ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির বিরুদ্ধে বেপরোয়া সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ বই (নোট গাইড) বাণিজ্যের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে।উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির প্রথম সারির কতিপয় নেতা অখ্যাত প্রকাশনী সংস্থার সঙ্গে যোগসাজশে নি¤œমানের ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ এবং প্রত্যেক বিষয়ের সহায়ক নাম করে নোট গাইড বই পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে মোটা অংকের অর্থ বাণিজ্য করছে বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। কালীগঞ্জে শিক্ষক সমিতির তালিকাভুক্ত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইয়ের বাইরে সহায়ক বইয়ের নামে নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে শিক্ষার্থীদের চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়। শিক্ষক সমিতির নেতা, এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও শিক্ষকদের একটি সিন্ডিকেট উচ্চমূল্যের এসব বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্য করছেন। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সবখানেই মূল বইয়ের সঙ্গে দামি গাইড বই বিক্রি করে ওই সিন্ডিকেট লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বই কোম্পানিগুলোর নিকট থেকে। বিশেষ করে শ্রেণীকক্ষে কোম্পানির বিক্রয়কর্মীদের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বাগবিতান্ডার ঘটনাও ঘটছে। একাধিক শিক্ষক জানান, নতুন কারিকুলামে বই পাঠদানের জন্য সরকার শিক্ষকদের টিচার্স গাইড দিয়েছে। তাছাড়া ক্লাসের শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করে পিয়ার ও গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের দিকনির্দেশনাও দিয়েছে। যেটি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করালে বাড়তি কোনো বই কেনার প্রয়োজন পড়ে না। অভিভাবকদের শিক্ষাব্যয় হ্রাস করার জন্য সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ করে প্রতি বছর। এক সময় প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেওয়া হতো। এখন মাধ্যমিক পর্যায়ে ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত বই দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের একটি বড় সফলতা বলা যেতে পারে। এর পেছনে সরকারের বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এর সুফল কতটা ভোগ করতে পারে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা? এ ব্যাপারে নানা জনের নানা মত থাকলেও বাস্তবতা হলো বছরের শুরুতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাওয়ার পরও অভিভাবকদের বই কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তার সীমা থাকে না। দুশ্চিন্তার সংগত কারণ হলো-শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই কালীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষক সমিতি অতি উচ্চমূল্যের কিছু গাইড বই বেসরকারিভাবে শ্রেণীভিত্তিক পাঠ্য তালিকাভুক্ত করে। বেসরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা এই গাইড বই গুলোর ওপর জোর দিয়ে সরকারি কারিকুলাম উপেক্ষা করে শ্রেণী কক্ষে পাঠদান করানো হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সেগুলো কিনতে বাধ্য হয়। সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য যে কারিকুলাম চালু করেছে তাতে কোনো ধরনের নোট গাইডে শিক্ষার্থীদের পড়ার কিছু নেই। এই কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে ও বাস্তবমুখি শিক্ষা দেবে।সরকার নতুন কারিকুলাম বাস্তবতায় ও বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের মহৎ উদ্যোগটি যে লক্ষ্য নিয়ে চালু করা হয়েছে তা পূরণ হচ্ছে না অসৎ শিক্ষকদের কারণে। মুখে যাই বলা হোক না কেন,অভিভাবকরা বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের সুফল ভোগকরতে পারেন না খুব একটা। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিং করতেও দেখা যায় না। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় দেদারছে উচ্চমূল্যের গাইড বই বিক্রি হয়। প্রথম শ্রেণী থেকে গাইড নির্ভর হয়ে যায় কোমলমতি শিশুরা।কালীগঞ্জে প্রতি বছর মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। শোনা যায় এ শিক্ষক সমিতির নিজস্ব তহবিলে নাকি কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত আছে। এর একটা অংশ শিক্ষকদের চাঁদা থেকে এলেও বেশির ভাগ টাকাই নাকি আসে নোট গাইড কোম্পানি বা প্রকাশকদের কাছ থেকে। যে প্রকাশক বা কোম্পানি বেশি টাকার প্রস্তাব করে শিক্ষক সমিতি সে প্রকাশকের বই পাঠ্য করে। এ ক্ষেত্রে মান যাচাই পর্যন্ত করা হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমতো মানসম্পন্ন বইটিও কিনতে পারে না। এ পরিস্থিতি আমলে নিয়ে সরকার বিভিন্ন সময় গাইড বই নিষিদ্ধ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শিক্ষকরা গাইড বই পড়াতে পারবে না মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সবাই নিজ নিজ বাণিজ্যিক স্বার্থে আইনকে পাশ কাটিয়ে পকেট ভারি করে। বিশেষ করে কালগিঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন ও সাধারন সম্পাদক হারুন অর রশিদ দীর্ঘ দিন বিনা ভোটে দায়িত্ব পালন করে এসব অবৈধ বই বাণিজ্য করছেন।
বই প্রকাশরা সমিতির মোটা অংকের টাকা প্রদান করেন ও সমিতির সভাপতি সাধারন সস্পাদককে ব্যাক্তিগতভাবে হিস্যা দিয়ে থাকেন।টেক্সটবুক বোর্ড কর্তৃক বিনামূল্যে সরবরাহকৃত ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণ বই দুটি যথেষ্ট মানসম্পন্ন হওয়া সত্বেও নোট-গাইড ব্যবসায়ীদের প্রকাশিত অতি উচ্চমূল্যের গ্রামার ও ব্যাকরণ নামক দুটি বই প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করা হয়। অন্যান্য বিষয়ের গাইড বইও কিনতে হয়। প্রকাশকরা বছর ঘুরলেই তেমন কোনো পরিবর্তন না করে কিংবা সামান্য কিছু পরিবর্তন করে নতুন মোড়কে বই গুলো বাজারে ছাড়ে। গাইড বইয়ের প্রকাশক আর শিক্ষক সমিতি মিলে বইগুলো কিনতে বাধ্য করে শিক্ষার্থীদের। সরকার প্রদত্ত বিনামূল্যের পাঠ্যবই পড়ে থাকে টেবিলের এক কোণে। শিক্ষার্থীদের কাছে গৌণ হয়ে যায় বিনামূল্যের পাঠ্যবই আর মুখ্য ও বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে উচ্চমূল্যের গাইড বই।অভিযোগে জানা গেছে, নোট গাইড বই পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে নির্ধারিত কোম্পানির কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০লাখ টাকা নিয়ে থাকে কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে বই বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে।বিভিন্ন স্কুলের প্রধান শিক্ষকগণ বলেন, শিক্ষক সমিতি সব শিক্ষার্থীকে এ বই কিনতে বাধ্য করে থাকে। নতুন কারিকুলামে এ সব বই শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য কোনো কাজেই আসে না। শুধু মাত্র শিক্ষক সমিতির নিজেদের ভাগ্য পবির্তনের জন্য এসব বাণিজ্য করে থাকে।উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসূত্রে জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৫৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১২ হাজার। এ শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে নোট বই কিনতে বাধ্য করা হয়। এটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও কালীগঞ্জের শিক্ষক সমিতির কেনা প্রশ্নেই সমিতিভুক্ত বিদ্যালয় গুলোতে পরীক্ষা নেওয়া হতো বা হয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের সকল বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষন দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে। এ প্রশিক্ষনের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা নিজেরাই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার কথা। এসব প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা হবে। অন্য কোনো প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়াটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকার থেকে শিক্ষার্থীদের যে বই দেওয়া হয়েছে, সেই বই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট। শিক্ষক সমিতি নির্ধারিত প্রকাশকের গাইড সমিতিভুক্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কিনতে পরামর্শ দেন। অনেক প্রশ্ন যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড দিয়ে থাকে। অবশিষ্ট প্রশ্ন সমিতি প্রদান করে উচ্চ মূল্যে।নতুন কারিকুলাম এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে অভিভাবকদের রেহাই দেবে। পাঠ্যবইকে গৌণ করে রেখে পরিকল্পিতভাবে উচ্চমূল্যের গাইড বই চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ মিলবে না নতুন কারিকুলামে। নতুন কারিকুলাম অনুসারে শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করে দেওয়া কোনো গাইড বা সহায়ক বই থাকবে না। কোনো শিক্ষার্থীর গাইড বা সহায়ক বইয়ের প্রয়োজনও হবে না। দলগতভাবে বা দুজন মিলে সব সমস্যার সমাধান করবে। প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য কিংবা ‘এ’ প্লাস পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হবে না কোনো শিক্ষার্থীকে। বইয়ের বোঝা কমবে। কোনো কিছু না বুঝে মুখস্থ করার প্রয়োজন পড়বে না।ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে নতুন প্রজন্ম। নতুন কারিকুলামের এ ভালো দিকগুলোকে বিবেচনায় আনছেন না অনেক অভিভাবক। এমনকি শিক্ষকরাও ভালোভাবে নিচ্ছেন না বিষয়টি। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন প্রজন্মকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হলে তাদের ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যেই নতুন কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। চলতি বছর ২০২৪ সালে অষ্টম শ্রেণীর একজন শিক্ষার্থীকে ৯৬০ টাকার ব্যাকরণ বইসহ সহায়ক বই ২৩০০ টাকা, সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে ৯০০ টাকার ব্যাকরণ সহ সহায়ক বই এর দাম ২২৩০ টাকা। ষষ্ঠ শ্রেণীর বাংলা ব্যাকারণ ও ইংরেজি গ্রামারের দাম ১০৩০ টাকা এবং সহায়ক বই ২২৮০ টাকা। ৯ম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকার ও ইংরেজি গ্রামারের মূল্য১০৩০ টাকা আর সহায়ক বইয়ের মূল্য ২৭৪০ টাকা। আইন অনুযায়ী, পাঠ্যপুস্তকের নোটবই প্রকাশনা ও বিক্রি নিষিদ্ধ। এ আইন উপেক্ষা করেই ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলায় অহরহ নোটবই বিক্রি হচ্ছে। অনেকে কৌশলে গাইড-সহায়ক বই আকারে এসব বই বিক্রি করছে। চলতি বছর লেকচার কোম্পানির নোট গাইড ও সহায়ক বই পাঠ্য করার নামে বই কোম্পানির মোটা অংকের রয়েলিটি নিচ্ছে কালীগঞ্জ উপজেলা শিক্ষক সমিতি। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন উর রশিদ জানান, নোট গাইড নিষিদ্ধ না, আর যদি নিষিদ্ধই হবে তাহলে তা প্রকাশই বা কেনো করে? লাইব্রেরিতে বিক্রিই বা করে কেনো? আপনি সভাপতির সাথে কথা বলেন। এ ব্যাপারে কালিগঞ্জ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, কোনো শিক্ষার্থীদের নোট গাইড কিনতে বাধ্য করা হয় না।বই কোম্পানির নিকট থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টি ভুয়া ও বানোয়াট। তাহলে সমিতির হিসাবে বইয়ের রয়িলিটি হিসেবে দেখানো লাখ লাখ টাকার হিসেব কিভাবে এলো? এর বৌধতা আছে কিনা? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি তা কৌশলে এড়িয়ে যান। সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ নোট গাইড শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে বিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির আইনগত বিধান সম্পর্কে জানতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত)নাজমা সামাওয়াতের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, নোট গাইড বই পাঠ্য বই হিসেবে শিক্ষকদের পড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সমিতির মাধ্যমে নোট বই চালানোর কোনো সুযোগই নেয়। এটা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।