শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯ পূর্বাহ্ন

মিথ্যা কথা, মিথ্যুক ও মিথ্যা অভিযোগকারীর শাস্তি

শাহাদাত হোসাইন
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪

মিথ্যা কথা, মিথ্যুক ও মিথ্যা অভিযোগকারী সবাই অভিশপ্ত ও ঘৃণিত। মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা কথার থেকেও গুরুতর। মিথ্যার যত রূপ সবই ঘৃণিত। তাই যেকোনো প্রকারের মিথ্যা পরিত্যাজ্য। একটি মিথ্যা অনেক মিথ্যার রাস্তা খুলে দেয়। একটি মিথ্যাকে সত্য রূপে প্রমাণ করতে আরো অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। এটি বাহুল্য নয় যে, মিথ্যা সব পাপের সোপান, যা পাপের সিঁড়িকে উন্মোচিত করে, যা চলন্ত সিঁড়ির মতো চলতে থাকে অবিরাম।
মোমেন কখনো মিথ্যুক হতে পারে না: মিথ্যা বলা এমন একটি খারাপ স্বভাব যা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সব দুর্নীতি আর দুরাচারকে সামনে আনে। নবীজী মিথ্যা বলাকে যতটা ঘৃণা করতেন অন্য কিছুকে ততটা ঘৃণা করতেন না। তিনি কোনো ব্যক্তির মিথ্যা বলা সম্পর্কে জানতে পারলে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। তবে সে যদি তার মিথ্যার ব্যাপারে তওবা করত, তাহলেই তিনি স্বাভাবিক হতেন (শুয়াবুল ঈমান-৪৪৭৫)। একজন মোমেন কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। নবীজী সা: বলেছেন, ‘একজন মুমিনের ভেতরে অনেক ধরনের ত্রুটিই থাকতে পারে কিন্তু কোনোভাবেই সে মিথ্যুক ও অসৎ হতে পারে না’ (আহমাদ-২২১৭০)। সাফওয়ান ইবনে সুলাইম বলেন, একবার নবীজীকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! মোমেন কি ভীতু হতে পারে? নবীজী বললেন, ‘হ্যাঁ’। আবার বলা হলো, মোমেন কি কৃপণ হতে পারে? নবীজী বললেন, ‘হ্যাঁ’। পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলো, মোমেন কি মিথ্যুক হতে পারে? নবীজী বললেন, ‘না, মোমেন কখনো মিথু্যুক হতে পারে না’ (তাম্বিহুল গাফিলিন-১৯৯)।
সন্তান প্রতিপালনে মিথ্যার আশ্রয় নয়:ইসলাম স্বচ্ছ-সফেদ নিষ্কলুষ জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে শতভাগ সততায় গুরুত্বারোপ করা হয়। অঙ্কুরেই সন্তানদেরকে সততার সফেদ চাদরে মুড়িয়ে নেয়ার দীক্ষা দেন। সন্তান প্রতিপালনে মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার প্রশ্রয় দেয় না। সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আমের বলেন, ‘একদিনের ঘটনা। নবীজী আমাদের বাড়িতে ছিলেন। এমতাবস্থায় মা আমাকে ডাকলেন এবং বললেন আসো তোমাকে একটি জিনিস দেবো। তখন নবীজী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি আসলেই কিছু দেবে? মা বললেন, আমি তাকে খেজুর দেবো। এবার নবীজী বললেন, যদি তুমি তাকে সেটি না দিতে তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা লেখা হতো’ (আবু দাউদ-৪৯৯১)। মিথ্যা ও ধোঁকাপূর্ণ কথায় শিশুর কচি হৃদয়ে রেখাপাত করে এবং মিথ্যা বলাকে স্বাভাবিক মনে করতে থাকে। যার ফলাফল তার আগামী জীবনে পরিস্ফুটিত হয়।
ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা নয়: রসিকতা কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা আমাদের প্যাশনে পরিণত হয়েছে। অথচ তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইবনে মাসউদ রা: বলেছেন, ‘রসিকতা কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে মিথ্যা বলা বৈধ নয়’ (আজ-জুহদ-৩৯৫)। নবীজীর রসিকতায়ও পূর্ণ সততা থাকত। তিনি সেসব স্থান ও আয়োজন পরিহার করতে বলেছেন, যেখানে মিথ্যার চর্চা হয়। বর্তমান সমাজে কিছু কিছু আয়োজন এমন আছে, যেখানে মিথ্যাকে আর্ট হিসেবে পেশ করা হয়। সুন্দর উপস্থাপনের মাধ্যমে শ্রুতিমধুর করে মিথ্যাকে পরিবেশন করা হয়। শ্রোতারাও তা নির্দ্বিধায় গলাধঃকরণ করে। যা অত্যন্ত গর্হিত এবং পরিত্যাজ্য বিষয়। নবীজী বলেছেন, ‘সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস যে মানুষ হাসানোর জন্য (কৌতুক) মিথ্যা বলে’ (তিরমিজি-২৩১৫)।
প্রশংসায় অতিরঞ্জনকারীর মুখে ধুলো মারো: ব্যক্তির যোগ্যতানুসারে প্রশংসা করা ইসলামে বৈধ। তবে প্রশংসা করার ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন করা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। নিষিদ্ধ বিষয়। তাই চাটুকারিতা করতে গিয়ে মিথ্যা থেকে বিরত থাকা চাই। আবার যে গুণ নিজের ভেতর নেই সেই গুণের প্রশংসা শুনে খুশি হওয়া অনুচিত। আহাম্মকের পরিচয়। যারা আল্লাহয় বিশ্বাস রাখে এমন প্রশংসায় তাদের বাধা দেয়া উচিত। নবীজী সা: বলেছেন, ‘যারা প্রশংসায় অতিরঞ্জন করে, তোমরা তাদের মুখে ধুলো ছুড়ে মারো’ (আবু দাউদ-৪৮০৪)।
মিথ্যা অপবাদ ধ্বংস আনে: অপবাদ আরোপ কুরআনে বর্ণিত এক জঘন্য অপরাধের নাম। অপবাদ সাধারণ মিথ্যার থেকেও জঘন্য। এতে বান্দার অধিকার ক্ষুণœ হয়। সমাজব্যবস্থা ধ্বংস হয়। অরাজকতার সৃষ্টি হয়। মানুষ পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা হারায়। স¤পর্ক ছিন্ন হয়। অপবাদ প্রদানকারীকে কুরআন অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছে। এর দ্বারা ব্যক্তি অন্যের সম্মানহানির পাশাপাশি নিজেকে কবিরা গোনাহে লিপ্ত করে, যা কোনো ক্ষেত্রেই কল্যাণকর নয়। আমাদের সমাজে অপবাদের নানান ধরন প্রচলিত আছে। যেগুলো প্রত্যেকটি জঘন্য থেকে জঘন্যতর। আমাদের উচিত সেগুলো থেকে বিরত থাকা।
চারিত্রিক অপবাদ আরোপের শাস্তি দুনিয়াতেই: চারিত্রিক অপবাদ একটি মারাত্মক অপরাধ। এতে ব্যক্তির সম্মানহানি করা হয়। সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। অপবাদ প্রদানকারীরা হয়তো সেটিকে হালকা মনে করেন কিন্তু বিষয়টি আসলেই গুরুতর। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘যখন তোমরা মুখে মুখে ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় উচ্চারণ করছিলে, যার কোনো জ্ঞান তোমাদের ছিল না। তোমরা একে তুচ্ছ মনে করেছিলে, অথচ এটা আল্লাহর কাছে গুরুতর অপরাধ’ (সূরা নূর-১৫)। কোনো বিষয়ের প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া শুধু অনুমানের ভিত্তিতে বলা চূড়ান্ত অপরাধ ও গোনাহের কাজ। এমন ধারণাপ্রসূত অপবাদ আরোপ থেকে বিরত থাকা উচিত। কুরআনে এসেছে- ‘হে ঈমানদারেরা তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাকো, নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা গোনাহ’ (সূরা হুজরাত-১২)। নয়তো, দুনিয়াতেই ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
কুরআনে এসেছে- ‘যারা সতী-সাধ্বী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর সপক্ষে চারজন পুরুষ সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদের ৮০টি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ করবে না। এরাই নাফরমান’ (সূরা নূর-৪)।
রাজনৈতিক অপবাদ জাহান্নামের শাস্তির কারণ: রাজনৈতিকভাবে ব্যক্তিকে হেরাস করার জন্য মিথ্যা অপবাদের আশ্রয় নেয়া কিংবা হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থে অপবাদ আরোপ করা একটি জঘন্য অপরাধ। রাজনীতির বিষয়াদিকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা উচিত। কাউকে ঘায়েল করার জন্য মিথ্যা অপবাদ আরোপ করা। চারিত্রিক কালিমা লেপন করা। স্পষ্ট অন্যায় ও জুলুম। মিথ্যা অপবাদে ব্যক্তিকে জেলহাজতে রাখা। জনতার সামনে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা। কুটিল ও অসৎ লোকের কাজ। আখিরাতে এদের কোনো অংশ থাকবে না। এরা সে দিন রিক্ত হস্তে উত্থিত হবে। জুলুম, অত্যাচার এবং ব্যক্তির অধিকার হরণের অপরাধে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। মিথ্যার স্বাদ আস্বাদন করবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানে বিরত থাকা উচিত: মিথ্যা সাক্ষ্যদান বর্তমান সমাজে ক্যান্সার ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি বিচারিক কার্যালয়েও মিথ্যা সাক্ষ্যের ছড়াছড়ি। অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে রায়ও হয় এবং ব্যক্তিকে সাজা ভোগ করতে হয়। এর থেকে বড় জুলুম কী হতে পারে? যে সমাজে মিথ্যা সাক্ষ্য দেখা দেয়, সেই সমাজে ন্যায়, ইনসাফ থাকে না। হিংসা-বিদ্বেষ লেগে থাকে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা উবে যায়। আমাদের ঠোঁট ও জবান আল্লাহর দান। আল্লাহ বলেন- ‘(আমি তাদেরকে) জিহ্বা ও দুই ঠোঁট দিয়েছি’ (সূরা বালাদ-৯)। এগুলো দিয়েছেন সত্য কথা বলতে। সত্য সাক্ষ্য দিতে। যদিও তা নিজের কিংবা মা-বাবার বিরুদ্ধে যায়। কুরআনে এসেছে- ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা মা-বাবার অথবা নিকটাত্মীয়র যদি ক্ষতি হয় তবুও’ (সূরা নিসা-১৩৫)।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানের কুফল: মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া কবিরা গোনাহ। নবীজী সা:কে কবিরাহ গোনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া, হত্যা করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া।’ মিথ্যা সাক্ষ্যদান শিরকের সমতুল্য অপরাধ। ইবনে মাসউদ রা: মিথ্যা সাক্ষ্যকে শিরকের সাথে তুলনা করে, সূরা হজের ৩০-৩১ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করেন- ‘অতএব, তোমরা বিরত থাকো মূর্তির নাপাকি থেকে এবং বিরত থাকো মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া থেকে, আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে। তাঁর সাথে শিরক করা ব্যতীত। মিথ্যা সাক্ষ্যদান গর্হিত জুলুম। আর জুলুমের পরিণাম খুবই ভয়াবহ।’ নবীজী সা: বলেছেন, ‘অত্যাচারী ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অন্ধকারে থাকবে’ (মুসলিম-২৫৭৮)। মিথ্যা সাক্ষ্যদানে অন্যের অধিকার নষ্ট হয়। যেই ব্যক্তির অধিকার নষ্ট করা হবে, কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির অনুমোদন ছাড়া আল্লাহও অপরাধীকে ক্ষমা করবেন না। সর্বোপরি মিথ্যা সাক্ষীর কারণে ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। যার থেকে বড় দুঃখ ও কষ্টের কিছু হতে পারে না। লেখক : খতিব, বায়তুল আজিম জামে মসজিদ, রংপুর




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com