আমাদের এ দ্বীনের জন্য আল্লাহ পাকের নির্ণীত, নির্ধারিত বিধি হলো, এর জন্য অব্যাহতভাবে জীবন্ত ব্যক্তিত্ব জন্মলাভ করতে থাকবে। কোনো গাছ সুফলা না হলে, তাতে নতুন নতুন পাতা-পল্লব অঙ্কুরিত না হলে আর ফুল-কলি না ফুটলে তাকে জীবন্ত ও সজীব শ্যামল মনে করা হয় না। আমাদের এ দ্বীনও জীবন্ত! জীবন্তদের জন্যই তা মনোনীত এবং জীবন্তদের অস্তিত্ব তার জন্য অপরিহার্য। আধ্যাত্মিকতার ময়দানে, ইলম ও চিন্তার জগতে, পরিচালনা ও নেতৃত্বের প্ল্যাটফর্মে যারা জীবন্ত ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি, তাদের ধর্ম বিলীন হয়ে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মানুষের স্বভাব জীবিতদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া। বাতি প্রজ্বলিত হয় বাতি থেকেই। অতীতেও তাই হয়েছে, আজও তাই হচ্ছে, ভবিষ্যতে তাই হবে। সুতরাং এ উম্মতকে বাঁচতে হলে তার কর্তব্য জীবন্ত ব্যক্তিত্ব সৃজন করা, যেন তার ইলমের গাছ, চিন্তাবৃক্ষ, সংস্কারবৃক্ষ ও আধ্যাত্মিকতার মহীরুহ সবুজ কিশলয়ে পল্লবিত হয়, নতুন ফুল প্রস্ফুটিত করে। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আমার উম্মত বৃষ্টিধারাতুল্য; কেউ বলতে পারে না তার প্রথম ফোঁটাগুলো মৃত ভূমির জন্য অধিকতর জীবনদায়ক কিংবা শেষের বিন্দুগুলো।
আমি একজন ইতিহাস লেখক। আমার অনুভূতি, রচনা ও সঙ্কলন জীবনের অধিকতর অংশ অতিক্রান্ত হয়েছে ইতিহাসের অঙ্গনেই। তাই আমি বলতে পারি, ‘এ মরু পরিক্রমায় কেটেছে আমার জীবন।’ আমি বিশ্বাস করি, পূর্ববর্তীদের অবদান, তাঁদের নিষ্ঠা ও সততা, পূর্বসূরিদের ‘আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, তাঁদের অবিচলতা, তাঁদের কোরবানি ও আত্মত্যাগ উত্তরসূরিদের জন্য অমূল্য পুঁজি এবং জীবন ও জীবন-স্রোতের পয়গাম বাহক। ‘আমাদের পূর্বসূরিরা এমন বড় বড় বুজুর্গ ছিলেন’, ‘এত প্রখর ছিল তাঁদের মেধা ও স্মৃতিশক্তি, ‘এত অধিক বিস্তৃত ছিল তাঁদের জ্ঞান-পরিধি, ‘তাঁরা এমন সুবিশাল, সুগভীর ‘ইলমের অধিকারী’, এসব কথা আমরা দাবি করে আসছি, স্বীকৃতিও দিয়ে আসছি। এসব সর্বান্তকরণে স্বীকার্য; কিন্তু তা যথেষ্ট নয় কখনো।
মৃতদের বদৌলতে ‘ফয়েজ’ হাসিল হতে পারে; কিন্তু পথের দিশা পাওয়া যায় জীবিতদের কাছেই : আপনারা এমন ধারণা করবেন না, আমি বিগতদের সাথে অবিচার করছি। কেননা আমার সম্পর্ক সেই প্রতিষ্ঠান ও চিন্তাধারার সাথে যাঁরা এ (ভারত) উপমহাদেশে ইসলামের ইতিহাসকে বিন্যাস করেছেন এবং উর্দু ভাষায় ইসলামের ইতিহাস সংকলনের সৌভাগ্য লাভ করেছেন অর্থাৎ দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামা ও দারুল মুসান্নিফীন (লেখক সংঘ)। কথাটি অন্য কেউ বললে আপনাদের এ মন্তব্য যথার্থ হতো, বক্তা ইতিহাসে অনভিজ্ঞ, তাই ইতিহাসের প্রতি তিনি অবিচার করছেন। শুনুন! আমি বলছি, আমাদের পূর্বসূরিদের যাবতীয় কর্ম ও অবদান সংরক্ষিত থাকা এবং সমুজ্জ্বলভাবে থাকা অপরিহার্য। আমাদের কর্তব্য বিগতদের অবদানের সাথে নতুন বংশধরদের পরিচিত করানো এবং খুঁজে খুঁজে পূর্বসূরিদের কীর্তি ও অবদান সংগ্রহ করা। কিন্তু (আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো) কেয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী হওয়াই এ দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালা ও সিদ্ধান্ত। সুতরাং তার জন্য অপরিহার্য জীবন্ত ব্যক্তিত্ব। আধ্যাত্মিক কার্যক্রমও সমাধা হয় জীবন্ত বুজুর্গদের দ্বারাই। তাজকিয়া, আত্মশুদ্ধি ও অধ্যাত্ম জ্ঞান আহরিত হয় জীবন্ত ব্যক্তিত্বের শিক্ষা-দীক্ষায়। তা পরিপূর্ণতায় উপনীত হয় সান্নিধ্যেই- এটাই মুহাক্কিক ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের, সুফি-মাশায়েখের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত। অন্যথায় বিগতদের মাঝে তো এমন শীর্ষস্থানীয় বুজুর্গও ছিলেন যাঁদের একজনই গোটা সমাজ ও উম্মতের জন্য যথেষ্ট হতেন । (কিন্তু তা হয় না। কেননা) মুহাক্কিকরা বলেছেন, জীবনে রয়েছে নিত্য রূপান্তর ও পরিবৃদ্ধি, জীবন সদা দোদুল্যমান ও পরিবর্তনশীল। এখানে আনাগোনা চলে বিভিন্ন রঙ ও রূপের, পরিবেশ ও পরিস্থিতির। এখন রয়েছে এক বর্ণ, মুহূর্তে তা পরিবর্তিত হয়ে ধারণ করল নতুন বর্ণ। একটি ব্যাধির উপশমের সাথে সাথেই হয়তো দেখা দিলো নতুন ব্যাধি। জীবনসমৃদ্ধ বিশ্বের স্বভাবজগতের সাথে যাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে তারা পথ দেখাতে পারেন না। এ দোদুল্যমান জীবন্ত মানবসমাজের তাদের কাছ থেকে ফয়েজ (আধ্যাত্মিক সুষমা) লাভ করা যেতে পারে মাত্র (অবশ্য ফয়েজ হাসিলের নির্ধারিত পন্থায়; কাজেই ভুল বোঝাবুঝির অবসান কাম্য)। কিন্তু পথের সন্ধান লাভ জীবন্তদের হাতেই সীমিত। কোনো বংশধরের কাছে যদি থাকে সবধরনের সম্পদ, বড় বড় পাঠাগার, ইতিহাসের বিশাল সংগ্রহ; কিন্তু তাদের না থাকে এমন জীবন্ত ব্যক্তিত্ব যাদের অন্তর-চিন্তা, যাদের অনুসন্ধান ও উদ্ঘাটন, যাদের বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানবত্তা দ্বারা আলো লাভ করতে পারে শুধু জীবিতরাই, তাহলে সে গোষ্ঠীর বিলীন হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা বিদ্যমান।
দ্বীন সজীব হয়ে থাকবে : সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-‘আল্লাহ পাক প্রতি শতাব্দীর সূচনায় উত্থিত করতে থাকবেন একজন ‘মুজাদ্দিদ’ যিনি এ দ্বীনকে রাখবেন তরতাজা ও সজীব, সংস্কার সাধনে সঞ্চার করবেন নতুন জীবনী শক্তি।’ এ হাদিসের অর্থ এমন নয় যে, মুজাদ্দিদের আগমন মুহূর্তে তো দ্বীনের দেহে নতুন প্রাণ এলো কিন্তু বিশেষ সময় পর্যন্ত স্থায়ী হবে তার অস্তিত্ব।
(যিনি উম্মতের দ্বীনি ব্যাপারে সংস্কার সাধন করবেন) বাক্যাংশের অর্থ এমন নয়, তাঁর আগমনে দু-এক সপ্তাহ, দু-দশ দিন দ্বীনের চর্চা হলো, তারপর তিনি বিদায় গ্রহণ করলেন।
এ পর্যন্ত আগতদের জীবনী পড়ে দেখুন। কারো সংস্কার প্রভাব বিদ্যমান ছিল শতাব্দীব্যাপী আর কারো কারো তো কয়েক শতাব্দীব্যাপী।
আপনারা দেখে থাকবেন, রেললাইনে মাঝে মধ্যে একটি ছোট আকারের গাড়ি চলাচল করে। ওটার নাম ‘ট্রলি’ (লাইন চেকিং গাড়ি)। তার চলার নিয়ম হলো, মানুষ তাকে ধাক্কা লাগিয়ে তাতে চড়ে বসে, তখন সে পিচ্ছিল লাইনের ওপর আপন গতিতে চলতে থাকে। থেমে যাওয়ার উপক্রম করলে লোকেরা নেমে আবার ধাক্কা দিয়ে উঠে বসে। গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। এ গাড়ি লাইন পর্যবেক্ষণের জন্য। উম্মতের গাড়িও অনুরূপ মনে করুন। এ গাড়িতে ধাক্কাদাতারা হলেন এ উম্মতের ‘উলামা, মাশায়েখ ও মুজাদ্দিদরা। তাঁরা ঠেলে দিলে গাড়ি চলবে নিজের চাকায় গড়িয়ে, অনবরত চালাতে থাকে না কেউ, গাড়ি চলবে তার চাকার যোগ্যতায়। কিন্তু ঠেলে দেয়া ও চালু করে দেয়ার জন্য প্রয়োজন জীবনধারী মানুষ। কেননা ওটা কোনো টেকনিক্যাল মেশিনারি বস্তু নয়; বরং জীবন্তরা ধাক্কা দিয়ে তা চালু করে দিলে সে নিজের চাকার ঘূর্ণনে চলতে থাকে। ট্রলিতে জরুরি বিষয় দু’টি। ১. বিছানো লাইনের মসৃণতা, চাকার ঘূর্ণন ও গতি এবং এগিয়ে চলার যোগ্যতা; ২. মানুষের কব্জিতে ঠেলতে পারার মতো দৈহিক শক্তি। গাড়ির যাত্রীরা থাকবে স্থির, অনড়। আমাদের এ উম্মতের ঐতিহ্যও অনুরূপ। যখন উম্মত শিকার হতে শুরু করে কার্যহীনতা ও বেকারত্বের, তখন আল্লাহর কোনো বান্দা এসে তাকে ধাক্কা দেয়। সে তখন চলতে শুরু করে স্বকীয় গতিতে, আর এভাবে চলে যায় বেশ কিছু দূর।
হজরত মুজাদ্দিদে আলফেসানি (রহ:) ও হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ:), উভয়কে আমি মনে করি এ যুগের মুজাদ্দিদ। আমি এ-ও মনে করি, আজ উপমহাদেশের যত স্থানে দ্বীনি ‘ইলম-এর চর্চা হচ্ছে, যত জায়গায় সুন্নতের দাওয়াত চলছে, শিরক ও বিদাতের প্রতি ঘৃণা এবং তা বর্জন ও উৎখাতের অভিযান চলছে, সে সবই ওই দুই মনীষীর সাধনার ফল। দেখুন তো, এমন একজন মনীষী এলেন, যার সজোরে ধাক্কায় উম্মতের গাড়িতে গতি সঞ্চারিত হয়ে তা অবিরত চলছে বিগত সাড়ে তিনটি শতাব্দী ধরে। আল্লাহই ভালো জানেন, আর চলবে কতদিন! অতঃপর আল্লাহর আর কোনো বান্দা এসে ফের ধাক্কা লাগাবেন, তাতে চলবে আবার কতদিন। হজরত মুজাদ্দিদে আলফেসানি (রহ:)- এর তিরোধানের দেড় শতাব্দী পরে আগমন ঘটেছিল হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ:) ও শাহানে দেহলভী (দিল্লির শাহ) খান্দানের। তাঁদের কীর্তি ও অবদানের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে শুরু করেছে হিজরি ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে। আমার বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো এ কথা বলা, জীবন্ত ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিই হচ্ছে মাদরাসাগুলোর ও আলেমদের পবিত্র কর্তব্য।
এখন সর্বাধিক প্রয়োজন এমন একটি আলেমসমাজ যারা সক্ষম হবেন আধুনিক সমস্যাগুলো অনুধাবন করে তার সমাধান পেশ করতে এবং কুরআন-সুন্নাহ ও শরিয়তের সহায়তায়, ফিকহ-এর আলোকে পথ প্রদর্শন করতে। অতএব অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের সাথে সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হচ্ছে হজরত মুফতি মুহাম্মদ শফি, মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী, মওলানা ইউসুফ বিন্নুরী (রহ:) প্রমুখের মতো গভীর প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সৃষ্টির। যুগ এত অগ্রগতি সাধন করেছে, বিপদ এত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে এবং চ্যালেঞ্জ এত সুকঠিন হয়েছে যে, তার মুকাবেলার জন্য প্রয়োজন ছিল ইমাম গাজালি (রহ:), ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহ:) ও হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ:)- এর মতো যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীর। আর যদি হুজ্জাতুল ইসলাম গাজালি, শায়খুল ইসলাম ইবনে তায়মিয়া ও হাকিমুল ইসলাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ:)-এর সমপর্যায়ের লোক এ যুগে জন্মলাভ নাও করেন, তাহলে অন্তত গড়ে উঠুক উপরে নামোল্লিখিত (নিকট অতীতের) মনীষীদের সমতুল্য ব্যক্তিত্ব। সুতরাং মাদরাসাগুলোর দায়িত্ব হলো, তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করবে বিশালতা, উদার ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারার প্রসারতা ও ব্যাপকতা সৃষ্টির সাধনায়, অক্ল¬ান্ত সাধনা করবে কুরআন-সুন্নাহ রূহ ও আত্মার উপলব্ধি এবং তার সাথে নিবিড় পরিচয় লাভের মানসে ও শরিয়তের যথার্থ লক্ষ্যগুলোর অবগতি লাভের উদ্দেশ্য, যাতে জাতির নবাগত কর্ণধাররা জাতিকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারেন যুগের বিবর্তন সত্ত্বেও। সমস্যার সমাধানে ‘কিতাবে দেখে নিন’ বলা যথেষ্ট নয়। কেননা কিতাবগুলো তো লিখিত ও সংকলিত হয় যুগ-চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে।
‘তার নতুনত্ব ফুরিয়ে যাবে না, তার অভিনবত্ব নিঃশেষ হয়ে যাবে না’ এ বৈশিষ্ট্য একমাত্র আল্লাহর পবিত্র কালাম আল-কুরআনের। তার বাইরে মানবরচিত গ্রন্থমালায় মুদ্রিত থাকে রচনা-যুগের সুস্পষ্ট রূপ ও বৈশিষ্ট্য, সে যুগের ঘনীভূত প্রতিবিম্ব। যেকোনো মহান গ্রন্থকারের গ্রন্থ খুলে দেখুন, আল্লাহ যদি আপনাকে দান করে থাকেন ইলম-এর রুচি, প্রজ্ঞা ও প্রতিভা, তাহলে রচনাশৈলী দেখেই আপনি সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন তা কোন্ যুগের রচনা। আপনি অনায়াসে বলে দেবেন, ‘এ কিতাব তাতারি ফিৎনার পূর্বযুগের, এটি তার পরবর্তী যুগের, আর এটি মনে হচ্ছে অষ্টম শতাব্দীর রচনা।’ কেননা প্রতিটি যুগ, প্রতিটি শতাব্দীর বর্ণনাভঙ্গি, চিন্তাধারা ও স্তর বিভক্তি হয়ে থাকে স্বতন্ত্র।
আমি বলছি না, এসব মাদরাসা অহেতুক, অপ্রয়োজনীয়, বরং আমি বলছি, মাদরাসাগুলো একান্ত জরুরি ও যথেষ্ট বরকতময়। আমরা সবাই নিয়ামত ভা-ারের মুক্তা-কণা সন্ধানী। আমিও এই যে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, তা মাদরাসারই ফয়েজ, অবদান। আমার শিক্ষার আগা-গোড়ার পরিসমাপ্তি হয়েছে এ পদ্ধতিতেই। কিন্তু তবুও আমি বলতে চাই (এবং আশা করি গুরুত্ব ও পরিমাণে বাড়াবাড়ি না করে যতটুকু বলতে চাই, আমার কথার ততটুকু অর্থ করা হবে) এই দ্বীন জীবন্ত ধর্ম, তার জন্য চাই জীবন্ত মানুষ, জীবন্ত মানুষের স্পন্দনেই তার জীবনীশক্তি উজ্জীবিত হবে। পূর্বসূরির (বুজুর্গ) মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব বিন্দু পরিমাণ কমিয়ে দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথাটা বলে দেয়া, ‘বিগত মনীষীরা এ কথা বলে গেছেন’ এতটুকুতেই পরিতুষ্ট না হওয়া চাই ।
ধরুন, কেউ যদি আপনার কাছে মাসআলা জিজ্ঞাসা করতে এসে আপনার এ ওয়াজ শোনে, ‘আমাদের মাঝে জন্মেছিলেন এতবড় মহান এক আলেম, যিনি ছিলেন ‘ইলমের আকাশ, ইলমের পাহাড়’, তাহলে বিরক্ত হয়ে প্রশ্নকর্তা বলে বসবেন, জনাব! কূপে ইঁদুর পড়ে মরে রয়েছে, মহল্লার লোকেরা পেরেশান, শুধু বলুন কী করতে হবে? কত বালতি পানি তুলে ফেলতে হবে? আপনি যদি শুরু করেন, আমাদের মাঝে জন্মেছেন জগৎবরেণ্য ইমাম আবু হানিফা (রহ:), ইমাম মুহাম্মদ (রহ:), ইমাম জুফার (রহ:) প্রমুখ আর বলতে বলতে দম নেন আলবাহরুর-রাইক, বাদায়ে ‘উস-সানাই, ফাতাওয়া-ই-আলমগীরির মুসান্নিফদের জন্ম লাভের কাহিনী বলে, তাহলে অধিকতর বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোক বলে উঠবেন, জনাব! সব সহিহ, সব ঠিক হ্যায়। কিন্তু দয়া করে মাসআলাটি বলে দিন। নামাজের সময় হয়ে গেল, কূপ পবিত্র করার উপায়টা কী তাই বলুন। কোনো উস্তাদ আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে এলেন, ইবারতটি (লাইনটি) একটু বুঝিয়ে দিন, পঙ্ক্তিটির অর্থ করে দিন, আমি তা বুঝে উঠতে পারছি না। তখন যদি আপনি বক্তৃতা আরম্ভ করেন, ‘আমাদের পূর্বসূরিদের মাঝে জন্মেছিলেন অমুক অমুক সেরা সাহিত্যিক, যাঁরা সর্বযুগে অতুলনীয় ছিলেন। আব্দুুল কাহির জুরজানি, আবু আলী আল-ফারেসি, ইমাম আল্লামা যামাখশারি, আল্লøামা হারিরি, অমুক অমুক কারি ও অগণিত জ্ঞানবীর মনীষী, (তখনো আপনার বক্তৃতা শেষ হয়-নি, তাই বলতে থাকলেন) আর নিকট অতীতে এই ভারতের বুকে জন্মেছেন এমন এমন মনীষী যাঁদের কেউ পিছিয়ে নন অন্যের তুলনায়।’ উস্তাদজী সবিনয়ে আরজ করবেন, ‘জনাব! সবই ঠিক বলেছেন, কিন্তু এ মুহূর্তে সমস্যা হলো, ঘণ্টা হয়ে গেছে, ছেলেরা অপেক্ষা করছে, আমি যাচ্ছি সবক পড়াতে। তাই মেহেরবানি করে তাড়াতাড়ি কবিতা পঙ্ক্তির মতলবটা (ভাবার্থ) যদি বুঝিয়ে দেন। অনুরূপ অবস্থা যদি হয় প্রতিটি বিষয়ের যে বিষয়ের প্রশ্নকর্তা অমুক, তখন অনর্গল বক্তৃতা ঝেড়ে চলেছেন, ‘আমাদের শীর্ষ তালিকায় রয়েছেন অমুক’, তাতে সমস্যার সমাধান আশা করা যায় কি? উর্দু থেকে ভাষান্তর : মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ