জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের কাজ শুরু
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত শুরু করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের তথ্যানুসন্ধান দল। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে গত সোমবার ঢাকায় আসেন প্রতিনিধিদলের তিন সদস্য। গত মঙ্গলবার তাঁরা অন্তর্র্বতী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে তাঁর দপ্তরে দেখা করেন।
সাক্ষাৎ শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতিসংঘের তদন্ত দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আমরা চাই, তারা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করুক। তারা তদন্তের কাজে কোথাও গেলে, সেখানে যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা বা থাকার ব্যবস্থা করতে হয়, সে রকম লজিস্টিকস সহযোগিতা করতে আমরা রাজি আছি। এটি তাদের বলেছি।’ জাতিসংঘের তথ্যনুসন্ধান মিশন সরকারের কাছে কোনো সহযোগিতা চেয়েছে কি না, প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এখনো তারা সহযোগিতার বিষয়ে কিছু বলেনি। তারা নিজেরাই সবকিছু আয়োজন করতে পারবে বলে মনে করছে। প্রয়োজন হলে তারা জানাবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর গতকাল বুধবার আরও একাধিক বৈঠক করেছেন জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা।
প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল বাংলাদেশে চার সপ্তাহ অবস্থান করবে। তদন্তের জন্য প্রয়োজন হলে আরও কয়েক দিন তাঁরা থাকতে পারেন। জাতিসংঘ ও অন্তর্র্বতী সরকারের একাধিক সূত্র এসব বিষয় প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে। সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, তথ্যানুসন্ধান দলটি গত জুলাই ও আগস্টের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-সহ ১৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করবে। তদন্ত প্রতিবেদন আগামী নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হতে পারে।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না সরকার: ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দলের কাছে তথ্য জমা দেওয়ার আহ্বান: বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময় জুলাই-আগস্টে হওয়া নৃশংসতার তদন্তে ঢাকায় কাজ শুরু করেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল। অন্তর্র্বতী সরকারের চাওয়া তথ্যানুসন্ধান দলটি সম্পর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত করবে। তদন্তের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করবে না সরকার। অন্যদিকে, গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সময়কাল মধ্যে বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য দেওয়ার জন্য সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সংস্থাকে OHCHR-FFTB-Submissions@un.org এই ইমেইলে তথ্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন।
জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলটি পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো.তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন যেটা আসছে তারা তো কাজ শুরু করেনি এখনও। তারা শুরু করবে। সপ্তাহখানেক এখানে (ঢাকায়) কাজ করবে। তারা একটু আসলে প্রচার এড়িয়ে চলতে চায়। কারণ, তারা কাজ শেষ করার আগে এটা নিয়ে কিছু বলতে চায় না। আসলে এটা নিয়ে কথাবার্তা হলে যেটা হবে, তাদের কাজে বিঘœ সৃষ্টি হবে। কোনো কমেন্টস মাঝখানে আসুক তারা চায় না। আমরা চাইছি, একটা সম্পর্ণ নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। আমরা হস্তক্ষেপ করব না। তাদের কোনো সহযোগিতা লাগলে, ধরুন কোন এক জায়গায় গেলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, তাদের থাকার ব্যবস্থা। আমরা সাহায্য করতে রাজি আছি, এটুকু তাদের বলেছি। সহযোতিার বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান দলটি এখনও কিছু জানায়নি উল্লেক করে উপদেষ্টা বলেন, সহযোগিতার বিষয়ে এখনও পযন্ত তারা আমাদের কিছু বলেনি। তারা আসলে অনেক আগে থেকে কিছু বলবেও না। কোনো এক জায়গায় যাবে তখন যাওয়ার জন্য যদি লজিস্টিকের প্রয়োজন হয় সেটা হয়তো চাইবে। কিন্তু তারা হয়তো নিজেরা পারবে বলে মনে করছে। প্রয়োজন হলে আমাদের সাহায্য চাইবে।
ঢাকায় অবস্থিত জাতিসংঘের কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের আমন্ত্রণে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত সাম্প্রতিক বিক্ষোভের কারনে উদ্ভূত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করছে। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং দল, সত্য উদ্ঘাটন, দায় – দায়িত্ব চিহ্নিতকরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল কারণ বিশ্লেষণ এবং অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘন সমূহ ও তাদের পুনরাবৃত্তি রোধে বাংলাদেশের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সময়কাল মধ্যে বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য প্রদানের জন্য সকল ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সংস্থাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দলটি সেই সমস্ত তথ্যের জন্য অনুরোধ করছে, যা বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যাবেনা এবং প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়নি। OHCHR-FFTB-Submissions@un.org এই ইমেইলে তথ্য জমা দিতে হবে। তদন্ত দল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তা, চিকিৎসা পেশাজীবী এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণেরো পরিকল্পনা করেছেন। ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং তদন্তটি কোনো অপরাধ অনুসন্ধান বা আইনি তদন্ত নয়। এটি যেকোনো জাতীয় ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া থেকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত। এই তথ্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি কঠোরভাবে গোপনীয়। তদন্ত চলাকালীন, তদন্ত দলের সদস্যরা কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেবেন না। তারা সকলকে তথ্য অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ করেছেন। ঘটনাস্থলে পরিচালিত পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও উপাত্ত বিশ্লেষণের পর, জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস তদন্তের প্রধান প্রধান ফলাফল, উপসঙহার ও সুপারিশ সহ একটি বিস্তারি মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, জুলাই-আগস্টে হওয়া নৃশংসতার তদন্ত বর্তমানে ঢাকায় রয়েছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দলের পাঁচ সদস্য। আর তিন সদস্য খুব শিগগিরই ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধান দল বাংলাদেশে চার সপ্তাহ অবস্থান করবে। তদন্তের জন্য প্রয়োজনে আরও কয়েকদিন তারা থাকতে পারেন। তথ্যানুসন্ধান দলটি গত জুলাই ও আগস্টের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-সহ ১৫ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের (এর মধ্যে রয়েছে–মানবতাবিরোধী অপরাধ, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক ও বেসরকারি পক্ষগুলোর মাধ্যমে হত্যা ও নির্যাতন, জনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নামে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নিবর্তনমূলক আটক ও গ্রেপ্তার, গুম, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখা, সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি) ঘটনা তদন্ত করবে। তদন্ত প্রতিবেদন আগামী নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশের আগে অন্তর্র্বতী সরকারকে দেওয়া হবে। যেসব জায়গায় বিক্ষোভ, অসন্তোষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সেসব জায়গায় যাবেন তদন্ত করতে যাবেন তথ্যানুসন্ধান দলের সদস্যরা। সাক্ষ্য গ্রহণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের কিছু এলাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের অন্তত আটটি বিভাগীয় ও জেলা শহর নির্বাচন করা হয়েছে।