শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:১৬ পূর্বাহ্ন

তিস্তার পানি যাচ্ছে কোথায়?

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০২৪

তিস্তা বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। কয়েকটি বাঁধ, রাবার ড্যাম, পানি প্রত্যাহার, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনসহ বিভিন্ন বাধার মুখে পড়ে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের গতি হারিয়েছে নদীটি। এসব কারণে কী শুষ্ক কী বর্ষা; বেশিরভাগই সময় তিস্তার বাংলাদেশ অংশে পানি থাকে না। এতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা।
তিস্তার পানি বণ্টন : ১৯৭৪ সালে তিস্তা প্রকল্প শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে একটি অন্তর্র্বতী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত এবং ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। ডিসেম্বর থেকে মার্চের জন্য ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পানি ধরে রেখে ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ পানি দিতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি হয়নি। তখন থেকে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে। সর্বশেষ সোমবার নবান্নে রাজ্যের উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে তো তিস্তা নদীতে পানি থাকে না, আমরা বাংলাদেশকে পানি দেব কোথা থেকে?’
১৪টি স্থানে বাঁধ দিয়েছে সিকিম সরকার : মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিস্তায় কি পানি আছে যে বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে? তাহলে তো উত্তরবঙ্গের মানুষ খাওয়ার পানিই পাবেন না। বর্ষার তিস্তার সঙ্গে যেন গ্রীষ্মের তিস্তাকে এক করে দেখা না হয়। সিকিম থেকে নেমে আসা তিস্তা নদীর ১৪টি স্থানে সিকিম সরকার বাঁধ দিয়ে ১৪টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করেছে। এতে করে ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সব জলই টেনে নিচ্ছে সিকিম সরকার। এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে বারবার জানালেও তারা কোনও উদ্যোগ নেয়নি। ফলে সেই সমস্যায় এখনো ভুগছে পশ্চিমবঙ্গের তিস্তাপারের মানুষ।
বাংলাদেশে তিস্তা নদীর বর্তমান পরিস্থিতি: বাংলাদেশে তিস্তা নদী প্রবেশ করে নীলফামারীর জলঢাকা এবং লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার মাঝখানে দোয়ানীতে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে। এই ব্যারাজের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করে নদীর ডান তীরে চারটি জেলায় তিস্তা সেচ প্রকল্প পরিচালিত হয়। তবে প্রকল্পের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, কারণ ব্যারাজের সামনেই বালুর স্তর জমে গেছে; যা ব্যারাজের কার্যক্ষমতা হ্রাস করেছে। অপরদিকে গত বছর সিকিমে বাঁধ ভাঙার কারণে তিস্তা ব্যারাজের বিভিন্ন অংশে পলি জমে গেছে। এবারের বৃষ্টিতে ব্যারাজের ৭৩ কিলোমিটার দূরে তিস্তা রেলসেতু পয়েন্টে পানি বেড়েছে। এই পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বাড়েনি, বরং নদীভাঙন বেড়েছে। কয়েকটি চর ভেঙে কয়েকশ বাড়িঘর অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে হয়েছে।
তিস্তা নদীর দুর্দশার কারণ: দুর্দশার প্রধান কারণ হলো নদীকে তার স্বাভাবিক প্রবাহে চলতে না দেওয়া। এর অভ্যন্তরে এবং আশপাশের এলাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করা হয়েছে। যা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
১৯৭৯ সালে তিস্তা নদীতে প্রথম বাঁধ নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৯০ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শেষ হয়। ব্যারাজে ৪৪টি গেট আছে; যা শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখে এবং তিস্তার ডান পাশের চারটি জেলায় কৃষিকাজের জন্য পানি সরবরাহ করা হয়। ২০০০ সালের আগে তিস্তার অভ্যন্তরে গুচ্ছগ্রাম বা আবাসন প্রকল্প করা হয়, যা তুলনামূলকভাবে অল্পসংখ্যক মানুষকে সুফল দিয়েছিল। ২০০৪ সালে আদিতমারী উপজেলায় দুটি স্পার বাঁধ নির্মাণের ফলে তিস্তার ডান ও বামতীর এবং চরা লে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ২০১২ সালে লক্ষীটারি ইউনিয়নে তিস্তা সড়ক সেতু বা শেখ হাসিনা সেতুর উদ্বোধন করা হয়।
কালিগঞ্জ উপজেলায় শৈলমারির চরে ১২০ একর জমিতে ইন্ট্রাকো সোলার প্যানেল প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা সোলার প্রকল্পে সাড়ে পাঁচ লাখ প্যানেল বসানো হয়েছে। এসব প্রকল্পের আশপাশে বিভিন্ন স্থাপনা, বাড়িঘর, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাঁধ, বাজার এবং পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জে ব্যক্তি মালিকানায় আলীবাবা থিম পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি বছর তিস্তা নদীর ভাঙন নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। নদীর অভ্যন্তরে প্রকল্প স্থাপনের কারণে তিস্তা নদী তিনটি চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে চর এবং চরবাসীর মধ্যে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। তিস্তা ব্যারাজের কারণে এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে এবং দুই লাখ ২০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে।
নদীর বাম তীর রক্ষা কমিটির গবেষণা বলছে, তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। ভাঙনে দুই লাখ ২০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাম তীর রক্ষা কমিটির দাবি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন অজুহাতে দামি জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলছে। যার আর্থিক মূল্য দিয়ে বাঁধ তৈরি করা যেতো।
যা বলছেন স্থানীয়রা: ৬৫ বছরের রুস্তম আলী তিস্তা নদীতে নৌকায় বসে বলেন, ‘আমার বাবা এই এলাকার তালুকদার ছিলেন। আমরা এখানে নদীর পাড়েই বড় হয়েছি। এখন তিস্তায় কোনও ঢেউ নেই। পানি নেই। তিন ভাগে ভাগ হয়েছে। দেশ স্বাধীনের আগে এখান থেকে নৌকায় চড়ে ত্রিমোহনী নদী দিয়ে তুসভান্ডার জমিদার বাড়ির ঘাটে গিয়েছিলাম। এখন সেগুলোর অস্তিত্ব। বেশিরভাগই সময় নদী শুকনো থাকে।’
বারোঘরিয়া গ্রামের ৭০ বছরের বজলুর রহমান বলেন, ‘তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। বর্ষায় কিছুটা পানি এলে নদীভাঙন শুরু হয়। আমরা অনেকে বসতভিটা হারিয়েছি। আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রম: পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছর দুটি স্পার বাঁধ নির্মাণ করে এবং ২০২৩ সালে মহিষখোচা ইউনিয়নে ৫০ কোটি টাকার একটি তীররক্ষা বাঁধ উদ্বোধন করেছিল। প্রতি বছর আপদকালীন ভাঙনরোধে জিও ব্যাগ ফেলে। কিন্তু ভাঙনরোধ হয় না।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রংপুরের বিভাগীয় উপ-প্রকৌশলী কৃ কমল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘গত সাত বছরে চারবার পানি পরিমাপের রিডিং পরিবর্তন হয়েছে। ৫২.২৫,৫২.৪০ বর্তমানে ৫২.৬০ সেন্টিমিটার করা হয়েছে।তারা বলছেন,আগের পানির বিপদসীমার রিডিং তৈরি করেছিলো গণপূর্ত বিভাগ। এবার তৈরি করেছে সার্ভে অব বাংলাদেশ (এসওবি)। তারা বলেছে পানি পরিমাপের রিডিং পরিবর্তন হয়েছে। পানির লেভেল পরিবর্তন হয়নি।এসওবি এবং গণপূর্ত বিভাগের রিডিংএ মাঝখানের তফাৎ পয়েন্ট ৪৫।’
তিস্তা রক্ষায় আন্দোলন ও দাবি: বামতীর রক্ষা কমিটি, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও কমিটি, নদীবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলসহ বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন তিস্তা নদী রক্ষার জন্য মাঠপর্যায়ে আন্দোলন করছে। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের পাঁচ শতাংশ খরচ করলে কাউনিয়ার রেলসেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ দেওয়া যেতো বলে দাবি করছে সংগঠনগুলো।
বামতীর রক্ষা কমিটির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, তিস্তা ব্যারাজ হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০ হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। তিস্তার ভাঙনে দুই লাখ ২০ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। লালমনিরহাটের ১৩টি ইউনিয়ন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। বর্ষায় গড়ে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ ১০ হাজার কিউসেক পানি আসে। লালমনিরহাট অংশ দিয়ে প্রবাহিত হতে হতে নদী নাব্যতা হারিয়েছে। এর প্রস্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ কিলোমিটার, যা দুই কিলোমিটার থাকার কথা। এ কারণেই মূলত বন্যা-ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা : রিভারাইন পিপলের পরিচালক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘২০১৭ সালে বন্যার সময় সিরাজুল মার্কেট নামের স্থানে তিস্তা সব কিছু ভেঙে প্রবাহিত হয়। পরে কিছু বালুর বস্তা দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ওখানেই আরও দুটি চ্যানেল আছে। কিন্তু মূল নদী একটি চ্যানেলেই প্রবাহিত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদে যদি পানি কম থাকে তাহলে তিস্তার পানি দ্রুত নেমে যায়। কাউনিয়ার ব্রিজের ওপরে দাঁড়ালেও দেখা যাবে তিস্তা দুটি চ্যানেলে দুই দিকে চলে গেছে। চ্যানেলে বিভক্ত হওয়ার একটি কারণ হলো নদীতে বাঁধ। এই নদীতে বাঁধ না দিলে পানির প্রবাহ ঠিক থাকতো।’
নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. বিধান চন্দ্র দাস বলেন, ‘পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে। নদীতে পলি জমাটা দীর্ঘমেয়াদি কাজ। এর বুকে স্থাপনা বা আশপাশে স্থাপনা তৈরি হওয়ায় পানিপ্রবাহ কমেছে। প্রবাহ ঠিক রাখতে নদী খনন করতে হবে। প্রাকৃতিক কারণে নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে এই অ লের মানুষ কৃষি আবাদ করতে পারছে না। জেলেরা মাছ পাচ্ছে না। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।’- বাংলা ট্রিবিউন




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com