শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৮ পূর্বাহ্ন

ফসলের জাকাত ওশর

জাফর আহমাদ
  • আপডেট সময় বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

টাকা-পয়সা স্বর্ণ-অলঙ্কার বা অন্যান্য ধন-সম্পদের হিসাব করে আল কুরআনের আটটি খাতে ২.৫০ শতাংশ যে দান করা হয় তার নাম জাকাত। তেমনিভাবে উৎপাদিত পণ্যের যেই জাকাত দেয়া হয় তার নাম ওশর নামে পরিচিত। জাকাতের মতোই এটি ফরজ বিধান। অন্যান্য সম্পদের ক্ষেত্রে নিসাব পরিমাণ সম্পদ পূর্ণ এক বছর মালিকানা থাকা শর্ত। কিন্তু ফসল এক বছর মালিকানাধীন থাকা শর্ত নয়; বরং উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলার সাথে সাথেই তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। এমনকি বছরে দু’-তিনবারও যদি ফসল উৎপাদন হয় তবে প্রতি ফসলেই জাকাত ফরজ।
ওশর ফরজ হওয়ার দলিল : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি আল্লাহই নানা প্রকার লতাগুল্ম ও বাগান সৃষ্টি করেছেন। খেজুর বীথি সৃষ্টি করেছেন। শস্য উৎপাদন করেছেন তা থেকে নানা প্রকার খাদ্য সংগৃহীত হয়। জাইতুন ও ডালিম বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন, এদের ফলের মধ্যে বাহ্যিক সাদৃশ্য থাকলেও স্বাদ বিভিন্ন। এগুলোর ফল খাও যখন ফলবান হয় এবং এগুলোর ফসল কাটার সময় আল্লাহর হক আদায় করো আর সীমা অতিক্রম করো না। কারণ সীমা অতিক্রমকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।’ (সূরা আনআম-১৪১) এ আয়াতটি দ্বারা ফসলের জাকাত ফরজ হয়েছে। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যে অর্থ তোমরা উপার্জন করেছ এবং যা কিছু আমি জমি থেকে তোমাদের জন্য বের করে দিয়েছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় করো। তাঁর পথে ব্যয় করার জন্য তোমরা সবচেয়ে খারাপ জিনিস বাছাই করার চেষ্টা করো না, অথচ ওই জিনিসই যদি কেউ তোমাদের দেয়, তাহলে তোমরা কখনো তা নিতে রাজি হও না, যদি না তা নেয়ার ব্যাপারে তোমরা চোখ বন্ধ করে থাকো। তোমাদের জেনে রাখা উচিত, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন এবং তিনি সর্বোত্তম গুণে গুণান্বিত।’ (সূরা বাকারা-২৬৭)
ওশর ফরজ হওয়ার শর্তাবলি : ১. ফসলের মালিক মুসলমান হওয়া; ২. উৎপাদনের জমি ওশরি হওয়া। ইমাম আবু হানিফা রহ:-এর মতে ওশরি জমি হচ্ছে, মুসলিম অঞ্চলের যেই ভূমির মালিক মুসলমান, তাদের ভূমিকে ওশরি ভূমি বলা হয়। মুসলমানরা কোনো দেশ জয় করার পর ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অধিকৃত ভূমি মুসলমানদের মধ্যে বণ্টন করা হলো সেই ভূমি ওশরি হয়ে যায়। কোনো ভূমি ওশরি হয়ে গেলে তা পরবর্তিতে তার ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টিত হয় এবং অন্যের কাছ থেকে ক্রয় করে নেয়ার পরও তা ওশরি ভূমি হিসেবে গণ্য। মালিকানার হাতবদল হলে ওশরি শর্তে তারতম্য ঘটবে না; ৩. ভূমি থেকে ফসল উৎপন্ন হতে হবে। উৎপাদিত ফসল এমন হতে হবে যা সচরাচর এ ভূমিতে উৎপন্ন হয় এবং এর দ্বারা নিজে ও মানুষ উপকৃত হয়।
কৃষিপণ্যের জাকাতের নিসাব : আবু সাইদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘পাঁচ ওয়াসাকের কম উৎপন্ন দ্রব্যের জাকাত নেই এবং পাঁচটির কম উটের জাকাত নেই। এমনিভাবে পাঁচ উকিয়ার কম পরিমাণ রৌপ্যের জাকাত নেই।’ (বুখারি : ১৪৮৪, ১৪০৫ কিতাবুজ জাকাত, মুসলিম-৯৭৯) ওয়াসাকের পরিমাণ : এক ওয়াসাক সমান ৬০ ছা। পাঁচ ওয়াসাক সমান ৬০ী৫=৩০০ ছা। এক ছা সমান দুই কেজি ৫০০ গ্রাম হলে ৩০০ ছা সমান ৭৫০ কেজি হয়। অর্থাৎ ১৮ মণ ৩০ কেজি। এই পরিমাণের বেশি শস্য বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত হলে ১০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত ফরজ হবে। আর নিজে পানি সেচ দিয়ে উৎপাদন করলে ২০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত ফরজ। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘বৃষ্টি ও প্রবাহিত পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা সেচ ব্যতীত উর্বরতার ফলে উৎপন্ন ফসলের উপর অর্ধ (২০ ভাগের ১ ভাগ) ওশর।’ (বুখারি-১৪৮৩, কিতাবুজ জাকাত)
জাকাত ও ওশরের মধ্যে পার্থক্য : জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য মালের মালিক সুস্থ মস্তিষ্ক, বালেগ ও স্বাধীন হওয়া হওয়া শর্ত। কিন্তু ওশরের ক্ষেত্রে এই শর্ত প্রযোজ্য নয়।
উশরের উদ্দেশ্য : ‘জাকাত ও ওশর উভয়ের উদ্দেশ্য : ১. আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করা; ২. সম্পদ বৃদ্ধি ও পবিত্র করা; ৩. দরিদ্র ও অভাবী লোকদের সাহায্য করা; ৪. একটি ন্যায় ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এবং ৫. ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে প্রচার করা। কুরআনের সূরা তাওবা, আয়াত ৬০ অনুসারে জাকাত ও ওশরের উদ্দেশ্য হলো : আটজন সুবিধাভোগীকে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়তা করা এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার অর্জন করা।’
সামাজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব : মানুষের অভাব সীমাহীন। এই সীমাহীন অভাবকে সীমাবদ্ধ করা যায় একমাত্র আত্মিক পরিশুদ্ধতার মাধ্যমেই। ওশরের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধতা আসে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে নবী! তাদের ধন-সম্পদ থেকে সদকা নিয়ে তাদেরকে পাক পবিত্র করো, (নেকির পথে) তাদেরকে এগিয়ে দাও এবং তাদের জন্য রহমতের দোয়া করো। তোমার দোয়া তাদের সান্ত¡নার কারণ হবে। আল্লাহ সব কিছু শুনেন ও জানেন।’ (সূরা তাওবা-১০৩)
পরিশুদ্ধতা ছাড়াও ওশরে সম্পদের প্রবৃদ্ধি ও পরিবর্ধন হয়। ওশরের একটি নিশ্চিত উপকার হলো- এর মাধ্যমে দরিদ্র ও অভাবীরা আরো বেশি উৎপাদনশীল হতে পারে। তাদের দারিদ্র্যতা ও অভাব দূরীভূত হওয়ার কারণে ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যায়, ফলে নতুন নতুন উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। দেশে অর্থনৈতিক সাইকেল সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া উশর অফুরন্ত পুরস্কার নিয়ে আসে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা ব্যবসায় ও বেচাকেনায় ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ এবং সালাত কায়েম ও জাকাত আদায় থেকে উদাসীন হয় না। তারা সেদিনকে ভয় করতে থাকে যেদিন হৃদয় বিপর্যস্ত ও দৃষ্টি পাথর হয়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।’ (সূরা নূর-৩৭)
বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট অর্থনীতি গবেষক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আদায়যোগ্য ওশরের পরিমাণ হিসাব অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের ১১১টি ফসলের উপাদন, বোরো ধানের সমতুল্য ফসল উৎপাদনে রূপান্তর করে পাওয়া যায় ৮৬,০৮৬,৬১১ মেট্রিক টন। সুতরাং যান্ত্রিক সেচ নির্ভর ফসলের জন্য নির্ধারিত ৫ শতাংশ হারে ওশর হিসাব করলে আদায়যোগ্য ওশরের পরিমাণ হবে ৪,৩০৪,৩৩১ মেট্রিক টন বোরো ধানের সমতুল্য ফসল। অন্যদিকে বৃষ্টি অথবা প্রাকৃতিক সেচনির্ভর ফসলের জন্য নির্ধারিত ১০ শতাংশ হারে আদায়যোগ্য ওশর হবে ৮,৬০৮,৬৬১ মেট্রিক টন বোরো ধানের সমতুল্য ফসল। আমরা যদি সঠিকভাবে ওশর রেকর্ড এবং সংগ্রহ করতে পারি তবে পরিমাণটি প্রাক্কলিত পরিমাণের চেয়েও বেশি হতে পারে। বিভিন্ন ফসলের ওই বছরের বাজার দামের ভিত্তিতে মোট ফসলের মূল্য হয় ১,৭৫৪,৪৪৫,১২৮,৯১৪ টাকা। যান্ত্রিক সেচনির্ভর ফসলের নিয়ম অনুযায়ী ৫ শতাংশ হারে মোট আদায়যোগ্য ওশর হবে ৮৭,৭২২,২৫৬৪৪৫ টাকা। ওশর নির্ণয়ের জন্য নিসাবের হিসাব নিয়ে যদিও মতভেদ রয়েছে তারপরও আমরা যদি নিসাব বাদ দিয়েও ওশর হিসাব করি তাহলে আমরা বিবেচনা করতে পারি যে, দেশের প্রায় অর্ধেক জমি ধনী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন, তাই অর্ধেক ফসল দরিদ্র দ্বারা উৎপাদিত হয়। এ ধনী অর্ধেক লোকের ফসল উৎপাদন নিসাবের ঊর্ধ্বে, যার ওশর প্রদেয়। সুতরাং আমরা যদি ওশর বিবেচনা করি তাহলে ৫ শতাংশ হারে ওশরের মোট পরিমাণ বছরে ৪.২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে, যেখানে ১০ শতাংশ হারে প্রতি বছর ৮.৫ হাজার কোটি টাকা হবে।’
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত ফরজ ইবাদত হলো, ‘ওশর’ বা ফসলের জাকাত। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ ওশর সম্পর্কে সামান্যতম জ্ঞানও রাখেন না। অথচ এই ওশরের মাধ্যমে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও আয় বৈষম্য দূর করা খুবই সহজ। আমাদের আলেম-উলামা, ইসলামী স্কলার, তাদের ওয়াজ মাহফিল, জুমার খুতবায়, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখা জরুরি। যারা বাংলাদেশে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিয়োজিত আছেন, তাদের কাছেও অনুরোধ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ এই ফরজ বিধানটির প্রতি বিশেষভাবে নজর দিন। মানুষ যদি আত্মিকভাবে পবিত্র হয় তাহলে ন্যায় ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা খুব সহজ হবে। ইসলামের অর্থনৈতিক আইনে ওশরের গুরুত্ব এবং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতন করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com