শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৮ পূর্বাহ্ন

মজুদদারী সিন্ডিকেটের নিষিদ্ধতায় ইসলাম

শাহাদাত হোসাইন
  • আপডেট সময় রবিবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৪

গুটিকয়েক মজুদদারের হাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী গচ্ছিত থাকা। তাদের ইচ্ছামত মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করা। অমানবিক, নৈতিকতাবির্বজিত নিষিদ্ধ কাজ। ইসলাম খাদ্যসামগ্রী মজুদ করাকে হারাম করেছে। এটি ইসলাম কর্তৃক খাদ্যদ্রব্য সুষম বণ্টনের একটি উজ্জ্বল দিক। মানুষের সার্বিক কল্যাণের প্রতি খেয়াল রাখা ইসলামের অন্যতম মৌলিক আদেশ। নবীজি বলেছেন, কল্যাণকামিতাই ধর্ম। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, কার জন্য? ইয়া রাসূলাল্লাহ। নবীজি বললেন, আল্লাহ, রাসূল, মুসলিম নেতা এবং সর্বসাধারণের জন্য (আবু দাউদ : ৪৯৪৪)। মুসলিম ব্যক্তি সর্বত্র অন্যের কল্যাণকামী হবেন।
মজুদদার কারা অবৈধ মজুদদারী বলতে কী বোঝায়? : ইসলামে খাদ্যসামগ্রী মজুদ করা নিষিদ্ধ। অধিক মূল্যে খাদ্য বিক্রির মানসে খাদ্যদ্রব্যেরর বাজার মূল্য কম থাকাবস্থায় ক্রয় করে গুদামজাত করা এবং অত্যধিক প্রয়োজনের সময় উচ্চমূল্যে তা বিক্রয় করা। সব ইসলামী আইনজ্ঞের কাছে তা হারাম। আর এটিই সহিহ মত (আল-ফিকহুল মুয়াসসার ৬:৪৫)। এ ধরনের কর্মকা-ে জনসাধারণ ক্ষতির সম্মুখীন হন। এমন হীন কর্মে যারা যুক্ত তারাই অবৈধ মজুদদারী। এমন মজুদদারী নিষিদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম সাধারণ জনগণকে সার্বিক ক্ষতি থেকে হেফাজত করেছেন।
যেসব পণ্য মজুদ করা নিষিদ্ধ : সমাজের বণিক, ধনী, দুস্থ, অসহায় সব শ্রেণীর মানুষের খাদ্যসামগ্রীর অবাধ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ইসলাম খাদ্যের অবৈধ মজুদ নিষিদ্ধ করেছে। যেহেতু মানুষের দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। খাদ্যসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, উপকরণ, খাদ্যশস্য প্রভৃতি চড়াদামে বিক্রির ইচ্ছায় মজুদ করা হারাম (আল-জামে লি-উলুমি ইমাম আহমাদ ৯ : ১৫৯)।
অবৈধ মজুদদাররা মানুষের কষ্টে খুশি হয় : যাদের মনে মায়া-মমতা নেই। নেই মমত্ব ও মানুষত্ব। মানুষের কষ্টে যারা ব্যথিত হওয়ার বদলায় খুশি হয়। তারা মানুষ হিসেবে বড্ড দুর্ভাগা। আল্লাহ দরবারে তাদের কোনো অংশ থাকবে না। মুয়াজ ইবনে জাবাল রা: বলেন, আমি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলাম, মজুদদার কী? মজুদদার কারা? নবীজি বললেন, মজুদদার সেই ব্যক্তি যে পণ্য সস্তা হয়ে যাওয়ার কথা শুনলে কষ্ট পায়। আর মূল্যবৃদ্ধির কথা শুনলে খুশি হয়। মজুদদার ব্যক্তি কতই না নিকৃষ্ট। আল্লাহ পণ্য সহজলভ্য করলে, তারা চিন্তিত হয়। আর দুষ্প্রাপ্য ও চড়া করলে খুশি হয় (মুসনাদুস শামি : ৪১২)।
মজুদদাররা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত : দুনিয়ার কেউই আল্লাহর বিরাগভাজন হতে চায় না। চান না অভিশপ্ত হতে। কারণ যার প্রতি আল্লাহর অভিশম্পাত তার ধ্বংস অনস্বীকার্য। তার পরও মানুষ এমন কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে ধ্বংসই যার সুনিশ্চিত পরিণাম। অবৈধ খাদ্যসামগ্রী মজুদ করা তেমনি একটি কাজ, যা মানুষকে লানতপ্রাপ্ত বানায়। মজুদদারের প্রতি নবীজি অভিসম্পাত করেছেন। ইবনে ওমর রা: বর্ণনা করেছেন। নবীজি বলেছেন, আমদানিকারক রিজিকপ্রাপ্ত আর মজুদদারো লানতপ্রাপ্ত, অভিশপ্ত (মুসনাদে দারেমি : ২৫৮৬)। লানত থেকে রক্ষা পেতে অবৈধ মজুদদারী পরিত্যাগের বিকল্প নেই।
মজুদদার ব্যক্তির প্রতি দুনিয়াবি গজব : অধিক লাভের জন্য অসদুপায়ে পণ্য মজুদ রাখা ইসলামে ঘৃণিত ও নিষিদ্ধ কাজ। এর কারণে মানুষের জীবনযাপন কষ্টকর হয়। বিশেষত গরিব, অসহায় লোকজন নিগৃহের স্বীকার হয়। নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করবেন অথবা দেউলিয়া বানাবেন (আল মুন্তাখাবুল আদাবি : ১৭)। যারা মজুদদার তারা নবীজি কর্তৃক চিহ্নিত পাপীষ্ঠ। নবীজি বলেছেন, পাপীষ্ঠ ব্যতীত কেউ মজুদদার হতে পারেন না (মুসলিম : পৃ : ১২২৮)।
মজুদদার ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মামুক্ত হয়ে যায় : প্রতিটি মানুষের মনের সুপ্তবাসনা হলো, নিজেকে আল্লাহর নিরাপত্তায় রাখা। আল্লাহ দয়ার চাদরে নিজেকে হেফাজত করা। খাদ্য পণ্য মজুদ করা এতটাই গুরুতর অপরাধ যে, যদি কোনো ব্যক্তি মানুষের খাবার পণ্য মজুদ করে তবে মহান আল্লাহ সেই ব্যক্তির জিম্মাদারি থেকে মুক্ততা ঘোষণা করেন। নবীজি বলেছেন, যে ব্যক্তি খাদ্য মজুদ করল। (অধিক লাভের আশায়) চল্লিশ রাত পর্যন্ত প্রতিক্ষা করল। সে আল্লাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় আর আল্লাহ তার থেকে মুক্ততা ঘোষণা করেন (মুনাদুল হারেস : ৪২৬)।
মজুদদারের ব্যাপারে ওমরের কঠোর হুঁশিয়ারি : ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা:) সর্বসাধারণের প্রতি ছিলেন কোমল হৃদয়। আর ঠগ-বাটপারদের জন্য ছিলেন এক বিভীষিকার নাম। সে জন্য ওমরের খেলাফতকালে কেউ অপরাধ করত না। ইবনে হানি ওমরের একটি কথা বর্ণনা করেন। ওমর বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের শহরে খাবার নিয়ে আসে সে আমি তার প্রতিবেশী এবং তার খাদ্যসামগ্রীর জামিনদার। কোনো মজুদদার তা আমাদের বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না। সে অন্য যেখানে ইচ্ছা তা বিক্রয় করুক (আব্দুর রাজ্জাক : ১৪৯০১)।
ক্ষতির আশঙ্কায় পণ্য মজুদ রাখার বিধান : ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের ছেলে আবুল ফজল সালেহ বলেন, আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম। একজন ব্যক্তি বসরা থেকে খেজুর ক্রয় করে বাগদাদ অথবা আমাদের মক্কা-মদিনার কোনো একটি শহরে বিক্রির জন্য এলেন। সেখানে এসে দেখলেন, খেজুরের দামে দরপতন হয়েছে। এ অবস্থায় সে ক্ষতি করে বিক্রি করতে চাচ্ছে না। এখন যদি সে এসব খেজুর গুদামজাত করে। তবে কি সে অবৈধ মজুদকারী হিসেবে গণ্য হবে? উত্তরে ইমাম আহমাদ বলেন, আশা করি সে অবৈধ মজুদকারী হবেন না (মাসায়েলুল ইমাম আহমাদ ২:২৩৭)।
পরিবারের সদস্যদের জন্য মজুদ করা : ইমাম জাফর বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং গৃহপালিত পশুর জন্য এক কিংবা দুই বছরের খাদ্য মজুদ রাখে তাহলে সে অবৈধ মজুদদার বলে বিবেচিত হবে না। ওমর থেকে একটি হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, নবীজি তাঁর পরিবারের জন্য এক বছরের খাবার সংরক্ষণ করেছিলেন (বুখারি: ২৯৫৪)। লেখক : খতিব, বাইতুল আজিম জামে মসজিদ রংপুর




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com