হোক সে কাফের বা মুসলমান, কোনো মানুষ অন্য মানুষকে কিংবা এক মুসলমান অপর মুসলমানকে কষ্ট দিতে পারে না। কারণ কষ্ট দেয়ার পরিণতি ভয়াবহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর যে ব্যক্তি কোনো অন্যায় বা গোনাহের কাজ করে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির ওপর তার দোষ চাপিয়ে দেয়, সে তো বড় মারাত্মক মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহের বোঝা নিজের মাথায় তুলে নেয়।’ (সূরা নিসা-১১২) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘আর যারা মুমিন পুরুষ ও মহিলাদেরকে কোনো অপরাধ ছাড়াই কষ্ট দেয় তারা একটি বড় অপবাদ ও সুস্পষ্ট গোনাহের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে।’ (সূরা আহজাব-৫৮)
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তার অভাব পূরণ করবেন। যে কেউ তার মুসলিম ভাইয়ের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ ঢেকে রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (বুখারি-২৪৪২, ৬৯৫১)
হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: যখন মু’আয রা:-কে ইয়েমেনে পাঠান এবং তাকে বলেন, মাজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা, তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহ মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।’ (বুখারি-২৪৪৮)
হজরত ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: মিম্বরে উঠে চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘হে ওই জামাত, যারা মুখে ইসলাম কবুল করেছে কিন্তু অন্তরে এখনো ঈমান মজবুত হয়নি। তোমরা মুসলিমদের কষ্ট দেবে না, তাদের লজ্জা দেবে না এবং তাদের গোপন দোষ অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হবে না। কেননা, যে লোক তার মুসলিম ভাইয়ের গোপন দোষ অনুসন্ধানে নিয়োজিত হবে আল্লাহ তায়ালা তার গোপন দোষ প্রকাশ করে দেবেন। আর যে ব্যক্তির দোষ আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ করে দেবেন তাকে অপদস্ত করে ছাড়বেন, সে তার উটের হাওদার ভেতরে অবস্থান করে থাকলেও।’ বর্ণনাকারী (রাবি) বলেন, ‘একদিন ইবনে ওমর রা: কাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কতই না ব্যাপক ও বিরাট! তুমি কতই না সম্মানিত কিন্তু তোমার চেয়েও মুমিনের সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহর কাছে অনেক বেশি।’ (তিরমিজি-২০৩২)
মানুষকে প্রধানত কথা ও কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেয়া হয়ে থাকে। কথার মাধ্যমে কষ্ট দেয়া বলতে বিভিন্ন ভাষায় গালি-গালাজ করা, গিবত করা, কাউকে মন্দ নামে ডাকা, তোহমত (অপবাদ) আরোপ করা, খোঁটা দেয়া, তুচ্ছজ্ঞান বা হেয় প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি। আর কাজের মাধ্যমে কষ্ট দেয়া বলতে জুলুম করা, নিজের উন্নতির জন্য অন্যায় আচরণ করা, কাউকে অসম্মানিত করার নিমিত্তে মিথ্যা দোষারোপ করা, ক্ষমতার অপব্যবহার করা, অধিক মুনাফা লাভের আশায় মালামাল আটকে রেখে মানুষকে কষ্ট দেয়া, লুটপাট করা, লুটপাটে সহযোগিতা করা, ধোঁকা-প্রতারণা করা, চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া, অন্যায়ভাবে সম্পদ জবরদখল করা ও অন্যায় হত্যাকা- ঘটানো ইত্যাদি। দুটোকেই আল্লাহর রাসূল সা: মুসলিম হওয়া না হওয়ার মানদ- আরোপ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলিমরা নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জানমালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন।’ (তিরমিজি-২৬২৭)
প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি যার মুখ থেকে সবসময় কল্যাণের বাণী বের হয়, যার কথা শ্রুতিমধুর ও আচরণ উত্তম। তার মুখ থেকে কখনো অকল্যাণ ও ফাহেশা (অশ্লীল) কথা বের হয় না। তিনি কাউকে গালিগালাজ করেন না, কাউকে অভিশাপ দেন না, কারো গিবত করেন না। মানুষের মধ্যে ঝগড়া-ফাসাদ সৃষ্টি করার মতো কোনো কথা বলেন না। সবাই তার হাত থেকে নিরাপদ থাকে। তিনি কারো ওপর সীমালঙ্ঘন করেন না, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ হরণ করেন না। মানুষের কষ্ট হয় বা মানুষের অকল্যাণ বয়ে আনে এ ধরনের সব কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। হাদিসের পরিভাষায় তিনিই সত্যিকারের মুসলিম। কর্কশ, কপটতা ও কদর্য থেকে মুক্ত।
আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত- এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক মহিলা বেশি বেশি (নফল) সালাত পড়ে, সিয়াম রাখে ও দান-খয়রাত করে বলে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু সে নিজ জিভ দ্বারা (অসভ্য কথা বলে বা গালি দিয়ে বা অসদ্ব্যবহারে) প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। (তার ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?) তিনি বললেন, ‘সে দোজখে যাবে’। লোকটি আবার বলল, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক মহিলা অল্প (নফল) সালাত পড়ে সিয়াম রাখে ও দান-খয়রাত করে বলে উল্লেখ করা হয়; কিন্তু নিজ জিভ দ্বারা (অসদ্ব্যবহারে বা গালি দিয়ে) প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। (তার ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?) তিনি বললেন, ‘সে জান্নাতে যাবে’। (আহমাদ-৯৭৭৫, সহিহ ইবনে হিব্বান-৫৭৬৪, হাকেম-৭৩০৫, আত তারগিব-২৫৬০।
কড়া ও কটু ভাষায় কথা বলা, গলার আওয়াজ উচ্চ হওয়া যা শ্রুতিকষ্টের কারণ হয়, মানুষ তটস্থ থাকে, মানুষ তার থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। ইসলাম এটিকে নিষেধ করেছে। এদেরকে গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নিচু করো। সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।’ (সূরা লোকমান-১৯) এ আয়াতে মূলত কথার ভাব-ভঙ্গিমা ও আওয়াজের ধরনের কথা বলা হয়েছে। ভঙ্গি ও আওয়াজের এ ধরনের নি¤œগামিতা ও উচ্চগামিতা এবং কঠোরতা ও কোমলতা হয়ে থাকে স্বাভাবিক ও প্রকৃতির প্রয়োজনের খাতিরে। কিন্তু যাদের চরিত্রে ও স্বভাবে এই বৈশিষ্ট্য মজ্জাগত, তাদেরকে তা পরিহার করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রয়োজনের খাতিরে উঁচু-নিচু স্বরে কথা বলা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিন্তু আপত্তিকর বিষয়টি হচ্ছে অহঙ্কার, অবস্থান, দাপট, ক্ষমতা ও শক্তির প্রকাশ, ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যকে অপমানিত ও সন্ত্রস্ত করার জন্য গলা ফাটিয়ে গাধার মতো বিকট স্বরে কথা না বলে নিজের আওয়াজ নিচু করতে বলা হয়েছে।
কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করলে বা হেয় জ্ঞান করলে মানুষ খুবই কষ্ট পায়। এ কাজ করতে রাসূল সা: নিষেধ করেছেন এবং এর অশুভ পরিণতির বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমের ওপর অবিচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং অবজ্ঞা করবে না। আল্লাহভীতি এখানে! এ কথা বলে তিনি নিজের বক্ষের দিকে তিনবার ইঙ্গিত বললেন, একজন মানুষের জন্য এতটুকু অন্যায় যথেষ্ট যে, সে নিজের মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করবে। মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের রক্ত, ধন-সম্পদ ও মান-সম্মান হারাম।’ (মিশকাত-৪৯৫৯, মুসলিম-২৫৬৪, আহমাদ-৭৭২৭)
যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মানুষকে কষ্ট দেয়, ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কে রাখে, মহান আল্লাহ তাকে আখিরাতের শাস্তি ছাড়াও দুনিয়াতেই অশান্তি দেবেন। মানুষকে দুনিয়ায় প্রেরণই করা হয়েছে মানবতার কলাণের জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে।’ (সূরা আল ইমরান-১১০) সুতরাং এমন কোনো কথা বা কাজ করা যাবে না যাতে মানুষকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়। যাতে মানুষের জীবনে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই বেশি হয়, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। এটিই একটি কল্যাণকর জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। যারা মানুষের অকল্যাণে নিয়োজিত থাকে তারা তাদের সৃষ্টির সার্থকতাই ভুলে যায়।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা দয়ালুদের ওপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন, যারা জমিনে বসবাসকারীদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া রহমান হতে উদগত। যে লোক দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে আল্লাহ তায়ালাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজায় রাখেন। যে লোক দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহ তায়ালাও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন।’ (তিরমিজি-১৯২৪)
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক