ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদন
জুলাই আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্বপালনকালে পুলিশের গুলিতে পাঁচ সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে খবর দিয়েছে ভয়েস অব আমেরিকা। এতে বলা হয়, জুলাই আন্দোলনের সময় নিহতের পাশাপাশি অন্তত কয়েক ডজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতি ভয়হীনভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের কাজের সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিংঘের মানবাধিকার কমিশন এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো। এছাড়া তারা সরকারকে জুলাই আন্দোলনে সাংবাদিকদের ওপর হামলার জবাবদিহিতা নিশ্চিতেরও আহ্বান জানিয়েছে। ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন হয়। বিশাল এক গণবিক্ষোভের তোপে ক্ষমতা ত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন হাসিনা। তবে তিনি দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ঠেকাতে কঠোর নীতি অবলম্বন করেছিলেন। আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর চড়াও হয় নিরাপত্তাবাহিনী এবং হাসিনার দলীয় নেতা-কর্মীরা। এতে কয়েকশ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। যারমধ্যে পাঁচ সাংবাদিক রয়েছে বলে জানিয়েছে ভয়েস অব আমেরিকা। গণমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্দোলনের সময় পেশাগত দায়িত্বপালনের সময় হামলার শিকার হয়েছে গণমাধ্যমকর্মীরা।
তাদের অনেককে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয় এবং কাজের সময় তাদের হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া অনেক সাংবাদিকের ডিভাইস থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন সহিংসতার ছবি বা ভিডিও মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। হসিনা-বিরোধী দলগুলো থেকেও এখনও অব্যাহতভাবে হুমকি পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সাংবাদিকরা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকশ মানুষ নিহত হয়েছেন। গত জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমে যে ৩০ শতাংশ নিয়োগের বিধান ছিল তা সংস্কারের জন্যই আন্দোলনে নামেন তারা। যদিও পরে শিক্ষার্থীদের এ দাবি মেনে নিয়েছিল হাসিনা সরকার। কিন্তু তার আগেই আন্দোলন চরম মাত্রা লাভ করেছিল। শিক্ষার্থীদের সাথে সাধারণ বেসামরিক নাগরিকরাও সমাজের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন। পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলন থেকে এক দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছিল। তারা হাসিনার পদত্যাগের দাবি করেছিলেন। এই দাবিতে ৫ আগস্ট ঢাকার রাস্তায় নেমে আসেন লাখ লাখ জনতা। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে শেষ পর্যন্ত দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। দেশ ত্যাগের আগে তিনি টানা ১৫ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। ছোট বোন শেখ রেহেনাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি যাওয়ার পর দেশে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হন বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ব্যক্তি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নতুন এই সরকারকে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, সাংবাদিকদের সুরক্ষা কমিটির এশিয়া প্রোগ্রামের সমন্বয়কারী বেহ লিহ ই। তিনি বলেছেন, নতুন সরকারকে এমন স্বচ্ছ এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে গণমাধ্যমের ওপর সমস্ত হামলার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়। অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও একই আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি জুলাই আন্দোলনে সাংবাদিকদের হতাহতের সঙ্গে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে। যেকোনো ধরনের ভয়-ভীতি ছাড়াই যেন গণমাধ্যম কাজ করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে বলে জোর দাবি জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন।
জুলাই আন্দোলনে বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো গুলিতে পাঁচ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। পুলিশের গুলিতে ১৮ জুলাই হাসান মেহেদী নামের এক সাংবাদিক নিহত হন। তিনি ঢাকা টাইমস নামের একটি নিউজ পোর্টালে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার যাত্রাবাড়িতে খবর সংগ্রহের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। একই দিনে ভোরের আওয়াজ নামের একটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদক শাকিল হোসাইন নিহত হন। ওই দিন দৈনিক নয়াদিগন্তের সিলেটে প্রতিনিধি আবু তাহের মুহাম্মদ তুরাব নামের আরেক সাংবাদিক পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। ২ আগস্ট তাহির জামান প্রিয়ো নামের আরেক ফ্রিল্যান্স ভিডিও সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হন। এর দুই দিন পর ৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জে দৈনিক খবরপত্রের সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক প্রাণ হারান। নিহত সাংবাদিকের সকলেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের এভাবে গুলিবিদ্ধ করে নিহত করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউনেস্কোর পরিচালক জেনারেল অড্রে আজোলে। তিনি দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে এই হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাংবাদিকরা জনস্বার্থে খবর সংগ্রহ করে জনগণকে তথ্য সরবরাহ করে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়ীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানাই।’
মিডিয়া বিষয়ক ওয়াচডগ কর্তৃক বেশ কিছু অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। যেখানে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনার বিবরণ রয়েছে। দেশের প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, জুলাইতে যখন তিনি রাজধানীর রামপুরা এলাকায় ছবি সংগ্রহের কাজে ছিলেন তখন তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর ছোঁড়া গুলিতে আহত হয়েছিলেন। সেদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পুলিশ এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এদিন জীবন সহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ওই সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আহত হয়েছিল। নিজেদের বাঁচাতে পরে তারা একটি মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন জীবন আহমেদ। কিন্তু পুলিশ মন্দিরে প্রবেশ করে সাংবাদিকদের ওপর গুলি চালায়। জীবন বলেছেন, ‘আমরা নিজেদের রক্ষার্থে সাংবাদিক পরিচয়পত্র ও ক্যামেরা ব্যাগ ঢাল হিসেবে ধরেছিলাম। তবুও আমাদের মধ্যে তিনজন আহত হয়েছিলেন। আমার ব্যাগে কমপক্ষে ১৪টি গুলি লেগেছিল।’
ভিয়েনা-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট, বা আইপিআই রিপোর্ট করেছে যে মিডিয়ার উপর পরিচালিত সহিংসতা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা দীর্ঘদিন ধরে যে বৈরিতার সম্মুখীন হয়েছে তা প্রতিফলিত করে। অক্টোবর ২০২২ থেকে মার্চ ২০২৩ পর্যন্ত আইপিআই পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়মিত আক্রমণ বা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে বা আইনি হয়রানির সম্মুখীন হয়েছে।