সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯ অপরাহ্ন

আত্মচরিতের আয়নায় নিজেকে দেখুন

জাফর আহমাদ:
  • আপডেট সময় সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইসলামের একটি আয়না আছে, সে আয়নায় প্রতিদিন প্রতিক্ষণ নিজের চরিতের দাগ, ময়লা ও মেছতা দেখা যায়। কেউ কি তা দেখেন? যারা নিয়মিত চরিতের সৌন্দর্য চর্চা করেন তারা নিয়মিত সে আয়নাটি দেখে থাকেন, ফলে তিনি সেই আয়না ও নিজের চরিতের প্রতি যতœবান হন। দৈনিক আয়নাটিকে মুছে যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন তেমনি সে আয়নায় ভেসে উঠা নিজের চরিতে দৃশ্যমান দাগ, ময়লা ও মেছতা পরিষ্কারেও অত্যন্ত যতœবান হোন। সেই আয়নার নাম ইসলাম। যা বাঁধাই করা হয়েছে আল কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ দিয়ে। যিনি সে আয়নার আলোকে নিজের চরিত্রকে ময়লামুক্ত রাখেন, তার নাম হলো- মুসলিম। যারা আত্মপ্রবঞ্চিত তারা সে আয়নায় ভেসে আসা নিজের ত্রুটিগুলো দেখতে পায় না। শয়তান তার ত্রুটিগুলোকে সুশোভিত আকারে প্রদর্শিত করে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘প্রত্যেক মানুষের ভালো-মন্দ কাজের নিদর্শন আমি তার গলায় ঝুলিয়ে রেখেছি এবং কিয়ামতের দিন তার জন্য বের করব একটি লিখন, যাকে সে খোলা কিতাবের আকারে পাবে। পড়ো, নিজের আমলনামা, আজ নিজের হিসাব করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১৩-১৪) প্রত্যেক মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য এবং তার পরিণতির ভালো ও মন্দের কর্মধারা এবং তার আপন সত্তার মধ্যে বিরাজিত রয়েছে। নিজের গুণাবলি, চরিত্র ও কর্মধারা এবং বাছাই ও নির্বাচন করার এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে সে নিজেই নিজেকে সৌভাগ্যের অধিকারী করে আবার দুর্ভাগ্যের অধিকারী করে। তার আয়নায় যদি সে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে। কিন্তু নির্বোধ ও গাফেল বা উদাসীন লোকেরা নিজেদের ভাগ্যের ভালো-মন্দের চিহ্নগুলো তার আয়নায় না খোঁজে বাইরে খোঁজে বেড়ায় এবং তারা সবসময় বাইরের কার্যকারণকেই নিজেদের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই, তাদের ভালো-মন্দের পরোয়ানা তাদের নিজেদের গলায়ই লটকানো থাকে। আত্মচরিতের আয়নায় ও নিজেদের কার্যক্রমের প্রতি নজর দিলে তারা পরিষ্কার দেখতে পাবে, কোন জিনিসটি তাদের বিকৃতি ও ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিয়েছে এবংং শেষ পর্যন্ত তাদের সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে, তা ছিল তাদের নিজেদেরই অসৎ গুণাবলি ও অশুভ সিদ্ধান্ত। বাইরে থেকে কোনো জিনিস এসে জোরপূর্বক তাদের ওপর চেপে বসেনি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যে ব্যক্তিই সৎপথ অবলম্বন করে, তার সৎপথ অবলম্বন তার নিজের জন্যই কল্যাণকর হয়। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, তার পথভ্রষ্টতার ধ্বংসকারিতা তার ওপরই বর্তায়। কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। আর আমি (হক ও বাতিলের পার্থক্য বোঝার জন্য) একজন পয়গম্বর না পাঠিয়ে দেয়া পর্যন্ত কাউকে আজাব দেই না।’ (সূরা বনি ইসরাইল-১৫)
সৎ ও সত্য-সঠিক পথ গ্রহণ করে সে মূলত আল্লাহ, রাসূল ও সংশোধনপ্রচেষ্টা পরিচালনাকারীদের প্রতি কোনো অনুগ্রহ করে না; বরং সে তার নিজেরই কল্যাণ করে। অনুরূপভাবে ভুল পথ অবলম্বন অথবা তার ওপর থেকে কোনো ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে না; বরং সে তার নিজের ক্ষতি করে। আল্লাহর রাসূল সা: ও সত্যের আহ্বায়করা মানুষকে ভুল পথ থেকে বাঁচানোর এবং সঠিক পথ দেখানোর জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তা নিজের কোনো স্বার্থে নয়; বরং মানবতার কল্যাণার্থেই চালান। বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ হচ্ছে, যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে যখন তার সামনে সত্যের সত্য হওয়া ও মিথ্যার মিথ্যা হওয়া সুস্পষ্ট করে দেয়া হয় তখন সে স্বার্থান্ধতা ও অন্ধ আত্মপ্রীতি পরিহার করে সোজা মিথ্যা থেকে সরে দাঁড়াবে এবং সত্যকে মেনে নেবে। অন্ধ আত্মপ্রীতি, হিংসা ও স্বার্থান্ধতার আশ্রয় নিলে সে নিজেই অশুভাকাক্সক্ষী হবে।
প্রত্যেক ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর সামনে এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যক্তিগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি তার সাথে শরিক নেই। দুনিয়ায় যতই বিপুলসংখ্যক ব্যক্তিবর্গ, বিপুলসংখ্যক জাতি, গোত্র ও বংশ একটি কাজে বা একটি কর্মপদ্ধতি শরিক হোক না কেন, আল্লাহর শেষ আদালতে তাদের এ সমন্বিত কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত দায়িত্ব আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হবে এবং তার যা কিছু শাস্তি বা পুরস্কার সে লাভ করবে তা হবে তার সেই কর্মের প্রতিদান, যা করার জন্য সে নিজে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়ী বলে প্রমাণিত হবে। এ ইনসাফের তুলাদ-ে অন্যের অসৎকর্মের বোঝা একজনের ওপর এবং তার পাপের ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। তাই একজন জ্ঞানী ব্যক্তির উচিত নয় অন্যেরা কি করছে তা দেখা; বরং তিনি নিজে কি করছেন সেদিকেই তার সর্বক্ষণ দৃষ্টি থাকা উচিত। যদি তার মধ্যে নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্বেও সঠিক অনুভূতি থাকে, তাহলে অন্যেরা যাই করুক না কেন সে নিজে সাফল্যের সাথে আল্লাহর সামনে যে কর্মধারার জবাবদিহি করতে পারবে তার ওপরই অবিচল থাকবে।
আখিরাতপ্রত্যাশীরা যে দুনিয়াপূজারীদের অধিকারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী দুনিয়াতেই এ পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ পার্থক্য এ দৃষ্টিতে নয় যে, এদের খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-বাড়ি ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ঠাঁটবাট ও জৌলুশ ওদের চেয়ে বেশি; বরং পার্থক্যটা এখানে যে, এরা যা কিছু পায় সততা, বিশ^স্ততা ও ঈমানদারির সাথে পায় আর ওরা যা কিছু লাভ করে জুলুম, নিপীড়ন, ধোঁকা, বেঈমানি এবং নানান হারাম পথ অবলম্বনের কারণে। তার ওপর আবার এরা যা কিছু পায় ভারসাম্যের সাথে খরচ হয়। এ থেকে হকদারদের হক আদায় হয়। এ থেকে বঞ্চিত ও প্রার্থীদের অংশও দেয়া হয়। আবার এ থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে অন্যান্য সৎ কাজেও অর্থ ব্যয় করা হয়। পক্ষান্তরে দুনিয়া পূজারীরা যা কিছু পায় তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিলাসিতা, বিভিন্ন হারাম এবং নানান ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজে দু’হাতে ব্যয় করা হয়ে থাকে।
এভাবে সব দিক দিয়েই আখিরাত প্রত্যাশীদের জীবন আল্লাহভীতি ও পরিচ্ছন্ন নৈতিকতার এমন আদর্শ হয়ে থাকে যা তালি দেয়া কাপড়ে এবং ঘাস ও খড়ের তৈরি কুঁড়েঘরেও এমনই ঔজ্জ্বল্য বিকীরণ করে, যার ফলে এর মোকাবেলায় প্রত্যেক চক্ষুষ্মানের দৃষ্টিতে দুনিয়া পূজারীদের জীবন অন্ধকার মনে হয়। এ কারণেই বড় বড় পরাক্রমশালী বাদশাহ ও ধনাঢ্য আমিরদের জন্যও তাদের সমগোত্রীয় জনগণের হৃদয়ে কখনো নিখাদ ও সাচ্চা মর্যাদাবোধ এবং ভালোবাসা ও ভক্তির ভাব জাগেনি। অথচ এর বিপরীতে ভক্ত, অনাহারি ছিন্ন বস্ত্রধারী, খেজুর পাতার তৈরি কুঁড়েঘরের অধিবাসী আল্লাহভীরু মর্দে মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে দুনিয়া পূজারীরা নিজেরাই বাধ্য হয়েছে। আখিরাতের চিরস্থায়ী সাফল্য এ দু’দলের মধ্যে কার ভাগে আসবে এ সুস্পষ্ট আলামতগুলো সেই সত্যটির প্রতি পরিষ্কার ইঙ্গিত করছে।
আত্মচরিতের আয়নাকে পরিষ্কার রাখার জন্য নিচের বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষভাবে যতœবান হতে হবে। প্রথমত, বেশি বেশি কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করতে হবে এবং এই অধ্যয়ন বুঝে অর্থ অনুধাবন করে পড়তে হবে। আল্লাহর রহমত, বরকত ও আত্মার আনন্দের জন্য মানুষের প্রতি কল্যাণ ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। হৃদয়কে বিদ্বেষ, হিংসা ও অন্যের অকল্যাণ কামনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ধৈর্য মুমিন চরিতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও ঈমানের অন্যতম অংশ। আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ্য যাবে না। হতাশা ও উৎকণ্ঠা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে দিতে হবে। আল্লাহ আমাদের জীবনে অগণিত নিয়ামত রয়েছে। তাই সদা তার কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, সম্মান ও অসম্মান সর্বাবস্থায় স্থিতিশীল থাকতে হবে। মানুষের সাথে সুন্দর ও উত্তম আচরণ করতে হবে। এটি প্রকৃত মুসলিমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সবার সাথে উত্তম ও শোভনীয় আচরণ করা আল্লাহর প্রিয় ইবাদাতগুলোর অন্যতম। কিয়ামতের দিন কর্মবিচারের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী ও মূল্যবান কর্ম হবে সুন্দর আচরণ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-কে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-কে অন্য সব কিছু এবং নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ক্রমাগত জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। এই ভালোবাসা দ্বারা আত্মার খোরাক সৃষ্টি হয়, আত্মা সর্বদা পুষ্ট ও সতেজ থাকে। জেনে বুঝে মনের আবেগ মিশিয়ে সকাল-সন্ধা ছাড়াও সার্বক্ষণিক আল্লাহর জিকির তথা আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। এটি আত্মার বিশাল খাদ্যভা-ার। আত্মা সুস্থ ও সবল রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ সা:-এর সুন্নাহ মোতাবেক নিজেকে আল্লাহর জিকিরে রত রাখতে হবে।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com