জোগাবে। মোটকথা, কথা বলা ও লেখার ক্ষেত্রে আমাদের সবসময় মধ্যপন্থা ও ইনসাফ অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যখন কথা বলবে তখন ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কথা বলবে।’ (সূরা আল আনআম-১৫২) অর্থাৎ ইনসাফ করে কথা বলো আর তাতে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো, কোনো রকমের বাড়াবাড়ি কিংবা কমতি করো না। কথাবার্তায় ন্যায়নিষ্ঠা অবলম্বনের মানে হলো খারাপ ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা।
অতএব ইসলামী দায়বদ্ধতা একটি মধ্যপন্থী দায়বদ্ধতা। ন্যায়সঙ্গত যুক্তিগ্রাহ্য ইনসাফপূর্ণ দায়বদ্ধতা। ইসলামের দায়বদ্ধতা সমাজতন্ত্রী কিংবা অস্তিত্ববাদী দায়বদ্ধতার মতো নয়।
সমাজতন্ত্রীদের মতে, সাহিত্যিকদের দায়বদ্ধ হতে হবে। এ দায়বদ্ধতা সমাজতান্ত্রিক মতবাদ প্রচারের দায়বদ্ধতা। তাকে তার সাহিত্যের মাধ্যমে জনগণকে শ্রেণিসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সঙ্ঘাত লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী লেখক ও শিল্পীকে অবশ্যই এ কাজে তার লেখনী ও শিল্পকে ব্যবহার করতে হবে। এ কাজ করতে সে তার মতাদর্শের কাছে দায়বদ্ধ। সন্দেহ নেই- এরূপ অবস্থায় সাহিত্য মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে পরিণত হয়। নাস্তিকতা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। শিল্প ও সাহিত্য তার আসল রূপ ও মূল্য হারিয়ে ফেলে। তা মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টি, তাদের সুকুমারবৃত্তির জাগরণ ও আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যম থাকে না। লেখকের মনের ভাব প্রকাশের উপায় হিসেবেও ব্যবহৃত হয় না। ফলে সাহিত্য তার মূল্য ও গুরুত্ব হারায়। এ ধরনের সাহিত্য মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ায় সত্য; তবে তা কখনো মানুষের মনের অভ্যন্তরে বিপ্লব সংঘটিত করতে পারে না। শ্রেণিবৈষম্যের অবসানও ঘটাতে পারে না।
অন্যদিকে অস্তিত্ববাদীদের মতে, লেখকের দায়বদ্ধতা হলো নিজের কাছে। তাদের মতে, লেখক নিজের কাছেই দায়বদ্ধ; তার স্্রষ্টা আল্লাহর কাছে নয়। কারণ অস্তিত্ববাদীরা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। তারা কোনো নৈতিক মূল্যবোধেও বিশ^াসী নয়। তাদের মতে, লেখককে পূর্ণ স্বাধীন হতে হবে। কোনো লেখক তার মনের অভ্যন্তরে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস রেখে পূর্ণ স্বাধীন হতে পারে না। কারণ তাদের মতে, এ বিশ্বাস তার অজান্তেই তাকে বন্দিত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, তার পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। সুতরাং তাদের মতে, মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য আবশ্যক হলো নাস্তিকতা তথা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করা। তাদের মতে, আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ^াস লেখকের পূর্ণ স্বাধীনতারও পরিপন্থী। তা মানুষকে তার প্রবৃত্তি ও ইচ্ছা পূরণে বাধা দেয়। মোদ্দাকথা, অস্তিত্ববাদীদের মতে, লেখক দায়বদ্ধ ও স্বাধীন। সে দায়বদ্ধ তার নিজের কাছে; আল্লাহর কাছে নয়। আর স্বাধীন এ কারণে যে, সে নিজে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস থেকেও মুক্ত। লেখকের এ দায়বদ্ধতা তার দৃষ্টিতে সমাজের প্রয়োজনে। তেমনিভাবে সে তার মতবাদ প্রকাশের জন্যও দায়বদ্ধ। তাকে তার শিল্প ও লেখনীর মাধ্যমে তার মতবাদ প্রচার করতে হবে। তার চিন্তাচেতনা গণমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তা হলেই অস্তিত্ববাদী লেখক তার দায়মুক্ত হতে পারবে।
সন্দেহ নেই যে, সাহিত্য এরূপ অবস্থায় মানুষকে ঈমান ও আকিদা থেকে মুক্ত করার হাতিয়ারে এবং নাস্তিকতা প্রচারের মাধ্যমে পরিণত হবে। আর সমাজে চিন্তা ও চরিত্রগত অবক্ষয় ঘটানোর উপায় এবং অশ্লীলতা এবং অন্যায় ও অসত্য প্রচারের মাধ্যমে পরিণত হবে এই সাহিত্য। কারণ নিজের কাছে দায়বদ্ধ সাহিত্যিক ইচ্ছামতো তার প্রবৃত্তি অনুযায়ী লিখবে। আর শিল্পী তার প্রবৃত্তির চাহিদামতো শিল্প সৃষ্টি করবে। সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। মানুষের মধ্যে সঙ্ঘাত-সংশয় বৃদ্ধি পাবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলাম শিল্পী ও সাহিত্যিককে ন্যায়পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়। কারণ ইসলাম এসেছে দুনিয়ার মানুষকে সব রকমের গোলামি ও বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য। আল্লাহর বন্দেগি ও দাসত্ব ছাড়া সব ধরনের শৃঙ্খল থেকে তাকে আজাদ করার জন্য।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘কোনো মানুষের পক্ষে এটি সঙ্গত নয় আল্লাহ তাকে শাসনক্ষমতা ও নবুওয়াত দান করবেন আর সে পরক্ষণেই মানুষকে বলবে- তোমরা আল্লাহর বান্দা না হয়ে আমার বান্দা হয়ে যাও; বরং সে বলবে- তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও। যেহেতু তোমরা কিতাব শিক্ষা দান করো এবং যেহেতু তোমরা অধ্যয়ন করো। তোমাদের এ আদেশও করে না যে, ফেরেশতা ও নবীদেরকে রব বানিয়ে নাও। তোমাদের কি কুফরির আদেশ করতে পারে মুসলমান হওয়ার পর।’ (সূরা আল ইমরান : ৭৯-৮০)
ইসলামের এ দায়বদ্ধতা লেখককে বিপদে ফেলে না। তাকে সঙ্কীর্ণতায়ও নিমজ্জিত করে না; বরং তাকে বেশি প্রশস্ত দিগন্তে ছেড়ে দেয়। তাকে দ্বীন ও দুনিয়ার জীবনে সব কিছু নিয়ে লেখার সুযোগ করে দেয়। কাজেই ইসলামী দায়বদ্ধতায় বিশ্বাসী লেখক সব বিষয়ে লিখতে পারে। তবে তা অবশ্যই ইসলামী মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সীমানার ভেতর থেকে। আমরা এর প্রমাণ পাই নবী সা:-এর কর্মকা-ে। তিনি কখনো তার সাহাবি কবিদের উদ্দেশে এমন উপদেশ দেননি যে, তাদের কবিতা কেবল ইসলামী বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এমনকি যখন কাফের ও মুসলমানদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছিল, কবিতার মাধ্যমে পরস্পরের নিন্দা ও কুৎসা রটানো হচ্ছিল তখনো নবী সা: মুুমিন কবিদের বলেননি যে, তাদের কবিতাকে কেবল এ কাজেই নিয়োজিত করতে হবে। অথচ তখন এ ধরনের কাজের প্রয়োজনও ছিল। এমতাবস্থায় এক দিন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও কাব বিন জোহাইর নবী সা:-এর কাছে এসে প্রার্থনা করেন যে, তাদেরকে যেন কাফেরদের মোকাবেলায় তাদের কবিতা নিয়োজিত করতে বাধ্য করা না হয়। তখন নবী সা: তাদের উভয়কে কাফেরদের লিখিত কবিতার জবাব দানের জন্য তাদের কাব্যপ্রতিভা নিয়োজিত করতে বাধ্য করেননি; বরং তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন। অবশেষে হাসসান রা: এগিয়ে এলেন এবং তিনি তার কবিতা দিয়ে কাফেরদের জবাব দিতে শুরু করলেন। তখন নবী সা: তার জন্য দোয়া করলেন। কিন্তু তাকে তার কাব্যপ্রতিভা এ কাজে নিয়োজিত করতে বাধ্য করেননি।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, নবী সা: কখনো কোনো কবিকে তার কাব্যপ্রতিভা কেবল ইসলামী বিষয়ে নিয়োজিত করতে বাধ্য করেনি। তা ছাড়া তিনি কারো কাছে কামনাও করেননি যে তার কবিতা কেবল ইসলামী বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখুক; বরং কবিরা যে গজল লিখেছেন তিনি তা তাদের মুখ থেকে শুনেছেন। তারা নিজেকে, নিজের পরিবার পরিজন এবং বংশ মর্যাদার অহঙ্কার করে কবিতা লিখেছেন, তাও শুনেছেন। এমনকি কখনো কখনো তাদের এ জাতীয় কবিতা শুনে হেসেছেনও বটে।
নবী সা:-এর এই অবস্থান ও দিকনির্দেশনা থেকে আমরা ইসলামী দায়বদ্ধতার প্রকৃতি বুঝতে পারি। আমরা আরো জানতে পারি ইসলামী সাহিত্যে যে দায়বদ্ধতার কথা বলা হয়েছে তার রূপরেখা।
মোট কথা- আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি, এই দায়বদ্ধতা মূলত তার বিশ্বাস, অনুভূতি ও আকিদার সাথে সম্পৃক্ত, সে যে আকিদা ও বিশ্বাস পোষণ করে তা থেকেই উৎসারিত। কাজেই সে যে চিন্তাই করুক না কেন, তা সবই তার বিশ্বাস ও আকিদার গ-িতেই হতে বাধ্য। তার এই দায়বদ্ধতা তার ওপর চাপিয়ে দেয়া নয়; বরং তার মনের ভেতর থেকে উৎসারিত বিষয়। আর এই দায়বদ্ধতা সে নিজের উপর আরোপ করে নিয়েছে তার ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাস দিয়ে। এই দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়ে সে যে সাহিত্য ও শিল্পকর্ম সৃষ্টি করবে তা সবই হবে ইসলামী সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। (ইসলামে শিল্পকলা ও সাহিত্য) লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।