গতকাল ১৫ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশ্ববাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটিতে এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘ডায়াবেটিস: সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’।
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র হরমোন সংশ্লিষ্ট একটি অসংক্রামক দীর্ঘমেয়াদি রোগ। বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলছে। এ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনির সমস্যাসহ অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়। আমাদের সচেতনতা, সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা দিয়ে আমরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি।
ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি থাকে। অগ্ন্যাশয় নামক গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন হরমোন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। এ ইনসুলিন যদি ঠিকভাবে কাজ না করতে পারে বা ইনসুলিন নিঃসরণ যদি কমে যায়; তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে বহুমূত্র রোগের জন্ম হয়। বিভিন্ন ধরনের ডায়াবেটিসের মধ্যে টাইপ-১ ডায়াবেটিস শৈশবেই দেখা দেয়। অন্যদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস সাধারণত ৩৫-৪০ বছরের পরে হয়। এ ছাড়া অনেক গর্ভবতীর গর্ভাবস্থায়ও ডায়াবেটিস হতে পারে। যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন অতিরিক্ত, যারা ধূমপান করেন বা মানসিক চাপে আছেন; তাদের এ রোগের ঝুঁকি বেশি। এ ছাড়া অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, ভাইরাসঘটিত রোগ, অগ্ন্যাশয়ে অস্ত্রোপচার প্রভৃতি কারণেও এ রোগ হতে পারে।
এ রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে আছে ঘন ঘন প্রসাব হওয়া; বিশেষ করে রাতের বেলায় ঘুম থেকে জেগে বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, এ ছাড়া খুব তৃষ্ণা পাওয়া, শরীরের ওজন হ্রাস পাওয়া, কোথাও কেটে গেলে ক্ষতস্থান শুকাতে দেরি হওয়া, অল্পতেই ক্লান্তবোধ করা, সহজেই বিভিন্ন ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়া, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া ইত্যাদিও এ রোগের লক্ষণ।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমাদের তিনটি ‘ডি’ মেনে চলতে হবে: ১. ডায়েট (সুষম খাদ্যাভ্যাস)
২. ডিসিপ্লিন (নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা) এবং ৩. ড্রাগ (ওষুধ সেবন)।
এ জন্য প্রতিদিন সুষম খাদ্য গ্রহণ, সরল শর্করা পরিহার করে কম সরল শর্করা গ্রহণ, এক বেলা ভাতের পরিবর্তে রুটি খাওয়া, পাশাপাশি আঁশযুক্ত শাক-সবজি, ফল-মূল, পরিমাণমতো আমিষ খাবার তালিকায় রাখা; চিনি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, প্রতিদিন দুইবেলায় অন্তত ১ ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করা, যোগ-অনুশীলন বা কায়িক পরিশ্রম করা–জীবনযাপন ব্যবস্থায় এসব পরিবর্তন আনা যেতে পারে।
ওষুধ খেলে খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ বা কায়িক পরিশ্রমের দরকার নেই, এটি একেবারে ভুল কথা। নিয়মিত হাঁটার ফলে ইনসুলিন নিঃসরণ বেড়ে যায় এবং শরীরে এর কাজ করার ক্ষমতাও বেড়ে যায়। পাশাপাশি শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান পরিহার করা, মানসিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখা, রাতে সাত-আট ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস করা–ইত্যাদি বিষয়ও মেনে চলা যেতে পারে।
যখন ডায়েট এবং ডিসিপ্লিনেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তখন ওষুধের প্রয়োজন পড়ে। যেমন- টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত গ্রহণ করে প্রথমে মুখে খাওয়ার ওষুধ গ্রহণ করা যাতে পারে। এগুলো কাজ না করলে এরপর ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া টাইপ-১ ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, ডায়াবেটিস ঘটিত বিভিন্ন জটিলতায়, অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রোগিকে ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিকভাবে ইনসুলিনের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিসজনিত জটিলতায় বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। আসুন আমরা প্রতিদিন সুষম খাদ্যাভ্যাস তৈরি করি এবং নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারার মাধ্যমে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখি। লেখক: ডা. হিমেল ঘোষ , চিকিৎসক সহকারী রেজিস্ট্রার, মেডিসিন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।