প্রথম ধাপে লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় আগামী ৮ মে অনুষ্ঠিত হবে উপজেলা নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আ.লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রকাশ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। সংঘর্ষ ও মারামারির সম্ভাবনাও রয়েছে এ উপজেলায়। রামগতির অসম্ভব জনপ্রিয় ভূমিহীন নেতা” খ্যাত আযাদ উদ্দীন চৌধুরীর স্ত্রী প্রার্থী হওয়ায় পাল্টে গেছে দৃশ্যপাট। মেঘনানদী বেষ্টিত উপকূলীয় এ অঞ্চলে উন্মুক্ত নির্বাচনের হাওয়ায় জমে উঠেছে উপজেলা নির্বাচন। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার পর থেকে শুরু হয় প্রচার প্রচারণা। বিভিন্ন কৌশলে ভোটারদের মন জয় করা, জনসমর্থন আদায় করতে সামাজিক,পারিবারিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন প্রার্থীরা। আবার অনেক প্রার্থীরা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে উঠান বৈঠক করছেন এবং ভোটারদের দোয়া ও সমর্থন চাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত উপজেলার বিভিন্ন হাট বাজারে ও চায়ের স্টলে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে চলছে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক। এলাকার সাধারণ ভোটার ও সচেতন মহলের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সৎ, নিষ্ঠাবান ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে তারা বিজয়ী করতে চান। এক্ষেত্রে আলোচনায় রোকেয়া আযাদ ও আবদুল ওয়াহেদকে দেখছেন তারা। কারণ হিসেবে ৮ জন ভোটার জানান,আজাদ উদ্দিন চৌধুরী: যিনি ভূমিহীন নেতা থেকে জনমানুষের নেতায় পরিণত হয়েছেন। তারই স্ত্রী ও প্রথম নারী উপজেলা চেয়ারম্যান রোকেয়া আযাদকে নিয়ে তাদের আগ্রহ বেশী। জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরগজারিয়ার” ভূমিহীনদের সংগঠিত করে তাদের অধিকার আদায়ে মাঠে নামেন মরহুম আযাদ উদ্দীন চৌধুরী। ভূমিহীনদের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে হয়ে যান ভূমিহীন নেতা। সেখান থেকে হয়ে যায় জনমানুষের নেতা। ১৯৫০ সালের ২৫ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার ইউনিয়নে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম হারিছ আহমদ এবং মাতা বেগম আনোয়ারা। হাতিয়া দ্বীপ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আলেকজান্ডার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার। ২০০২ সালে রামগতি পৌরসভার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন এ নেতা। বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের সাবেক আইনজ্ঞ মরহুম সিএসপি আবদুর চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন আযাদ উদ্দীন। আব্দুর রব চৌধুরী তার শশুর। প্রথমে বিএনপির রাজনীতিতে স্থিত হলেও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মরহুম আবদুর রব চৌধুরীর দল বদল করে যোগ দেন আওয়ামীলীগে।সাথে সাথে তিনিও যোগ দেন ওই দলে। কয়েক বছর পুর্বে রামগতি উপজেলা আওয়ামীলীগের সদস্য পদ পেলেও ২০২১ সালের প্রথম দিকে রামগতি উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। চরগজারিয়ার ভূমিহীন মানুষদের সংগঠিত করার মাধ্যমে নেতৃত্বদান শুরু হয় তাঁর। এক নামে সবাই আযাদ উদ্দীনকে ভূমিহীন নেতা হিসেবে চিনেন। একসময়ে তিনি হন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর উত্থান ঘটে। এর পর আজাদ নেতা নামে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। তবে রাজনীতির মাঠে আলোচনায় নিয়ে আসেন মরহুম আবদুর রব চৌধুরী। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মরহুম আজাদ উদ্দিন চৌধুরী হরিণ প্রতিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ প্রার্থী আবদুল্যাহ আল মামুনের কাছে পরাজিত হন। দ্বিতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মামলা জটিলতায় নির্বাচন করতে না পারলেও তারই স্ত্রী বেগম রোকেয়া আজাদকে নির্বাচিত করেছেন তিনি। রোকেয়া আজাদ ছিলেন বাংলাদেশের দুইজন মহিলা উপজেলা চেয়ারম্যানের একজন। বর্তমানে তিনি এ উপজেলার সর্বস্তরের জনগণের নেত্রী হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করার ঘোষণার সাথে সাথে উপজেলা সর্বস্তরের মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়ে আলেকজান্ডার বাজারে বের করেন আনন্দ মিছিল। আযাদ নেতার ইন্তেকালের পর নেতৃত্বের দায়িত্ব পড়ে তারই স্ত্রী রোকেয়া আযাদের উপর। বর্তমান তিনি চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। রামগতি উপজেলার খেটে খাওয়া মানুষের নন্দিত নেতায় পরিনত হয়েছিলেন ভূমিহীন নেতা আযাদ উদ্দীন। অসম্ভব জনপ্রিয়তাই তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী প্রায় ৪৪টি মামলার (সাধারন ডায়েরি একটিসহ) আসামি হন তিনি। এর মধ্যে ৩৫টিতেই খালাস পান। নয়টি রয়েছে বিচারাধীন। তাঁর সত্তর বছরের জীবনে বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক কারনে কারাবরণ করেন। মেঘনার ভাঙ্গন কবলিত হয়ে মরহুম আব্দুররব চৌধুরী রামগতি উপজেলার পূর্বপার্শ্বে শিক্ষাগ্রামে বাড়ি করলে আজাদ উদ্দিন চৌধুরী এ এলাকার নাম আরসিনগর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেই আরসিনগর ভবনে নিজ বাড়িতে তিনি গত চার দশক ধরে বসবাস করে আসছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ মাতৃকারের জন্য যুদ্ধ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদ উদ্দিন চৌধুরী। বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের প্রকোপে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। লকডাউন এবং করোনা সংক্রমন ভয় উপেক্ষা করে স্থানীয় আলেকজান্ডার আ.স.ম আবদুর রব সরকারি কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাযা। এসময় হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি তাঁর জনপ্রিয়তা প্রকাশ করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। মৃত্যুকালে স্ত্রী রোকেয়া আজাদ, দুই ছেলে আরিফ আজাদ এবং এক মেয়ে রেখে গেছেন। এদিকে রামগতি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দাখিল করেন, উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ, রোকেয়া আযাদ, শরাফ উদ্দীন আজাদ সোহেল, জামশেদ আলম চৌধুরী ও মাহবুবুর রহমান। চেয়ারম্যান পদে ৫ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও প্রচারণায় রয়েছে তিন প্রার্থী। উপজেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ, সাবেক প্রথম মহিলা উপজেলা চেয়ারম্যান রোকেয়া আযাদ ও শরাফ উদ্দীন আজাদ সোহেল, এ তিনজন প্রার্থী মাঠে থাকলেও মুলত হাড্ডা হাড্ডি লড়াই হবে দুইজন প্রার্থীর মধ্যে। প্রার্থীরা হলেন আব্দুল ওয়াহেদ (দোয়াত কলম) ও রোকেয়া আযাদ (আনারস)। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উপজেলা বিএনপি রোকেয়া আযাদের পক্ষে অবলম্বন করাই তার জয়ের পাল্লা মোটামুটি শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তবে নির্বাচনের শুর থেকেই স্থানীয় এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুন বিএনপির সাবেক বহিস্কৃত নেতা শরাফ উদ্দীন আজাদ সোহেলকে সমর্থন দেওয়ায় স্থানীয় আ.লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দলের এমপি বিএনপি নেতাকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করতে কোমর বেঁধে নামায় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এতে করে দলের বিশাল একটি অংশ রোকেয়া আযাদ ও আবদুল ওয়াহেদের পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ রোকেয়া আযাদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়ায় তার পাল্লা এখন অনেকটা ভারী হয়ে উঠে। তবে রোকেয়া আযাদের গণসংযোগে জনতার ঢল দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আভাস লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপরে চেয়ারম্যান প্রার্থী রোকেয়া আযাদ বলেন,মানুষ পরিবর্তন চায়। আগের চেয়ারম্যান রামগতিকে উন্নয়নের দিক থেকে ২০ বছর পিছিয়ে নিয়েছে। কোন উন্নয়ন হয়নি। তাই পরিবর্তনের আওয়াজ উঠেছে। এবার আনারসের পক্ষে গনজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী রামগতি আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, জনগণের ভোটের মাধ্যমেই আমি বিজয়ী হব। মানুষ পরিবর্তন চায়। তাই ভোটার আমাকেই ভোট দেবেন।, উন্মুক্ত নির্বাচনে জনগণ প্রভাবমুক্ত হয়ে ভোট উৎসবে অংশ নেবে। তাই আমি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, ৮ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত রামগতি উপজেলায় মোট ভোটার সংখ্যা ২,৪৯,৯৫৮ জন। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহবুব রুমান চৌধুরী বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের সকল প্রস্তুতি রয়েছে। আশা করি জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন।