দু’দিন আগে নয়াদিল্লি ও লন্ডন সূত্রে খবর বেরিয়েছে তৃতীয় দেশে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান কিংবা রাজনৈতিক জীবন বাঁচাতে বিদেশ ভ্রমণে শেখ হাসিনাকে ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ দিয়েছে ভারত। চাঞ্চল্যকর রিপোর্টটি করেছিলো ঢাকার প্রতিষ্ঠিত একটি মিডিয়া। দিল্লির সাউথ ব্লক আজ অবধি সেই তথ্যের সত্যতা স্বীকার বা অস্বীকার করেনি। চুপ ছিলো ঢাকাও। ‘পূজার ছুটি চলছে’ বলে শনিবার বিকাল অবধি মানবজমিনের কোয়েরি এড়িয়ে যান সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীলরা। তাছাড়া সচিব যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকায় ‘যা বলার উপদেষ্টা বলবেন’ বলেও জানান তারা। এ কারণে দেশের গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা মুখিয়ে ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রতি। অবশেষ নরসিংদীর ঐতিহ্যবাহী সেবা সংঘ পূজাম-প পরিদর্শন শেষে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মুখোমুখি হতে সক্ষম হন স্থানীয় সাংবাদিকরা।
প্রশ্ন মূলত একটাই-শেখ হাসিনাকে ভারতের ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ দেয়ার খবর সত্য কি-না? সম্পূরক জিজ্ঞাসা, এতে ঢাকা-দিল্লি বহুমাত্রিক সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি? প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোনোরকম চেষ্টা না করেই জবাব দেন পোড় খাওয়া কূটনীতিক তৌহিদ হোসেন, তবে খানিকটা ডিপ্লোম্যাটিক্যালি। বলেন, ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট যেকোনো দেশ যেকোনো ব্যক্তিকেই ইস্যু করতে পারে। আমাদের তা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। তবে কোনো মামলায় যদি তাকে (শেখ হাসিনা) আদালত হাজির করতে নির্দেশ দেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তাকে ফেরানোর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ দেয়ায় দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট বা অবনতির আশঙ্কা এ সময় নাকচ করেন অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা মিস্টার হোসেন।
৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে তিনি নয়াদিল্লিতেই রয়েছেন বলে তথ্য পাচ্ছে সরকার। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধানমন্ত্রী বলে পাওয়া শেখ হাসিনার কূটনীতিক পাসপোর্ট রিভোক বা বাতিল ঘোষণা করে। ফলে দিল্লিতে তার অবস্থা কিংবা অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে একমাত্র বিকল্প হচ্ছে ভারতের ট্রাভেল ডকুমেন্ট ইস্যু করা। যাতে ভারতসহ অন্য দেশের ভিসা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্টে দিল্লির আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনা ভারত ছেড়ে যেতে পারেন মর্মে ক’দিন আগে ব্রেকিং রিপোর্ট করে মানবজমিন। এরপর তার অন্যত্র যাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরমধ্যে গত বুধবার তার অনুকূলে ভারত সরকারের ট্রাভেল ডকুমেন্ট ইস্যু করেছে মর্মে তথ্য পান লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক বাংলা ট্রিবিউন প্রতিনিধি মুনজের আহমদ চৌধুরী। তথ্যটি নয়াদিল্লিতে যাচাই করেন খ্যাতিমান সাংবাদিক রঞ্জন বসু। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা পরিবারের ঘনিষ্ঠ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার বরাতে রিপোর্টে জানানো হয়, শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার যে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে তাতে ভিসা নিয়ে তিনি বিশ্বের যেকোনো দেশে যেতে পারবেন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা শনিবার কোনো রাখঢাক না করেই বলেন, ভারত বা যেকোনো দেশ যে কারও অনুকূলে ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ ইস্যু করতেই পারে। এটা ঠেকানোর কেনো উপায় আমাদের হাতে নেই। ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের কিছু বিষয়ে অস্বস্তি ছিল, সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমাদের মধ্যে বিদ্যমান যে সম্পর্ক আছে, সেটা বজায় থাকবে। তিনি বলেন, সম্পর্ক উন্নয়ন উভয়ের স্বার্থেই হতে হবে। ভারতের যেমন আমাদের দরকার, তেমনি আমাদেরকেও ভারতের দরকার।’
হাসিনার ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ প্রশ্নে বিশ্লেষকদের অনুমান এবং…
ঢাকায় হাইকমিশনারের গুরু দায়িত্ব পালন করে যাওয়া ভারতের শীর্ষ এক কূটনীতিক বলছিলেন, ‘ভারত যদি শেখ হাসিনাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট সত্যিই দিয়ে থাকে, আমি তাতে এতটুকুও অবাক হবো না। কারণ এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত পদক্ষেপ।’ তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যে কয়েক লাখ তিব্বতি শরণার্থী থাকেন, তাদের বেশিরভাগ ভারতের পাসপোর্টধারী নন। বরং এই ধরনের ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ (সংক্ষেপে যেটাকে বলে ‘টিডি’) নিয়েই তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সফর করেন। টিডি কোনো পাসপোর্ট নয়, বরং ভারত সরকারের জারি করা একটি বিশেষ ধরনের ‘পরিচয়পত্র’; যা দিয়ে বিদেশ সফর করা যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এতে ভিসা দিয়ে থাকে। এর পোশাকি নাম হলো- ‘আইডেন্টিটি সার্টিফিকেট’ বা আইসি। ভারতের সাধারণ পাসপোর্ট গাঢ় নীল রঙের হলেও আইসি সাধারণত হলুদ রঙের একটি বুকলেটের আকারে জারি করা হয়। তিব্বতি ধর্মগুরু চতুর্দশ দালাই লামা– যিনি ১৯৫৯ সালে চীনের চোখ এড়িয়ে ভারতে পালিয়ে আসেন এবং দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। তিনিও এ ধরনের একটি ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ বা আইসি নিয়েই সারা পৃথিবী চষে বেড়ান। ভারতের পাসপোর্ট নেয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি গ্রহণ করেননি। দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের যে তিব্বতিদের ভারতের মাটিতে জন্ম, তারাও জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হওয়ার অধিকারী। কিন্তু তাদেরও বেশিরভাগকে পাসপোর্টের বদলে ‘টিডি’ বা ‘আইসি’ দিয়েছে ভারত। তারা এটা নিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করছেন। ভারতের সাবেক ওই কূটনীতিক এ-ও বলছিলেন, ‘জানি না শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় (পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম) দেবে কি-না। কিন্তু গত দুই মাসের ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে গড়িয়েছে, তাতে দালাই লামার ঘটনার সঙ্গে আমি কিন্তু শেখ হাসিনার কেসের অনেক মিল পাচ্ছি। ভারতে যতদিনই থাকুন, শেখ হাসিনা হাত গুটিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবেন, এটা তো আর হতে পারে না। দালাই লামাও তাই করেছেন, রাজনীতি ও কূটনীতি চালিয়ে গেছেন এবং পৃথিবীর বহু দেশে সফর করেছেন। একইভাবে রাজনৈতিক প্রয়োজনে, বিশ্বময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে শেখ হাসিনাকেও ভারতের বাইরে যেতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেই বাস্তবতা অনুধাবন করে ভারত যদি তাকে ‘টিডি’ বা ‘আইসি’ দিয়ে থাকে, সেটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই’।
হাসিনাকে আমিরাতের প্রত্যাখ্যান
ওদিকে বিভিন্ন সূত্রে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে- ৫ই আগস্ট পদত্যাগের পর অব্যাহত কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কমফোর্ট জোন হিসেবে ভারতেই অস্থায়ী আশ্রয় খুঁজছেন। সেই সঙ্গে বিকল্প হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমিরাত তাকে গ্রহণ করেনি। একটি সূত্রের দাবি, এরইমধ্যে আমিরাতে প্রবেশের এক দফা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি! তাকে নাকি বিমানবন্দরেই ১৭ ঘণ্টা অবরুদ্ধ অবস্থায় কাটাতে হয়েছে! রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিদেশে শেখ হাসিনার আশ্রয় পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা এটাই ইঙ্গিত করে যে, আন্তর্জাতিক মহলে তার বিকল্প সুযোগ হ্রাস পাচ্ছে।
ওদিকে অন্য সূত্রের খবর, কিছু শর্তে দিল্লিতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। যদিও তার ঐতিহাসিক মিত্র ভারত। যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তি শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানে নাখোশ। এটি দিল্লির ওপর প্রচ্ছন্ন চাপ। স্মরণ করা যায়, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে যে দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে হাসিনাকে ফেরানোর চেষ্টা করা হবে। ততদিন তিনি ভারতে থাকলে বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েন হবেই। উল্লেখ্য, আমিরাতের আগে বৃটেনে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তারাও তাকে গ্রহণে রাজি হয়নি।