চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, ফিলিস্তিন সঙ্কট, মানবাধিকার, টেকসই উন্নয়ন, জাতিসংঘ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও চীন পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে। তিনি গতকাল রোববার বিকেলে গণভবনে গত ৮ থেকে ১০ জুলাই তাঁর চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ আশাবাদ ব্যক্ত
করেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হলো-
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় সাংবাদিকবৃন্দ, ও সহকর্মীবৃন্দ।
আসসালামু আলাইকুম! শুভ অপরাহ্ণ!
চীনের মাননীয় প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কউন্সিল মি. লিছিয়াং-এর আমন্ত্রণে দ্বিপাক্ষিক সফরে আমি ৮ থেকে ১০ জুলাই ২০২৪ চীন সফর করি। মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী, মাননীয় অর্থ মন্ত্রী, মাননীয় বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ এবং একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল আমার সফরসঙ্গী ছিলেন। ৮ জুলাই বেইজিং পৌঁছালে বিমানবন্দরে আমাকে লাল গালিচা সংবর্ধনার মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়।
৯ জুলাই সকালে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-র প্রেসিডেন্ট জিন লিকুন আমার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আমি এআইআইবি-কে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, নদী খনন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ উপযোগী খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানাই। এরপর আমি “দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার: সামিট অন ট্রেড, বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড চায়না” শীর্ষক একটি ব্যবসায়িক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। আমার সফরসঙ্গী ব্যবসায়ী প্রতিনিধিবৃন্দ এবং চীনের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীগণ এতে অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে আমি চীনা ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচেয়ে উদার বিনিয়োগ ব্যবস্থার সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানাই। অবকাঠামো, আইসিটি, পর্যটন, কৃষি প্র?িয়াকরণ শিল্প, নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ জ্বালানি খাত, জলবায়ু-সহনশীল স্মার্ট ফার্মিং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সবুজ প্রযুক্তি ও উন্নয়ন খাতে বৃহত্তর বিনিয়োগের আহ্বান জানাই। আমি এ সময় বাংলাদেশে ৩টি বিশেষ পর্যটন অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ও সেখানে চীন রিয়েল এস্টেট এবং হসপিটালিটি খাতে বিনিয়োগের সুযোগের কথা উল্লেখ করলে চীনের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান। চীনে বাংলাদেশ দূতাবাস, বিআইডিএ, বিএসইসি এবং চায়না ওয়ার্ল্ড সামিট উইং আয়োজিত এ সম্মেলনে চীনের ভাইস মিনিস্টার অব কমার্স লি ফেই, চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ওয়াং টং ঝু, এইচএসবিসি-চায়নার প্রেসিডেন্ট ও সিইও মার্ক ওয়াং, হুয়াওয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইমন লিন বক্তব্য দেন এবং তাদের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন। এই সম্মেলনে বাংলাদেশের ১০টি কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে চীনের বিভিন্ন কোম্পানির ১৬টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়। ৯ জুলাই বিকেলে আমি চাইনিজ পিপলস পলিটিক্যাল কনসাল্টেটিভ কনফারেন্সের (সিপিপিসিসি) জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওয়াং হুনিং-এর সঙ্গে বৈঠক করি। আমরা এ বৈঠকে আওয়ামী লীগ এবং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করি। দলীয় নেতাদের পারস্পরিক সফরের বিষয়েও আমরা একমত হই। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমি চীনের সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করি। এদিন বিকেলে আমি চীনের ঐতিহ্যবাহী তিয়েনআনমেন স্কয়ারে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
১০ জুলাই সকালে বেইজিং-এ গ্রেট হল অব দ্য পিপল-এ চীনের মাননীয় প্রিমিয়ার অব দ্য স্টেট কউন্সিল মি. লিছিয়াং-এর সঙ্গে আমার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গ্রেট হল-এ পৌঁছালে মি. লি ছিয়াং আমাকে স্বাগত জানান এবং দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। চীনের সশস্ত্র বাহিনীর গার্ড অব অনার এবং তোপধ্বনির মাধ্যমে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। প্রিমিয়ার লি ছিয়াং-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় বাংলাদেশ-চীনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের সহায়তা, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতা, বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রভৃতি বিষয় আমরা আলোচনা করি। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর জন্য বাংলাদেশের কৃষিপণ্য, চামড়া, ওষুধ প্রভৃতি পণ্য চীনে আরও বেশি পরিমানে রপ্তানির অনুরোধ করি। বাংলাদেশ উৎপাদিত ৯৮ শতাংশ পণ্যের চীনে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা প্রদানের জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রণীত সাউদার্ন ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এসআইডিআই) বাস্তবায়নে চীনের অবকাঠামোগত ও আর্থিক সহায়তা কামনা করলে প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং ইতিবাচক সাড়া দেন। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের পর সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করি এবং এই বিষয়টিতেও চীনের সমর্থন লাভ করি। এরপর আমার এবং প্রধানমন্ত্রী লি ছিয়াং-এর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বিভিনড়ব খাতে মোট ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ডিজিটাল ইকোনমি সংক্রান্ত বিনিয়োগ সহযোগিতা, ব্যাংকিং এবং ইন্সুরেন্স রেগুলেশন, বাংলাদেশ হতে আম রপ্তানি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতা, ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট পলিসি, বাংলাদেশ-চায়না ষষ্ঠ ও নবম ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ, অবকাঠামোগত সহযোগিতা, গ্রিন এন্ড লো কার্বন ডেভেলপমেন্ট, ব্রহ্মপুত্র নদের হাইড্রোলজিক্যাল ইনফরমেশন প্রদান সং?ান্ত সমঝোতা স্মারক নবায়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা সং?ান্ত সমঝোতা স্মারক নবায়ন, পিপল টু পিপল কানেকটিভিটি এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফর সাসটেইনেবল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি (পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংযুক্ত)।
এছাড়াও, এই সফরের ফলাফল হিসেবে ইতোমধ্যে সম্পাদিত ৭টি দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাই, চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ, ডিজিটাল সংযোগের আধুনিকায়ন, ডাবল পাইপ লাইনযুক্ত সিংগেল পয়েন্ট ম্যুরিং প্রজেক্টের পরীক্ষামূলক চালুকরণ, রাজশাহী ওয়াসার সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট, চীনের শ্যানডং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা এবং বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার বিকাশে লুবান ওয়ার্কশপ নির্মাণ অন্যতম (পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংযুক্ত)। এরপর আমার সম্মানে প্রিমিয়ার লি ছিয়াং আয়োজিত ব্যাংকুয়েট-এ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিসহ অংশগ্রহণ করি। ১০ জুলাই বিকেলে বেইজিং-এ গ্রেট হল অব দ্য পিপল-এ চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শি চিনপিং-এর সঙ্গে আমি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করি। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালে চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতির শি চিনপিং-এর বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের সম্পর্ক “কৌলগত অংশীদারিত্ব” পর্যায়ে উন্নীত হয়, যা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করে। ১০ জুলাই দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে শি চিনপিং অনুদান, সুদমুক্ত ঋণ, রেয়াতি ঋণ ও বাণিজ্যিক ঋণ-এ ৪টি ক্ষেত্রে সহায়তার কথা উল্লেখ করেন। এই ৪টি প্যাকেজের আওতায় চীন বাংলাদেশকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমান অর্থ প্রদানে সম্মত হয়েছে। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বৃহদাকার অবকাঠামো বিনির্মাণে চীনা সহায়তার জন্য আমি তাঁর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৮০০ একর জমিতে শিল্প বিনিয়োগ করার জন্য প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং-এর মাধ্যমে আমি চীনা উদ্যোক্তাদের আহ্বান জানাই। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল ও আইসিটির বিশেষায়িত অঞ্চলে চীনকে বিনিয়োগের অনুরোধ করি। বাংলাদেশের প্রতি চীনের অব্যাহত সমর্থনের কথা উল্লেখ করে চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এখানে অধিকতর বিনিয়োগের বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করেন।
বাংলাদেশে আশ্রিত জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক-রোহিঙ্গাদের অবস্থা এবং তাদের সমস্যার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে এর সমাধানে আমি চীনের সহযোগিতা কামনা করি। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে চীনের মহামান্য রাষ্ট্রপতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশ ও চীনের পারস্পরিক সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলে উভয় পক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করি। আমাদের এ ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার সম্পর্ক “সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব” পর্যায়ে উন্নীত হয়। আগামী বছর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্র নীতি “সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়”, এটিকে মূলনীতি হিসেবে ধরে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফলভাবে তার কূটনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা, ফিলিস্তিন সঙ্কট, মানবাধিকার, টেকসই উন্নয়ন, জাতিসংঘ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও চীন পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রই নয়, ঐতিহ্যগত দিক থেকেও এশীয় দেশ হিসেবে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের সংযোগ রয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং আধুনিক স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গবেষণা, শিক্ষা, আইসিটি, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। আমার এই সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক কর্মকান্ডে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। খোদা হাফেজ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।