শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৮:০৮ অপরাহ্ন

আগুন দমনে কেমন চলছে সরকারি অভিযান

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০২৪

ঢাকার বেইলি রোডের একটি ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর হঠাৎ চর্তুমুখী অভিযানে নেমেছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রেস্তোরাঁ থেকে আগুনে এত হতাহতের কারণে পরদিন থেকে ঢাকার খাবারের দোকানগুলোতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। তিন দিনে এক হাজার এক শ’র বেশি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে নানা ত্রুটির কারণে বেশ কিছু সিলগালা ও বন্ধ করা হয়। আটকও করা হয়েছে ৮০০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাথে নিয়ে এসব অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আটটি সংস্থার ১১টি প্রত্যায়নপত্রের পর একটি রেস্টুরেন্টের অনুমোদন পাওয়ার কথা। কিন্তু বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কেউ দায় না নিয়ে একে অপরের ওপর দোষ চায়।
নগর পকিল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, এসব অভিযান পুরোপুরি লোক দেখানো। তিনি বলেন, ‘বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই দায় এড়াতে চমক দেখিয়ে অভিযান শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণেই বার বার ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে।’ তবে পুলিশ বলছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হওয়া রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন ভবনের সেফটি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে এই অভিযানে। সব প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় করে এই অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।’ যদিও আলাদা আলাদা সংস্থার কাছে দায়িত্ব থাকায় তদারকি সঠিকভাবে হচ্ছে না বলে মনে করে সিটি করপোরেশন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘এককভাবে কারো দায়িত্ব না বলেই কোনো না কোনো জায়গায় ত্রুটি থাকে। ফলে এই বিষয়গুলো নিয়ে এত কথা উঠছে।’ এই বিষয়টি নিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হলেও এ নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ঢাকার রেস্তোরাঁগুলো কতটা নিরাপদ? বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্লানার্স ও পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার তথ্য বলছে গত নয় বছরে বাংলাদেশে এক লাখ নব্বই হাজার ১৬৭টি অগ্নিকা- ঘটেছে। এতে এক হাজার ৫১ জনের মৃত্যু ও সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটিতে যে আগুন লাগে, সেখানেও প্রায় সবগুলো ফ্লোরেই ছিল রেস্তোরাঁ। এবং আগুনের সূত্রপাতও হয়েছে নিচতলার একটি রেস্তোরাঁ থেকে।
রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের পাশেই আরো বেশ কিছু ভবনে এমন অনেক রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। এগুলো মূলত বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন থাকলেও এতে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকান।

এছাড়া খিলগাঁও, ধানমন্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় এমন বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক ভবনেই গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ কিংবা খাবারের দোকান। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজধানী ঢাকার রেস্তোরাঁগুলো গড়ে উঠেছে অনেকটা নিয়মবহির্ভূতভাবে। অনেক রেস্তোরাঁই রয়েছে অনেকটা আগুনের ঝুঁকিতে। যে কারণে এসব ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে তাতে প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়ে। যেমনটা হয়েছে বেইলি রোডের ওই ভবনে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় প্রায় পাঁচ হাজার রেস্তোরাঁ কিংবা খাবারের দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ ভাগই অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে। এসব দোকানের অনেকেই সঠিকভাবে অনুমতি নিয়ে এসব রেস্তোরাঁ পরিচালনা করছে না বলেও জানাচ্ছে অগ্নি নির্বাপক এই সংস্থাটি। ফায়ার সার্ভিস মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মো: শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আমরা চিঠি দেয়ার পরও অনেকেই রেসপন্স করতে চান না। অনেকেই এগুলোতে গুরুত্ব দেন না। তখন আমাদের পরিদর্শক দল তাদেরকে নোটিশ করেন। সতর্কবার্তা পাঠান।’
প্রাণহানি বেশি হলেই শুরু হয় অভিযান
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে অগ্নি দুর্ঘটনায় এত প্রাণহানির পর থেকেই রাজধানী ঢাকা শহরে লাগাতার সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। এসব অভিযানে অগ্নি নিরাপত্তা সনদ নেই, সে রকম ভবন ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জেল জরিমানা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে ফায়ার সার্ভিস বলছে, শুধুমাত্র নোটিশ দিয়ে ভবন মালিকদের সতর্ক করার বিষয়গুলোই তাদের এখতিয়ারে রয়েছে। কিন্তু আইন মানতে বাধ্য করার এখতিয়ার তাদের নেই।
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘আমরা সারাবছরই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করি। তবে এখন আগুনের বিষয়টা বেশি ফোকাস হয়েছে বলেই এখন হয়তো মোবাইল কোর্টের কথা জানছে সবাই।’ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে গত কয়েক দিনের এ অভিযানের পর অনেক রেস্তোরাঁ বন্ধ দেখা যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এই অভিযানগুলো এক ধরনের ঘুস বাণিজ্যের বিস্তৃতির জন্য করা হয়। অনেক ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যক্তিগত অভিপ্রায় থেকে এ ধরনের অভিযানে নামে। এতে ফায়দা লোটা ছাড়া বাস্তবে তেমন কিছু হয় না।’
যদিও ঢাকা সিটি করপোরেশন বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমাদের এই অভিযান সারাবছর চলে। আমরা সব সময় সোচ্চার থাকি। বিশেষ করে যে সব ভবন ঝুঁকির মধ্যে আছে সেগুলো নিয়ে আমরা তৎপর থাকি। নগরবাসীকে নিরাপদ রাখতেই আমাদের এই অভিযান।’
বিপাকে রেস্তোরাঁ ও খাবারে দোকানগুলো: রাজধানী খাবার দোকানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নবাবী ভোজ রেস্তোরাঁ। শুধুমাত্র ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠানের চারটি দোকান রয়েছে। গত শনিবার থেকে শুরু হওয়া অভিযানে এখন পর্যন্ত এই নবাবী ভোজের দুটি দোকান বন্ধ করা হয়েছে। এই রেস্তোরাঁটির নির্বাহী পরিচালক বিপু চৌধুরী বলেন, ‘সব ধরনের ডকুমেন্টস আমার কাছে আছে। আমি সেগুলো তাদেরকে দেখিয়েছি। তারপরও কারণ ছাড়াই আমার দুটি খাবার দোকান বন্ধ করে দেয়। কর্মচারীরা গ্রেফতারের আতঙ্কে আছে।’ এসব অভিযানে খাবার দোকানগুলো বন্ধ ও কোথাও কোথাও সিলগালা করা হচ্ছে। রেস্তোরাঁ মালিকরা বলছেন, বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনার পর রেস্তোরাঁগুলোতে অনেক গ্রাহক কমেছে। অভিযানে বিপাকে পড়ার ভয়ে অনেক আবার দোকান খুলছেন না।
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ওসমান গনি বলেন, ‘যেখানে মাথা ব্যথা হয়েছে, সেখানে মাথা কেটে ফেলা হচ্ছে। অভিযানের সময় কোনো রেস্তোরাঁ ত্রুটিপূর্ণ দেখে সেটা বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু এখন অনেকটা পাইকারি হারে খাবারের দোকানগুলো বন্ধ করা হচ্ছে।’ যদিও সিটি করপোরেশন বলছে, এসব অভিযানে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। অভিযানে শুধুমাত্র ত্রুটিপূর্ণ দোকানগুলোকেই জরিমানা কিংবা বন্ধ করা হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘অভিযানে কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। সামনের দিনে একটি মৃত্যুও যাতে না ঘটে সেই চেষ্টা করছি আমরা।’
অগ্নি নিরাপত্তার দায় আসলে কার? স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদরা জানাচ্ছেন, রাজধানীতে কোনো রেস্তোরাঁ করতে হলে অন্তত ১০টি সংস্থার প্রত্যয়ন প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনাপত্তিপত্র, জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের নিবন্ধন, দোকান, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের লাইসেন্স, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স, সিটি করপোরেশনের ই-ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশগত ছাড়পত্র ও অবস্থান ছাড়পত্র প্রয়োজন হয় একটি রেস্তোরাঁ চালু করতে।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, এসব বিষয়গুলো তদারকির দায়িত্ব রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগসহ বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর। কিন্তু সারাবছর এগুলো তদারকি না করে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করেই তারা দায় এড়াতে চায়। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ভবনের অগ্নি নিরাপত্তার দায় কোনো একক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকে না। ফলে বিভিন্ন সময় এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কিন্তু ঘটনার পর কেউ এর দায় কেউ নিতে চায় না।’ নগর পরিকল্পনাবিদরা জানাচ্ছেন, ইচ্ছা করলেই বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার কোনো সুযোগ নেই। রেস্তোরাঁর জন্য যে ধরনের রান্নাঘর দরকার, তা সাধারণত বাণিজ্যিক ভবনে থাকে না। তারপরও কিভাবে এগুলো গড়ে উঠছে? এগুলো নিয়ে আসলে কি কোনো তদারকি হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে সিটি করপোরেশনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আলাদা। সবাই সবার দায়িত্ব পালন করে।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রত্যেক বিভাগের আলাদা আলাদা কাজ চিহ্নিত করা আছে। এককভাবে কারো দায়িত্ব নেই বলে, কোনো না কোনো জায়গায় ত্রুটি থাকে বলেই বিষয়গুলো হয়তো এমন হচ্ছে।’ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেমন দায়িত্বের বিষয়গুলো সামনে আসছে, তেমনি ভবন মালিক কিংবা রেস্তোরাঁ মালিকদেরও এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘কোনো ত্রুটি দেখলে ভবন কিংবা রেস্তোরাঁ মালিকদের বার বার চিঠি দেয়া হয়। অনেকে এগুলোতে গুরুত্ব দেন না। অনেক সময় বেশি ভায়োলেশন থাকলে আমরা মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করে থাকি। তবুও সব ক্ষেত্রে আইন মানানো সম্ভব হয় না।’ ফায়ার সার্ভিস বলছে, ছোটখাটো ভবনের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে মামলা করার সুযোগ আছে। কিন্তু বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে তাদের হাতে এমন সুযোগ নেই। ফলে অনেকে আইন না মেনেও পার পেয়ে যান।

এমন অবস্থায় দুর্ঘটনার অপেক্ষা না করে বছরের অন্য সময়েও বিষয়গুলো তদারকির পরামর্শ দিচ্ছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। সূত্র : বিবিসি




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com