শীতকালে আমরা অধিকহারে ঠাণ্ডা অনুভব করি, অপর দিকে গ্রীষ্মকালে অনুভব করি প্রখর তাপ। এ দুই কালে ঠা-া ও গরমের প্রচ-তার কারণ হাদিসে নববীতে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘জাহান্নাম তার প্রতিপালকের কাছে এ বলে অভিযোগ করেছিল যে, হে আমার প্রতিপালক! (প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে) আমার এক অংশ অন্য অংশকে গ্রাস করে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে দু’টি শ্বাস ফেলার অনুমতি দিলেন। একটি শীতকালে, অপরটি গ্রীষ্মকালে। আর সে দু’টি হলো, তোমরা গ্রীষ্মকালে যে প্রচণ্ড উত্তাপ এবং শীতকালে যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভব কর তাই।’ (বুখারি ও মুসলিম) অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা গরমের যে প্রচ-তা অনুভব করো তা জাহান্নামের গরম নিঃশ্বাসের কারণেই। আর শীতের তীব্রতা যা পাও তা জাহান্নামের ঠাণ্ডা নিঃশ্বাসের কারণেই।’ (বুখারি)
পবিত্র কুরআন মাজিদে শুধু দু’টি ঋতুর কথা উল্লেখ রয়েছে। তা হলো- শীত ও গ্রীষ্ম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- ‘তাদের (কুরাইশ বংশের লোকদের) অভ্যাস ছিল শীত ও গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ।’ (সূরা আল-কুরাইশ, আয়াত-০২)
শীতকালকে রাসূলে কারিম সা: মুমিনের জন্য ঋতুরাজ বসন্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘শীতকাল হলো মুমিনের বসন্তকাল’। (মুসনাদে আহমাদ)
সব ঋতুই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সৃষ্টি। তাই আল্লাহ তায়ালার কাছে কোনো ঋতুই আলাদা বৈশিষ্ট্যম-িত নয়। তবে কোনো কোনো ঋতুতে বিশেষ কিছু সুবিধা থাকে। যেমন- শীতকালে দিন ছোট হয় এবং সূর্যের তাপ কম হওয়ায় পানির পিপাসা কম হয়ে থাকে। তাই সহজেই শীতকালীন সময়ে রোজা রাখা যায়। অপর দিকে শীতকালে রাত দীর্ঘ হয়। একজন মানুষের স্বাভাবিক ঘুমের পরও শীতকালে রাতের আরো কিছু অংশ বাকি থাকে। ফলে কেউ চাইলে সহজেই রাতের বাকি অংশ সালাতুত তাহাজ্জুদ, জিকির-আজকারের মাধ্যমে কাটিয়ে দিতে পারে। সে হিসেবে হাদিস শরিফে শীতকালীন আমলের বিশেষ মর্যাদার কথা বর্ণিত হয়েছে। এক হাদিসে রাসূলে কারিম সা: ইরশাদ করেন, ‘শীতের রাত দীর্ঘ হওয়ায় মুমিন রাত্রিকালীন নফল নামাজ আদায় করতে পারে এবং দিন ছোট হওয়ায় মুমিন রোজা রাখতে পারে।’ (বায়হাকি)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রা: বলেন, ‘শীতকাল হলো মুমিনের জন্য গণিমত’। প্রখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলতেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম, কেননা তা বরকত বয়ে আনে। শীতের রাত দীর্ঘ হয়, যা কিয়ামুল লাইলের (রাতের নামাজ) সহায়ক এবং দিন ছোট হয়, যাতে রোজা রাখতে সহজ।’
ইমাম গাযালি রহ. বলেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য শীতকালের চেয়ে প্রিয় কোনো সময় আছে কি না আমার জানা নেই। কারণ শীতের দিনগুলো ছোট থাকে আর রাতগুলো বড় হয়। তাই দিনে রোজা রাখা আর রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে থাকা সহজ হয়।’ (কিমিয়ায়ে সাআদাত)
তাই শীতের আগমনে আমাদেরকে প্রস্তুত হতে হবে অধিক ইবাদতের জন্য। পাশাপাশি শীতের আগেই সাধ্যানুযায়ী দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা, মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বস্ত্র। দরিদ্র মানুষের শীত নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক থাকে না। শীতকালে অন্য সময়ের তুলনায় মোটা, ভারী, উষ্ণ পোশাকের প্রয়োজন হয়। এ ধরনের পোশাক অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তাই শীতকালে গরিব-অসহায় মানুষরা শীতবস্ত্রের অধিক মুখাপেক্ষী থাকে। প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র পরিধান না করার কারণে তারা বিভিন্ন প্রকার রোগে আক্রান্ত হয়, এমনকি শৈত্যপ্রবাহে শীত নিবারণ না করার ফলে মৃত্যুর মুখেও পতিত হয়। এর জন্য সমাজের ধনী মানুষের দায়িত্ব তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র বিতরণ করা।
দরিদ্র মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। বদর যুদ্ধে বন্দী হজরত আব্বাস রা:-কে রাসূল সা: পোশাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। রাসূল সা:-এর কাছে মুদার গোত্র থেকে গলায় চামড়ার আবা পরিহিত বস্ত্রহীন কিছু লোক এলো। তাদের করুণ অবস্থা দেখে তাঁর চেহারা বিষণ্ন হয়ে গেল। তিনি নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরামের সামনে দান-সাদকার উৎসাহমূলক খুতবা দিলেন। ফলে সাহাবায়ে কিরাম এত অধিক পরিমাণ দান করলেন যে, খাদ্য ও পোশাকের দু’টি স্তূপ হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সা: অত্যন্ত আনন্দিত হলেন, তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বস্ত্র দানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের পোশাক দান করবেন। ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল দান করবেন। কোনো তৃষ্ণার্ত মুসলমানকে পানি পান করালে মহান আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানীয় পান করাবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ) লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক