প্রায় একই বয়সের কয়েকজন নারী। তাদের পোশাকও একই রকম। সঙ্গে আছে কয়েকজন পুরুষ। তারা সকলেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মহাযজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য। মন্দিরের ভিতরে চারেদিকে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরষসহ শত শত দর্শণার্থী। সেখানে পরিণত হয়েছিল এক অন্য রকম পরিবেশ। মনে হলো সেই রাজার আমলে রাজবাড়িটি দর্শণার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকার মতো অবস্থা। সনাতন বিদ্যাপীঠ বৈদিক গীতা শিক্ষা কেন্দ্র নওগাঁর আয়োজনে দুটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাশাপাশি করা হয়েছে নারীদের দিয়ে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান। নওগাঁর সদর উপজেলা বলিহার ইউনিয়নে অবস্থিত প্রাগৈতিহাসিক বলিহার রাজবাড়ি মন্দিরে শুক্রবার (৮মার্চ) বিকেল ৫থেকে রাত সাড়ে ৮ পর্যন্ত চলে এই অনুষ্ঠান। সনাতন বিদ্যাপীঠ বৈদিক গীতা শিক্ষা কেন্দ্রের নেতৃত্ব দেওয়া অমিত কুমার জয় জানালেন, ১৮২৩ সালে নির্মিত বলিহার রাজ রাজেশ^রী মন্দিরে দীর্ঘ ৪৮ বছর পর দুটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরপর সনাতন ধর্মের বেদ ও গীতার আলোকে নারীরা প্রথম মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। নারী শক্তির জাগরণে সনাতন ধর্মের রীতিনীতি ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য এই প্রথম সনাতনী নারীরা পুরো যজ্ঞানুষ্ঠানে পৌরহীতের কাজ করেছেন। তারা বেদমন্ত্র ও গীতার আলোকে পুরো যজ্ঞানুষ্ঠানটি মন্ত্রের মাধ্যমে শিবের সহ¯্র নামের মাধ্যমে সহ¯্র বেল পাতা দ্বারা আহোতী প্রদান করেছে। যা দেশে একটি বিরল ইতিহাস ও দৃষ্টান্তর হয়ে থাকবে। তিনি জানালে, সামাজিক প্রথা ভেঙে সনাতন প্রথায় এই প্রথম দেশের মাটিতে আমরা এমন অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করেছি। যে অনুষ্ঠান সনাতনী প্রথায় বেদের আলোকে নারীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সনাতনী সমাজকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে এই মহাযজ্ঞানুষ্ঠান বলে আমি বিশ^াস করি। পাশের গ্রাম থেকে ৬৬বছরের বলরাম সরকার এসেছেন অনুষ্ঠানটি দেখতে। নারীদের দিয়ে এরকম সুন্দর অনুষ্ঠান করা যায় জানিয়ে তিনি বলেন, তার জীবনে এমন অনুষ্ঠান দেখেননি। তাই তিনি বললেন, খুব ভালো উদ্যোগ এটি। তার মতো একই ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন উপেন মন্ডল। এছাড়া প্রায় ৬০ বছরের কমলাও জানালেই একই কথা। নারীদের দ্বারা এই অনুষ্ঠান করাতে তিনি খুব খুশি। এছাড়া যজ্ঞানুষ্ঠান করা নারীদের মায়েরা জানালেন, তাদের আমলে কখনো এমন হয়নি। তাদের মেয়েরা করছে, এতে তারা খুশি। বলিহার রাজবাড়ির রাজেশ^রী মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক খোকন চন্দ্র প্রামানিক বলেন, ১৮২৩ সালে এই রাজবাড়ি রাজা রাজেন্দ্র নাথ রায় বাহাদুরের নির্মিত রাজ রাজেশ^রী দূর্গা মন্দির হিসেবে পরিচিত। এর আগে এই মন্দিরে দীর্ঘ ৪৮ বছর তেমন করে পূজা পার্বন ছিলো না। পরবর্তীতে আমরা ২০০৭ সাল থেকে ছোট শিবলিঙ্গে পূজা করতাম। শুক্রবার দুটি বড় শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাশাপাশি নারীদের দিয়ে পুরো যজ্ঞানুষ্ঠান, এটি এক অন্য রকম আনন্দ বা দৃষ্টান্তর। যা আমার জীবনে কখনও এরকম অনুষ্ঠান দেখা হয়নি। সেটা এই মন্দিরে হলো। সত্যিই খুব ভালো লাগছে। যজ্ঞানুষ্ঠান করতে আসা বিনীতা রাণী বলেন, আজকে এখানে এক যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন হচ্ছে। এর আগে আমরা নারীরা কখনও এরকম অনুষ্ঠানে পৌরহীত করার সুযোগ পেতাম না। আজকে আমরা সরাসরি যজ্ঞানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছি। সেই জন্য ধন্যবাদ জানাই আমাদের সনাতন বিদ্যাপীঠকে। একইভাবে ঐষি মন্ডল জানালেন, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই নারী দিবসকে আরও স্বরণীয় করে রাখতে এখানে যজ্ঞানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর সেই পুরো যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা করবো আমরা নারীরা। যা বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে এক ইতিহাস হতে চলেছে। আর এই ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তাদের মতো আনন্দিত যজ্ঞানুষ্ঠান করতে আসা নারী রিমঝিম মন্ডল, রুপকথা মন্ডল, বৃষ্টি শীল ও চৈতি মন্ডল। পাশাপাশি তাদের মায়েরাও আনন্দিত। এদিকে নারীদের সাথে যজ্ঞানুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে আনন্দিত রাজীব মন্ডল, রুহিতেশ^র সরকার, পবিত্র বিশ^াস। উপস্থিত ছিলো শিবাশীষ সরকার পার্থসহ অনেকে। এছাড়া শত শত নারী-পুরুষ ও ছোট ছোট বাচ্চারাও এই মন্দিরে এসে নারীদের যজ্ঞানুষ্ঠান দেখতে পেরে খুশি ও আনন্দিত।