শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৪:৫৩ পূর্বাহ্ন

রায়গঞ্জে চার জয়িতার সাফল্য গাঁথা

গোলাম মোস্তফা বিশেষ প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ
  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে চারজন পিছিয়ে পড়া নারী জীবনে সংগ্রাম করে সব বাধা বিপত্তি কাটিয়ে সফল হয়েছেন। এ সফলতায় তারা ২০২৩ সালে জয়িতার সম্মাননা পেয়েছেন। যাদের জয়িতা হওয়ার পেছনে রয়েছে দুঃখ কষ্টের করুণ কাহিনি! চান্দাইকোনা ইউনিয়নের ফুলজোড় নদীপাড়ের একটি গ্রাম বেড়াবাজুয়া। এ গ্রামে জয়িতা মোছা. হাফিজা খাতুনের বাড়ি। তার স্বামীর নাম. মো. হায়দার আলী। তিনি একজন সফল জণণী। জয়িতা হাফিজা খাতুন বলেন, ১৯৮৬ ছিল তার বিয়ে হয় বেড়াবাজুয়া গ্রামের সরকার বাড়ির ছেলে ও সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী সরকারের সাথে। পরপর তিন মেয়ের জন্ম হয় তাদের সংসারে। সবকিছু ভালোই চলছিল। ২০১০ সালের ১৩ মে চারদিকে অন্ধকার করে দিয়ে স্বামী হায়দার আলী সরকার স্ট্রোক করে মারা যান। তারপর বহু কষ্টে বড় মেয়ে উম্মুল মাফরুহা সুমী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করছেন। মেঝো মেয়ে রওনক জাহান স্বর্ণা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারসী ভাষায় স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ করে বিদেশী একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মজীবন শুরু করেছেন। ছোট মেয়ে ইসমেত জাহান সিঁথি ঢাকায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিষয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সংগ্রামী ও সফল মা হিসাবে তিনি এখন সবার কাছে আদর্শ। জয়িতা মোছা. ময়না খাতুনের বাড়ি পূর্ব ফরিদপুর। তার স্বামী মো. আব্দুল মতিন শেখ। তিনি সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ময়না খাতুন বলেন, আমি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করি। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেয়। নতুন সংসারে আসার পর কিছু বুঝে উঠতে পারছিলামনা কী করব। এর মধ্যে কোলজুড়ে আসে দুটি সন্তান। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তখন হতে চিন্তা করতে থাকি আমার মত যেন আমার সন্তানদের এরকম হতে না হয়। তার জন্য আমাকে একটা করতে হবে। আমি এক দিন জানতে পারি গুডনেইবারস বাংলাদেশ নলকা সিডিপিতে কমিউনিটি হেল্থ ওয়ার্কার পদে কিছু সংখ্যক লোক নেওয়া হবে। আমি আবেদন করি ও এখানে কাজ করার সুযোগ পাই। এখান হতে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করা শুরু করি। আস্তে আস্তে আমার দক্ষতা ও পরিচিতি বাড়তে থাকে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে আমার চার পাশে যারা রয়েছেন তাদের বিভিন্ন পরামর্শ ও চিকিৎসা সেবা পরামর্শ দিয়ে আসছি। এতে করে এলাকার বাল্য বিবাহ, শিশু শ্রমের হার অনেক কমেছে। প্রসবকালীন মৃত্যু, শিশু মৃত্যুর হার নেই বললেই চলে। এলাকার সবাই শিশু বিবাহের কুফল সম্পর্কে অনেক সচেতন। তারা এখন আর ১৮ বছরের আগে কন্যা সন্তানের বিয়ে দেন না। মোছা. মর্জিনা খাতুনের বাড়ি রয়হাটি গ্রামে। তার স্বামীর নাম মো. সবুজ। তিনি অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী। মর্জিনা খাতুন বলেন, বাল্যকালে ছিল দু’চোখ ভরা স্বপ্ন আর ভালো কিছু করার আকাঙ্খা। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যেতে খুব একটা সময় লাগেনি। ৫ম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতেই আমার বিয়ে দিয়ে দেয় বাবা-মা। চলে আসি শ্বশুর বাড়িতে। তারপর থেকে নতুন করে কষ্ট বাসা বাধতে শুরু করে। শ্বশুর বাড়িতে ক’দিন যেতে না যেতেই আমার স্বামীকে পরিবার থেকে পৃথক করে দেন। তারপর জীবনে অনেক সংগ্রাম করে বর্তমানে আমরা স্বচ্ছল। আমি প্রথমে ৬০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করি গুড নেইবারস ফারমারস্ সমবায় সমিতি থেকে। সেখান থেকেই মূলত আমাদের উত্থান। ঋণ নিয়ে আমরা পরিকল্পনা মোতাবেক একটি পাওয়ার লুম (বিদ্যুৎ চালিত তাঁতের মেশিন) কিনি যার মূল্য ছিল ৭৫ হাজার টাকা। মেয়ে দুইটাকে স্কুলে ভর্তি করি। বড় মেয়ের বয়স ২০ বছর ও ছোট মেয়ের ১৫ বছর। বড় মেয়ে এইচএসসি পাশ করে ডিগ্রিতে ভর্তি আছে। ছোট মেয়েও স্কুলে অধ্যয়নরত। আমাদের তাঁতের ব্যবসার প্রসারের জন্য পরবর্তিতে আরো ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা রায়গঞ্জ গুড নেইবারস ফারমারস্ সমবায় সমিতি থেকে পূনরায় ঋণ নেই। এখন আমরা ৬ টি পাওয়ার লুমের মালিক। প্রতিটি পাওয়ার লুমের দাম ৭৫ হাজার টাকা। এতে করে আমাদের ৬ টি পাওয়ার লুমের দাম পড়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সাথে একটি গাভীও কিনেছি। গর্বের সাথে বলতে পারি এখন আমাদের অধিনে ৬ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে তাদের ৩ হাজার করে বেতন দিতে পারি। তাদের বেতন দিয়েও আমাদের প্রতি মাসে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হয়। ছেলে মেয়েদের নিয়ে এখন বেশ ভালো আছি এখন। মোছা. শাহানা ইয়াসমিন তুলির বাড়ি রনতিথা গ্রামে। তার স্বামীর আব্দুল্লাহ আল সুমন। তিনি শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী। শাহানা ইয়াসমিন তুলি বলেন, নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমার বিয়ে হয়। সম্পূর্ণ নতুন একটি জায়গায় পরিবেশ আমার অনুকূলে ছিলনা। ছাত্রী হিসাবে ভালো ছিলাম ও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিলাম। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মানসিক অস্বস্তির কারণে আমি বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহন থেকে বিরত ছিলাম। তারপরও নিজের প্রচেষ্টায় আমি বাড়িতেই পড়াশোনার কাজ চালিয়ে যেতে থাকি ও এসএসসি পরিক্ষায় অংশ গ্রহন করে ৩.০৬ (জিপিএ) পাই। আমি যখন বিএসএস ১ম বর্ষের ছাত্রী তখন আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। ১ম বর্ষের পরিক্ষার সময় আমার সন্তানের বয়স খুবই অল্প ছিল। সে বুকের দুধের উপর নির্ভরশীল ছিল। তাকে রেখে পরিক্ষা দিতে যাওয়া আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। আবার বিএসএস ৩য় বর্ষের পরিক্ষার সময় আমার স্বামী সড়ক দূঘটনার স্বীকার হন। ঐ সময় দুশ্চিন্তা ও মানসিক বিপর্যস্ততা নিয়েই আমি পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করি। সাংসারিক ঝামেলায় আমি বাড়িতে থেকেই সহপাঠীদের সাহায্য নিয়ে তাদের থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে আমি আমার পড়ালেখার কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। এত প্রতিকূলতা সত্বেও বিএসএস পরিক্ষায় আমি প্রথম বিভাগ অর্জন করি। এমএসএস পরিক্ষায় আমি দ্বিতীয় বিভাগ অর্জন করি। বর্তমানে আমি ধানগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষিক হিসাবে কর্মরত আছি। জয়িতা ওমেলা বেগমের বাড়ি গ্রামসোনাই গ্রামে। স্বামীর নাম মগরব আলী। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী তিনি। ওমেলা বলেন, আমার স্বামী মগরব আলীর বাড়ি-ভিটা কিছুই নাই। মা-বাবা ভেবেছিল পরিশ্রম করে মেয়েকে খাওয়াতে পারবে। কিন্তু বিবাহের পর আসল চেহারা প্রকাশ পায়। সে কোনো কাজ করে না। অত্যন্তে কষ্টের দিন কাটতে লাগলো। বাবার বাড়ি নিকটে হওয়ায় অনেক সময় খাবার এনে খেয়েছি। স্বামী সারাদিন আড্ডা মেরে বাড়ি ফেরে। চাল-ডাল বাড়িতে কিছুই নেই। একথা বললে আমাকে শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। এছাড়া আমি দেখতে কালো হওয়ায় স্বামী আমাকে ভালবাসতো না। অকারণে শারিরীক নির্যাতন করতো, অনেক সময় সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়ি চলে যেতাম। ইতিমধ্যে সংসারে ২টি সন্তান আসে আমাদের পরিবারে। তাদের খাওয়ার যোগাতে আমাকে হিমশিম খেতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে ইট ভাটার কাজে বেছে নেই। দৈনিক ২০০ টাকা মুজুরী দিয়ে কোনোভাবে জীবন চালিয়ে যাচ্ছি। স্বামী কাজের কথা বলতেই আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে। সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে মন চাইতো। শুধু সন্তানদের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি। এভাবে চলতে চলতে ২০০ টাকা দিন মাটি কাটার কাজ শুরু করি। এ কাজ থেকে প্রাপ্ত মুজুরী দিয়ে সংসার চালিয়েছি। আবার ২টি সন্তানকে পড়ালেখা শিখিয়েছি। মেয়েকে এসএসসি পর্যন্ত পড়িয়ে বিবাহ দিয়েছি। ছেলে বর্তমানে ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে। স্বামী শারিরীক ও মানসিকনির্যাতন সহ্য করেও সংসারের হাল ধরে রেখেছি। বর্তমান আমার অবস্থা পূর্বের চেয়ে কিছুটা ভাল। পূর্বের জীবনের কথা ভুলে আমি নতুন করে আগামী দিনের আশায় জীবন-যাপন করছি। স্বামীকে নেশার পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছি। সেও বর্তমান গরু পালন করে কিছুটা রোজগার করছে। আট জনের সংসার ভালই চলছে। এ প্রসঙ্গে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা খাদিজা নাছরিন দৈনিক খবর পত্রকে বলেন, সংগ্রামী জয়িতারা আমাদের গর্ব। তারা সমাজের নির্যাতিত অন্যান্য নারীদের জীবনের সফল হওয়ার প্রেরণাও বটে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com