করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাটসহ প্রায় সবকিছুই এখন বন্ধ। এতে মুখ থুবড়ে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষের আয়-রোজগারের পথ। বিপাকে পড়েছেন রংপুরের ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরাও। ফুল বিক্রির মৌসুমে দোকানপাট বন্ধ থাকায় প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।
দুই সপ্তাহ আগেও সূর্য ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠতেন ফুল চাষি সাজু আহমেদ। ছুটে যেতেন বাগানে। নিবিড় পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকতেন। কাঁচি চালাতেন ফুলের ডালে ডালে। এখন আর ব্যস্ততা নেই। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। নেই ভোর বেলা জেগে ওঠার তাড়া। ব্যবসায়ীরা আসছেন না ফুল কিনতে। দিন শেষে ফুলে ভরা বাগানের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছেন কেবল। কষছেন লোকসানের অঙ্ক আর প্রার্থনা করোনা মুক্তির।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের কোল ঘেঁষে উত্তর হাজিরহাট মুচির মোড়। এই এলাকা থেকে গ্রামের একটু ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে নানা ধরনের ফুল বাগান। বিশাল মাঠে গোলাপের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে ফুল কিনতে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আসতেন এই এলাকাতে।
উত্তম হাজিরহাট মুচির মোড় এলাকার ফুল চাষি সাজুর মতো রংপুরসহ আশপাশের জেলার চাষিরাও এখন ফুল ভরা বাগান নিয়ে চিন্তিত। তাদের সঙ্গে বাগান নির্ভর শ্রমিকরাও বিপাকে পড়েছেন। হাত গুটিয়ে থাকলেও দুশ্চিন্তায় কারো অলস সময় কাটছে না। বরং দিনকে দিন চাষি, পাইকার আর ব্যবসায়ীর লোকসান বাড়ছে।
স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এখানকার বাগান মালিকরা ফুল পাঠাতেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। রংপুরের বাহিরে বড় শহরে ট্রাক-পিকআপ ও ভ্যান ভরে ফুল যেত। কিন্তু এখন ভিন্ন চিত্র ফুলের এই গ্রামে। পরিবহন ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় ভালোবাসার ফুল এখন অনাদরে ঝরছে। ফুলের ভ্রমর গুনগুন করলেও কেনাবেচা নেই। নেই আগের মতো কদর। ফুল হয়েছে এখন গো-খাদ্য।
একই এলাকার ফুল বাগান মালিক ও ব্যবসায়ী আবু সাঈদ। যার ফুলের দোকান রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। সিলেটের বিয়ানী বাজারেও দুটি দোকান রয়েছে। সপ্তাহে তিন রংপুর থেকে সেখানে ফুল পাঠানো হতো। এখন সাঈদ দোকান বন্ধ রেখে রংপুরে এসেছেন। বিকেল বেলা বাগান ঘুরে অলস সময় কাটছে তার।
আবু সাঈদ জানান, তিনি এ বছর প্রায় ৭ একর জমিতে গোলাপ, জবা, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাস, দেশি বেলিসহ সময় উপযোগী নানা জাতের ফুল চাষ করেছেন। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসা বন্ধ থাকায় গাছের ফুল কেটে ফেলে দিচ্ছেন তিনি।
সাঈদের নার্সারির তত্ত্বাবধায়ক রহমত উল্লাহ্ জানান, করোনাভাইরাস ফুল চাষিদের স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। ১৭ দিন ধরে বাগানের ফুল বেচাকেনা বন্ধ। বাগানেই পচে নষ্ট হচ্ছে। এখন তো বিয়ে, জন্মদিন, গায়ে হলুদসহ সকল জাতীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ। কারো ফুলের প্রয়োজন নেই। এ কারণে ব্যবসা নেই। কিন্তু এভাবে চললেও তো জমানো টাকা ফুরিয়ে গেলে পথে বসতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ফুল ব্যবসায়ী ফিরোজ শাহ্। রংপুরের ফুল ব্যবসায়ী সমিতির এই নেতা জানান, ‘বছরের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ফুল বিক্রি হয়ে থাকে। এই সময়টাতে প্রতি মাসে রংপুরের স্থানীয় বাজারে প্রতিদিন লাখ টাকার ফুল বেচাকেনা হয়। বিশেষ দিনগুলোতে তা ১০ লাখও ছাড়ায়। আর রংপুরসহ আশপাশের জেলাতে প্রতি মাসে অন্তত অর্ধ কোটি টাকার বেশি ফুল বেচা-কেনা হয়।’
এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, সরকারি বিধি-নিষেধে সবকিছু বন্ধ থাকায় দিশেহারা পথিকের মতো দিন কাটাচ্ছেন ফুল চাষি, বাগান মালিক, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে ব্যবসার পর আর তেমন বিক্রি হয়নি। আর এ লোকসানের অঙ্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা এখনই বলা মুশকিল।