চট্টগ্রামের প্রবীণ আলেম ও মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ মাওলানা কারি মুহাম্মাদ ইলয়াছ (রহ.) ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) ভোর ৪টা ১৫ মিনিটে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আজ আছর নামাজের পর হাটহাজারী মাদরাসায় তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। পারিবারিক জীবনে তিনি এক কন্যাসন্তান ও দুই নাতি রেখে যান।
কারি মুহাম্মাদ ইলয়াছ (রহ.) হাটহাজারী, অতঃপর পটিয়া ও সর্বশেষ দারুল মা‘আরিফ মাদরাসায় দীর্ঘকাল যাবত তাফসির ও ইসলামী দর্শনশাস্ত্র পড়িয়েছেন।
তিনি ১৯৩৮ সালে হাটহাজারী উপজেলার ফটিকা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তফা (রহ.) ও তাঁর মায়ের নাম কামেলা খাতুন। হাটহাজারী মাদরাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শাইখুল মাশায়েখ মাওলানা জমিরুদ্দিন আহমদ (রহ.) ছিলেন তাঁর দাদা। তাঁর আসল দাদাবাড়ি ছিল ফটিকছড়ি উপজেলার শোয়াবিলে।
তাঁর প্রপিতামহ নূরুদ্দীন (রহ.)-ও একজন খ্যাতিমান আল্লাহভীরু লোক ছিলেন। কথিত আছে, তাদের পূর্বপুরুষ ইরান থেকে দিল্লি হয়ে কলিকাতায় আসেন। অতঃপর সেখান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষ ওয়াজ মীর ফটিকছড়ির শোয়াবিলে এসে মীর বংশের গোড়াপত্তন করেন। কারি ইলয়াছ (রহ.)-এর নানা মাওলানা আবদুর রহমান (রহ.) ছিলেন ফটিকছড়ি কাজীর হাট মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা।
কারি মুহাম্মাদ ইলয়াছ (রহ.)-এর স্মৃতিশক্তি ছিল খুবই প্রখর। শৈশবে বাবা-মায়ের কাছেই তিনি অনেক দোয়া মুখস্ত করেন। মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কোরআন হিফজ করেন। এরপর দাদার কাছে হাটহাজারী মাদরাসায় সুনামের সঙ্গে পড়াশোনা করেন। তুখোড় মেধাবী হওয়ায় ক্লাসের প্রায় সব কিতাব তার মুখস্ত ছিল। সব ক্লাসেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতেন। দরসের পাশাপাশি তিনি শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল কাইয়ূম (রহ.), আল্লামা আবদুল আযীয (রহ.), মুফতী আহমদুল হক (রহ.) প্রমুখের কাছে ব্যক্তিগতভাবে পড়েন। আরবি ব্যাকরণ, মানতিক, ফিকাহ, তাফসিরসহ অনেক শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো তাঁর নখদর্পণে ছিল। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ফিকাহ্শাস্ত্র, উসুলে ফিকাহ, মানতিক, আকায়েদ, সাহিত্য, গণিতসহ নানা বিষয়ের পাঠ সম্পন্ন করেন। গণিতের অনেক জটিল সমস্যা ও ধাঁধা তিনি সহজেই সমাধান করতে পারতেন।
এরপর ১৯৬০ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কারি মুহাম্মাদ ইলয়াছ (রহ.) তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের জামিয়া আশরাফিয়া লাহোর মাদারাসায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি জগদ্বিখ্যাত ইসলামী প-িত আল্লামা রাসুল খান (রহ.) (মৃত্যু : ১৩৯১ হি.) ও বিশ্ববরেণ্য মুফাসসির আল্লামা মুহাম্মদ ইদরিস কান্দলভি (রহ.) (মৃত্যু : ১৩৯৪ হি.)-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে থেকে দীর্ঘ ছয় বছর শিক্ষা লাভ করেন। সেখানে পড়াশোনা শেষে আল্লামা রসুল খানের (রহ.)-এর কাছে বাইআত অতঃপর খিলাফত লাভ করেন এবং দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে কারি মুহাম্মাদ ইলয়াছ (রহ.) দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে তিনি উচ্চতর যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও তাফসির শাস্ত্রের গ্রন্থ পড়াতেন। এরপর ১৯৬৮ সালে তিনি খতিবে আজম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর অনুরোধে চট্টগ্রামের জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। সেখানে তিনি দীর্ঘ ১৯ বছর ইসলামী দর্শন ও তাফসির শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের পাঠদান করান। এ সময় তিনি তাফসির বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর চট্টগ্রাম শহরের জামেয়া দারুল মা‘আরিফ আল-ইসলামিয়ায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় শিক্ষকতা করেন। সেখানেও তিনি ইসলামী দর্শন ও তাফসির শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের পাঠদান করাতেন।